বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ বাল্মীকি । প্রাচীন ভারতের মহান ঋষি। মহৎ কবি।
মহৎ কবি, কেননা, বাল্মীকি মহাকাব্য রামায়ণ-এর রচয়িতা; সাত কান্ডে (canto ) এবং ২৪ হাজার পদে (verse) রচিত যে রামায়ণ-এর কেন্দ্রবিন্দু বিষ্ণুর অবতার ভগবান রাম এবং রামের সতীসাব্ধী স্ত্রী সীতা। নানা ঘটনা ও চরিত্র বিচিত্র বিন্যাসে গ্রথিত হয়েছে রামায়ণ, যাতে প্রতিফিলিত হয়েছে সনাতন ভারতবর্ষীয় জীবনধারা- এসব কারণেই রামায়ণ লাভ করেছে মহাকাব্যের মর্যাদা ।
রাবণ কর্তৃক সীতাহরণ ও রাম কর্তৃক সীতাউদ্ধার রামায়নের মূল বিষয়বস্তু। প্রশ্ন উঠতে পারে- বাল্মীকি কি ভাবে রামায়ণ লেখার প্রেরণা পেলেন। বস্তুত: রামায়ণ রচনার পটভূমি কিছুটা বিচিত্র।
সেই পটভূমি বিশ্লেষন করে আমাদের বাল্মীকিকে প্রাচীন ভারতের একজন পরিবেশবাদী কবি বলেই মনে হয়।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক:
একদিন ভোরবেলা বাল্মীকি তমসা নদীতে স্নান করতে যাচ্ছিলেন। তমসা,- গঙ্গারই একটি শাখা নদী। ঋষির সঙ্গে একজন শিষ্য। শিষ্যটি ঋষির বস্ত্র বহন করছিল।
রবীন্দ্রনাথ অবশ্য তাঁর ‘ভাষা ও ছন্দ’ কবিতায় ওই একই ঘটনার ঈষৎ পরিবর্তিত বর্ননা দিয়েছেন এভাবে :
... তট-অরণ্যের তলে তরঙ্গের ডম্বরু বাজায়ে
ক্ষিপ্ত ধূর্জটির প্রায় ,সেইমতো বনানীর ছায়ে
স্বচ্ছ শীর্ণ ক্ষিপ্রগতি স্রোতস্বতী তমসার তীরে
অপূর্ব উদবেগভরে সঙ্গীহীন ভ্রমিছেন ফিরে
মহর্ষি বাল্মীকি কবি-
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: তমসার তীরে /অপূর্ব উদবেগভরে সঙ্গীহীন ভ্রমিছেন ফিরে ...তার মানে বাল্মিীকি একা ছিলেন। সে যাই হোক। তমসার টলটলে জল দেখে বাল্মীকি শিষ্যটিকে বললেন, দেখ কী স্বচ্ছ জল। সৎ মানুষের মনের মতো। আমি এই জলে স্নান করব।
বলে ঋষি নদীর পাড় এসে দাঁড়ালেন। ঠিক তখনই ঋষিপাখির মিষ্টি কন্ঠস্বর শুনতে পেলেন । মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলেন ভোরের আকাশে এক জোড়া ‘ক্রৌঞ্চ’ পাখি উড়ে যাচ্ছে। সংস্কৃতে ‘ক্রৌঞ্চ’ বলতে, পন্ডিতদের মতে, কোঁচ বক বোঝায়। ওই নির্মল দৃশ্যটি দেখে বাল্মীকি অত্যন্ত প্রীত হলেন বটে তবে সহসা একটি পাখি তীরবিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে গেল ঋষি চমকে উঠলেন ।
পাখিটি ছিল পুরুষ । স্ত্রীপাখিটি আকাশ থেকে নেমে এসে নিহত সঙ্গীকে ঘিরে আর্তস্বরে ডাকাডাকি করতে থাকে। বাল্মীকি ওই করুণ দৃশ্যটি দেখে শোকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। কবি বলেই। ঋষি বলেই।
বাল্মীকি এদিক-ওদিক তাকিয়ে তীরধনুক হাতে ব্যাধ ( শিকারী) কে দেখতে পেলেন। অত্যন্ত ক্ষুব্দ হয়ে বাল্মীকি ব্যাধকে অভিশাপ দিলেন।
মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতমঃ । । ১।
২। ১৫
ইংরেজি তর্জমায় লাইন দুটির মানে এরকম দাঁড়ায়:
You (ব্যাধ ) will find no rest for the long years of Eternity
For you killed a bird in love and unsuspecting
এটিই সংস্কৃত সাহিত্যের প্রথম শ্লোক। শোক থেকে শ্লোক। নিহত পাখির শোক থেকেই উৎসারিত বাক্য বলেই ‘শ্লোক’। আদিশ্লোকের রচয়িতা বলেই বাল্মীকি আদিকবি ।
নিষ্ঠুর ব্যাধ তীরবিদ্ধ করেছিল জোড়ার পুরুষপাখিকে । স্ত্রীপাখিটিকে কাতর বিলাপ করতে দেখে বাল্মীকির মনে এক বিরহ কাতর নারীর ছবি ভেসে উঠল । সেই বিরত কাতর নারীই রামের স্ত্রী সীতা। স্ত্রী কোঁচ বকের করুন বিলাপই রামায়ণ লেখার প্রেরণা। এবং এই ঘটনাকে পরবর্তীকালের গবেষকরা নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
যেমন রবীন্দ্রনাথ বাল্মীকির কবিপ্রতিভার দিকটি প্রাধান্য দিয়েছেন । লিখেছেন:
অলৌকিক আনন্দের ভার বিধাতা যাহারে দেয়
তার বক্ষে বেদনা অপার ... (ভাষা ও ছন্দ)
একুশ শতকে বিষয়টি আমরা একটু ভিন্নভাবে দেখতে চাই।
২
টেকনাফ নিউজ . কম-এ নজির আহমেদ সীমান্ত (১৩ জুলাই ২০১১) ‘টেকনাফে প্রকৃতির বিলুপ্ত পরিবেশ ধরে রেখেছে বক বাড়ি’
শীর্ষক এক ছোট্ট নিবন্ধে লিখেছেন: ... টেকনাফ জাদিমুরার ঐতিহ্যবাহী বক বাড়ি এখন সাদা বকের পরিবার পরিজনের কলরবে ওখানের পরিবেশ যেন শত শত বছর আগেকার মনে হয়। এক সময় আমাদের দেশের সর্বত্রে ছিল নানান পশু-পাখির কল-কাকলীতে ভরপুর সে এক পরিপূর্ণ পরিবেশ। সে পরিবেশ হয়তো আর ফিরে আসবে না।
তবে পরিবেশবাদীরা চেষ্টা করে যাচ্ছে। দেশের কোথাও পূর্বকার সে বিলুপ্ত পরিবেশ খুজে পাওয়া দুস্কর হলেও টেকনাফ জাদিমুরার বক বাড়ি নামে খ্যাত জায়গাটিতে হরেক রকমের পাখির ডাক শোনা না গেলেও সাদা বক ও পানকৌড়ির শুনতে পাওয়া যায়। পাখিদের আনাঘোনায় এখানকার পরিবেশ সেই বিলুপ্ত পরিবেশের সন্ধান মিলবে কিছুটা। ...বকবাড়ির সাদা বক ও পানকোড়ি পাখি প্রতিবছর মে মাসের প্রথমদিকে দূরদেশ থেকে এখানে আসে। এসব ভিনদেশী পাখিরা অভয়ারণ্যে এসে প্রথমে বাসা বাধে।
সে বাসায় ডিম পাড়ে। মাসব্যাপী তা দিয়ে বাচ্চা দেয়। বাচ্চারা যখন ওকি দিয়ে মনোরম পৃথিবী চোখ মেলে দেখে হয়তো পৃথিবীর সৌন্দর্য্যে বিভোর হয়ে আনন্দে চেচাঁমেচি করে। আমরা এ চেচাঁমেচিকে পাখির কলকাকলী শুনে মুগ্ধ হয়। শুধু টেকনাফে পরিবেশ ও পাখি প্রেমীরা কেন দেশ-বিদেশ থেকে আসা পর্যটকরা ও মুগ্ধ হয়।
এখন আষাঢ় মাস। মা বক বাচ্চাদের নিয়ে সুদূর গন্তব্যে উড়াল দেওয়ার অপেক্ষা করছে যেন। প্রতি বছর এরকমই হয়। সাদা বক ও পানকৌড়িরা প্রজননের জন্য প্রতিবছর এ মৌসুমে আসে এই অভয়ারণ্যে। এসব পাখি নিরাপদে নির্ভয়ে বসবাস করে এখানে।
অথচ আশপাশে পাকি শিকারীর অভাব নেই। পাখি শিকারীরাও এখন আর শিকার করে না। তারাও প্রকৃতির প্রেমে পড়ে গেছে অনেকটা। এই বাঘ-মহিষের সম্পর্ক এমনি গড়ে উঠেনি। এর পিছনে শ্রম, ত্যাগ, মেধা ব্যয় করেছেন বক বাড়ির মালিক পাখি প্রেমী সাবেক ফ্লাইট সার্জেন্ট আবুল হাশেম।
তিনি এখন পাখিদের দেখবাল করে না। কেননা গত বছর পাখির প্রেম, পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন। তারপরও তার উত্তরসূরীরা পাখিদের প্রেমের চাদরে ঢেকে রেখেছে। যেন আবুল হাশেম এখনো বেঁচে আছে। ... আবুল হাশেমের ছেলে রেজাউল করিমের কথা হলে তিনি জানান, তার বাবা চাকরী থেকে অবসরে আসার পর থেকে এ এলাকার পাখি শিকারীদের সচেতন করে তুলতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন।
তিনি সফলও হয়েছেন। যেখানে পূর্বদিকে নাফনদী, কেওড়া বাগান, পশ্চিম পার্শ্বের নাইট্যং পাহাড় ও তার পাদদেশে ঘুমন্ত পাখি শিকার করত। পাখি জবাই করে উল্লাস করত পাখি শিকারীরা। এক সময় এ অঞ্চলে পাখির অকাল পড়ে। এ অবস্থা দেখে তার বাবা আশপাশে বিশাল এলাকা পাখি শিকার নিষিদ্ধ ঘোষনা করে পাখিদের ভালবাসতে শিখিয়েছেন মানুষকে।
এ এলাকার মানুষ ফিরে পেয়েছে যেন আগেকার পরিবেশ।
৩
মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতমঃ । । ১। ২।
১৫
হে ব্যাধ তুমি অনন্তকাল শান্তি পাবে না।
তুমি হত্যা করেছে প্রেমে মগ্ন পাখি!
এই আদিশ্লোকের রচয়িতা কবিটি একদিন টলটলে তমসার জল দেখে তাঁর শিষ্যটিকে বলেছিলেন, দেখ কী স্বচ্ছ জল। সৎ মানুষের মনের মতো। আমি এই জলে স্নান করব ...
তথ্যসূত্র:
জ্যোতিভূষণ চাকী সম্পাদিত বাল্মীকি রামায়ণ
রবীন্দ্রনাথের ভাষা ও ছন্দ কবিতাটি নিয়েছি শঙ্খঘোষ সংকলিত সূর্যাবর্ত : রবীন্দ্রকবিতা-সংকলন থেকে
টেকনাফ নিউজ . কম-এর ঠিকানা ...
Click This Link
উৎসর্গ: বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ অবিকৃত রাখতে যারা নিয়ত সংগ্রাম করে যাচ্ছেন ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।