সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............ বাবা আদম মসজিদ
মধ্যযুগে বাংলার রাজধানী গৌড় থেকে অনেক দূরে ছিল আধুনিক মুন্সিগঞ্জ জেলা। জেলার প্রাচীন হিন্দু বসতি রামপাল উপজেলায় মধ্যযুগীয় মুসলিম ঐতিহ্যের একমাত্র প্রতিনিধি বাবা আদম মসজিদ। মসজিদটি পরবর্তী সময়ে সংস্কার করা হলেও এর আদিরূপ উত্তমভাবেই সংরক্ষিত হয়েছে বলে ধারণা হয়। স্থানীয় সুফি বাবা আদমের নামানুসারে মসজিদটি বাবা আদম মসজিদ নামে পরিচয় লাভ করে। জনশ্রুতি মতে, সুফি বাবা আদম মসজিদের পাশে একটি অতি সাধারণ সমাধিতে শায়িত রয়েছেন।
মসজিদটি প্রাথমিক ইসলামী যুগের ছয় গম্বুজ মসজিদের প্রতিনিধিত্ব করে। জেলার মীর কাদিম থেকে প্রায় এক মাইল দক্ষিণে ও বল্লালবাড়ি থেকে প্রায় এক মাইল উত্তর-পশ্চিমে মসজিদটি অবস্থিত।
সাধারণ আয়তাকার মসজিদটি অভ্যন্তরভাগে ৬.৬৪ মিটার * ১০.২৩ মিটার পরিমাপের। মসজিদের চারপাশের দেয়ালগুলো ১.৮৫ মিটার প্রশস্ত। ইমারতের চারকোণে চারটি অষ্টকোণা টারেট রয়েছে।
এগুলো রীতিবদ্ধভাবে কার্ণিশের সীমাতেই সমাপ্ত। এখানে পূর্বদেয়ালের তিনটি প্রবেশপথ ব্যতীত অপর কোন প্রবেশপথ নেই। মসজিদের মেঝে ভূমি থেকে কিছুটা উপরে। কেন্দ্রীয় প্রবেশপথের সাথে তিনধাপের একটি সিঁড়ি দিয়ে ভূমি থেকে মেঝেতে প্রবেশ করা যায়। পূর্ব দেয়ালের তিনটি প্রবেশপথ বরাবর ছন্দায়িতভাবে কিবলা দেয়ালে তিনটি মিহরাব রয়েছে।
মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে পূর্ব ও পশ্চিম কোণা চাপিয়ে সমান্তরালভাবে চারটি কুলুঙ্গি রয়েছে। ইমারত অভ্যন্তরে গ্রানাইট পাথরে নির্মিত দু’টি স্তম্ভ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্তম্ভ দু’টি মেঝে থেকে চার ফুট পর্যন্ত অষ্টকোণাকার এরপরে ষোল কোণা। এ দু’টি স্তম্ভ ও চারপাশের দেয়ালের ওপর মসজিদের ছয়টি গম্বুজ সংস্থাপিত। গম্বুজগুলো সুলতানী আমলের সাধারণ ক্ষুদ্রায়তনের ও অনুচ্চ।
গম্বুজ শীর্ষে তিন স্তরের একটি ক্ষুদ্র নির্মাণ দেখা যায়। কালের যাত্রায় মসজিদের কয়েকটি গম্বুজ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর তা নতুন করে নির্মাণ করে। মসজিদের কার্নিশগুলো দু’ধারে কিছুটা বক্র হয়ে নেমে গেছে।
এক সময় মসজিদটি টেরাকোটার চমৎকার অলঙ্করণ সমৃদ্ধ ছিল।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সংস্কারে এর অনেক নকশা হারিয়ে গেছে বলে জানা যায়। ইমারতের সমগ্র কার্নিশে ব্যান্ডের মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খোপ নকশা স্থান পেয়েছে। চারকোণার টারেটগুলোর নিম্নাংশ কেন্দ্র করে দেয়ালে ব্যান্ড ও খোপ নকশা রয়েছে। মসজিদের পূর্ব ফাসাদে প্রবেশপথের শীর্ষে খোপ নকশা ও ইট খোদাই নকশা স্থান পেয়েছে। কেন্দ্রীয় প্রবেশপথের দু’পাশে টেরাকোটার ছন্দায়িত চিত্রফলক দেখা যায়।
মসজিদের কেন্দ্রীয় প্রবেশপথের শীর্ষে সংস্থাপিত একটি শিলালিপি অনুসারে ১৪৮৩-৮৪ সালে সুলতান জালালউদ্দিন ফতেহ শাহুর আমলে মালিক কাফুর নির্মাণ করেন। মসজিদের পাশেই ২৫ ফুট বাহুবিশিষ্ট একটি বর্গাকার ইটে নির্মিত ঢিবি বাবা আদমের মাজার বলে কথিত। এ মসজিদ ও মাজার নিয়ে নানারকম জনশ্রুতি প্রচলিত রয়েছে।
জানা যায়, বাবা আদম রাজা বল্লাল সেনের রাজত্বকালে (১১৫৮-৭৯) বিক্রমপুরে ইসলাম প্রচারের জন্য আসেন। কোন এক পর্বে বাবা আদমের জবাইকৃত গরুর মাংসের একটি টুকরা চিল রাজবাড়িতে ফেলে দিলে গরু জবাই বিরোধী রাজা ক্রোধান্বিত হয়ে স্বসৈন্যে ফকিরের বিরুদ্ধে অভিযানে আসেন।
তিনি বুকের মধ্যে কাপড়ের নিচে একটি কবুতর নিয়ে নেন। যদি তিনি যুদ্ধে পরাজিত হন তবে কবুতরটি রাজবাড়িতে এসে সংবাদ দিবে, আর অন্তঃপুরীর নারীরা ম্লেচ্ছদের হাত হতে ইজ্জত বাঁচানোর জন্য রাজবাড়ির নিকটস্থ কুন্ডের আগুনের মধ্যে আত্মাহুতি দিবে। রাজা দরবেশের নিকটে এসে দেখলেন, তিনি গভীর তপস্যায় মগ্ন। রাজা তরবারির এক আঘাতে দরবেশের ভবলীলা সাঙ্গ করলেন। তিনি মনের আনন্দে দরবেশের রক্ত শরীর থেকে পরিষ্কার করার জন্য নিকটবর্তী নদীতে নামলেন।
এ সময় তার বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখা কবুতরটি হঠাৎ ছাড়া পেয়ে রাজবাড়িতে উড়ে যায়। রাজা কবুতরের পিছনে পিছনে সবেগে দৌড়িয়েও কবুতরটির নিকটে আসতে পারেননি। রাজবাড়িতে এসে রাজা তার পরিবারের কাউকে অবশিষ্ট পাননি। তারা সবাই আগুনে আত্মাহুতি দিয়েছে। মনের দুঃখে রাজাও তাদের অনুসরণ করলেন।
ফলে সেখানে মুসলমান রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
রাজা বল্লাল সেন ১১৭৯ সালে মারা গেলে তার পুত্র লক্ষ্মণ সেন ১২০৬ সাল পর্যন্ত বিক্রমপুর অঞ্চলে রাজত্ব করেন। এরপরে লক্ষ্মণ সেনের একপুত্র বিশ্বরূপ সেন ১২২০ সাল পর্যন্ত ও আর এক পুত্র কেশব সেন ১২২৩ সাল পর্যন্ত বিক্রমপুরে রাজত্ব করেছিলেন বলে শিলালিপিতে প্রমাণ পাওয়া যায়। লক্ষ্মণ সেন অবশ্য ১২০৫ সালে গৌড়ের সিংহাসন হারিয়েছিলেন। ১২৪৫ সাল পর্যন্ত সেন বংশীয় নৃপতিগণ বিক্রমপুরে রাজত্ব করেছিলেন বলে মিনহাজ ‘তবাকাত-ই-নাসিরি’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
তাই এতসব নির্ভরযোগ্য প্রমাণের পর রাজা বল্লাল সেনের সময় বিক্রমপুরে বাবা আদমের আবির্ভাব ও বল্লাল সেনের মৃত্যুর ঘটনা সম্পর্কিত কাহিনী প্রমাণ করা সম্পূর্ণ অসম্ভব।
মূলত শিলালিপি সূত্রে নিশ্চিত যে, আলোচ্য মসজিদটি উল্লেখিত জনশ্রুতিতে তিন শতাধিক বছর পরে নির্মিত হয়েছে। মসজিদে প্রাপ্ত শিলালিপিতে বাবা আদম শহীদের কোন উল্লেখ নেই, উল্লেখ নেই কোন মাজারেরও। শুধু জনশ্রুতির ওপর ভিত্তি করেই এই কল্পকাহিনী যুগ যুগ ধরে প্রচলিত রয়েছে। জনশ্রুতি যাই থাক, তার গুরুত্ব যতটুকুই হোক কিন্তু বাংলার মুসলিম ধর্মীয় ইমারত হিসেবে এ মসজিদের গুরুত্ব অপরিসীম।
(আমার এই লেখাটি ইতিপূর্বে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়েছিল। ইত্তেফাকের শব্দ রীতিমত লিখেছিলাম-যা এখানেও পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং পরিমার্জন করা হয়নি)
***ব্যস্ততার জন্য পাঠকদের মন্তব্যের জবাব যথা সময়ে দিতে পারবোনা-তাই কোনো মন্তব্য নিচ্ছিনা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।