আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শেষ মুহূর্তের কূটনীতিতে দৃশ্যত ঢাকার জয় ----

কালের কণ্ঠ ঃঃঃ ---- ছিটমহল বিনিময়ের জন্য সুস্পষ্ট কোনো সময়সীমা উল্লেখ না করলেও আগামী বছরের ৩১ মার্চের মধ্যে অপদখলীয় ভূমি বিনিময় প্রক্রিয়া শেষ করতে চেয়েছিল ভারত। কিন্তু গত মঙ্গলবার ঢাকায় শেষ মুহূর্তের কূটনীতিতে বাংলাদেশ কোনো সময়সীমা উল্লেখ না করেই স্থলসীমান্ত চুক্তির বিষয়ে প্রটোকল স্বাক্ষর করতে ভারতকে রাজি করাতে সক্ষম হয়। আর এ প্রটোকলে ছিটমহল বিনিময়ের সময় অপদখলীয় ভূমি বিনিময়ের কথা বলা হয়েছে। এর ফলে কূটনীতিতে দৃশ্যত বাংলাদেশের জয় হয়েছে এবং ভূমি পাওয়ার আগে হারানো থেকে রক্ষা পেয়েছে। উল্লেখ্য ছিটমহল বিনিময়ের ফলে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে প্রায় ১০ হাজার একর বেশি ভূমি পাবে।

অন্যদিকে অপদখলীয় ভূমি বিনিময়ের ফলে বাংলাদেশ কিছু জায়গা হারাবে। ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, ছিটমহল ও অপদখলীয় ভূমি বিনিময়ের ফলে বাংলাদেশই লাভবান হবে। ১৯৭৪ সালের স্থলসীমান্ত চুক্তির (মুজিব-ইন্দিরা) প্রটোকল স্বাক্ষর নিয়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জটিলতা আঁচ করেছিলেন গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ব্যক্তিরা। প্রথমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের একান্ত বৈঠকের পর তাঁদের নেতৃত্বে দুই দেশের প্রতিনিধিদলের বৈঠক শেষেই হওয়ার কথা ছিল চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান। কিন্তু তাঁর পরিবর্তে আবারও বৈঠকে বসেন দুই প্রধানমন্ত্রী।

এ সময় তাঁদের সঙ্গে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রসচিবরা। ওই বৈঠক চলাকালে তিস্তা ও ফেনী নদীর পানিবণ্টন চুক্তির মতো স্থলসীমান্ত প্রটোকলও স্বাক্ষরিত হচ্ছে না বলেও অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণীর মধ্যে গুঞ্জন শোনা যায়। শেষ পর্যন্ত অনেকটা নাটকীয়ভাবেই ভারত স্থলসীমান্ত প্রটোকল চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে সম্মতি জানায় এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণ প্রটোকলটিতে স্বাক্ষর করেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যার ওই নাটকীয়তা সম্পর্কে জানতে চাইলে গতকাল রবিবার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক স্থলসীমান্ত প্রটোকল স্বাক্ষর নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার বর্ণনা দেন। ভারত ওই প্রটোকল স্বাক্ষরে আগ্রহী ছিল না বলে স্থানীয় সাংবাদিকরা ধারণা করলেও তিনি বলেন, ভারত ওই প্রটোকল স্বাক্ষরের ব্যাপারে আগ্রহী ছিল।

সে অনুযায়ী প্রটোকলের খসড়াও ঠিক হয়েছিল। তবে প্রটোকলে একটি সময়সীমা নিয়ে বাংলাদেশের আপত্তি ছিল। ভারত চেয়েছিল আগামী বছরের ৩১ মার্চের মধ্যে অপদখলীয় ভূমি বিনিময় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে। অথচ ছিটমহল বিনিময়ের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা রাখার প্রস্তাবে ভারত রাজি হয়নি। ওই কূটনীতিক জানান, ছিটমহল বিনিময়ের জন্য জনগণনাসহ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শেষ হওয়ার পরও ভারত বিনিময় প্রক্রিয়া সম্পন্ন শেষ করার কোনো তারিখের কথা প্রটোকলে উল্লেখ না করতে চাওয়ায় বাংলাদেশও অপদখলীয় ভূমির ক্ষেত্রে তারিখ উল্লেখ করার ব্যাপারে আপত্তি জানায়।

ওই কূটনীতিক আরো জানান, অপদখলীয় ভূমি বিনিময় হলে বাংলাদেশ যেমন কিছু ভূমি পাবে, আবার কিছু হারাবেও। তবে ছিটমহল বিনিময় হলে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ প্রায় ১০ হাজার একর বেশি ভূমি পাবে। ছিটমহল ও অপদখলীয় ভূমি বিনিময় প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে বাংলাদেশের লাভের পাল্লাই ভারী হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ভারত বাংলাদেশকে যে প্রটোকলে স্বাক্ষর করতে বলেছিল তা বাস্তবায়ন হলে আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে বাংলাদেশকে তার অপদখলীয় কিছু ভূমি ভারতকে ছেড়ে দিতে হতো। অন্যদিকে প্রত্যাশিত ছিটমহল বিনিময়ের জন্য বাংলাদেশকে কোনো সময়সীমা ছাড়াই অপেক্ষা করতে হতো।

কিন্তু শেষ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও পররাষ্ট্রসচিব মোহাম্মদ মিজারুল কায়েসের ভূমিকায় ভারত প্রটোকলে অপদখলীয় ভূমি বিনিময়ের সময়সীমা উল্লেখ করার অবস্থান বদলায়। সূত্র আরো জানায়, ওই অবস্থান বদলের বিষয়টি শেষ মুহূর্তে হওয়ায় স্বাক্ষরের জন্য তৈরি আগের নথিটির তৃতীয় পৃষ্ঠার প্রথম অনুচ্ছেদটি হাতে লিখেই সংশোধন করা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেছেন, পররাষ্ট্রসচিব মোহাম্মদ মিজারুল কায়েসই হাতে লিখে ওই অনুচ্ছেদটি সংশোধন করেন। আগে তৈরি করা নথিতে লেখা ছিল_'অপদখলীয় ভূমির সীমান্ত নকশা তৈরি ও প্রতিনিধিদের মাধ্যমে স্বাক্ষরের পর ২০১২ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে বিনিময় প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। ' তা সংশোধন করে লেখা হয়েছে_'অপদখলীয় ভূমির সীমান্ত নকশা তৈরি ও প্রতিনিধিদের মাধ্যমে স্বাক্ষরের পর ছিটমহল বিনিময় প্রক্রিয়ার পাশাপাশি ওই ভূমি বিনিময় প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।

' গত ২০ আগস্ট ভূমি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ভূমিসংক্রান্ত বিরোধ পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা সেক্টরে মোট ২৫টি অপদখলীয় ভূমিকে ঘিরে। এগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের দখলে রয়েছে সাতটি এবং ভারতের দখলে ১৮টি। পশ্চিমবঙ্গের ৯টি, ত্রিপুরার তিনটি, মেঘালয়ের ১০টি এবং আসামের একটি অপদখলীয় জমির যৌথ জরিপের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ৯টি অপদখলীয় ভূমির মধ্যে বাংলাদেশের দখলে রয়েছে দুটি, যার পরিমাণ এক হাজার ৬৯৭ দশমিক ০৪ একর। পক্ষান্তরে ভারতের দখলে রয়েছে চারটি, যার পরিমাণ এক হাজার ২৩ দশমিক ০৮ একর।

অপর তিনটি জায়গায় অপদখল নেই বলে উভয় পক্ষ (ভারত-বাংলাদেশ) সম্মত হয়েছে। ত্রিপুরা সেক্টরের তিনটি বিরোধপূর্ণ জায়গার মধ্যে দুটিতে কোনো অপদখলীয় জমি নেই বলে উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছে। অপর একটি ভারতের দখলে রয়েছে, যার পরিমাণ ১৩৮ দশমিক ৪১ একর। আসাম সেক্টরে তিনটি অপদখলীয় জমির মধ্যে একটিতে বাংলাদেশের দখলীয় জমির পরিমাণ ১৯৩ দশমিক ৮৫ একর। অপর দুটি পাল্লাথল ও নোয়াগাঁ অপদখলীয় এলাকা বাংলাদেশের দখলে থাকলেও এ জায়গা নিয়ে ভারতের আপত্তি থাকায় এখনো সেখানে যৌথ জরিপ সম্পন্ন হয়নি।

অন্যদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও পঞ্চগড় জেলায় ভারতীয় ছিটমহলের সংখ্যা ১১১টি। এসব ছিটমহলের জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৬৩ একর। পক্ষান্তরে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলায় বাংলাদেশের ছিটমহলের সংখ্যা ৫১টি। এ ছিটমহলগুলোর জমির পরিমাণ সাত হাজার ১১০ দশমিক ০২ একর। এরই মধ্যে উভয় দেশের ছিটমহলে জনগণনার কাজ শেষ হয়েছে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় ১১১টি ছিটমহলে লোকসংখ্যা ৩৭ হাজার, অন্যদিকে ভারতের ভিতরে ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহলের লোকসংখ্যা ১৪ হাজার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশের ভিতরে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহল (১৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৬৩ একর) এ দেশের সঙ্গে যোগ হবে। অন্যদিকে ভারতের ভেতরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল (সাত হাজার ১১০ দশমিক ০২ একর) ওই দেশের সঙ্গে যোগ হবে। এভাবেই ছিটমহল বিনিময় প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। ছিটমহলবাসী বাংলাদেশি বা ভারতীয়_কোনো একটি নাগরিকত্ব বেছে নিতে পারবে।

সূত্র আরো জানায়, জনগণনার সময়ই তারা জানতে পেরেছে ছিটমহলবাসীর বেশির ভাগই তাদের বর্তমান ভূখণ্ডে থাকতে চায়। অর্থাৎ তাদের ছিটমহল যে দেশের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, তারা সে দেশেরই নাগরিক হতে চায়। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, প্রয়োজনীয় প্রায় সব প্রস্তুতি শেষ করার পরও ছিটমহল বিনিময় প্রক্রিয়ার বিষয়ে কোনো সময়সীমার উল্লেখ না থাকায় ছিটমহলবাসীর প্রত্যাশাও পূরণ হয়নি। তবে অপদখলীয় ভূমি বিনিময়ের জন্য কোনো সময়সীমার ব্যাপারে রাজি না হয়ে বাংলাদেশ ভূমি পাওয়ার আগে হারানোর আশঙ্কা থেকে রক্ষা পেয়েছে। কাল সমন্বয় সভা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, গত মঙ্গল ও বুধবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের পর প্রথম সমন্বয় সভা আগামীকাল মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত হবে।

ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা উপস্থিত থাকবেন কি না জানতে চাইলে কর্মকর্তাটি বলেন, 'এটি সচিব পর্যায়ের বৈঠক। এতে উপদেষ্টারা থাকবেন না। ' এই সভায় আগামী দিনগুলোতে করণীয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তা ছাড়া স্বাক্ষরিত চুক্তি ও প্রটোকলগুলো অনুস্বাক্ষরের মাধ্যমে কার্যকরের বিষয়েও আলোচনা হতে পারে। এদিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ১০টি চুক্তি, সমঝোতা স্মারক (এমওইউ), প্রটোকল ও সংযুক্তির নথি প্রকাশ করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, ভারত গত মঙ্গলবার রাতেই তার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে নথিগুলো প্রকাশ করে। সূত্র জানায়, মনমোহন সিংয়ের সফরে তিস্তা ও ফেনী নদীর পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত না হওয়ায় এ দেশে যে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে, তা ভারতীয় প্রতিনিধিদলও বুঝতে পেরেছে। সফর সমন্বয়কারী দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের ভূমিকা নিয়েও উভয় দেশে সমালোচনা হয়েছে। শিগগিরই ওই চুক্তির ব্যাপারে আশাবাদী বাংলাদেশ এবার কূটনৈতিক চ্যানেলেই ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের ওপর গুরুত্ব দেবে বলে জানা গেছে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।