আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কোন এক মাকে

সবাই বলে, মা উষার সঙ্গে পাল্লা দেয় ! আমাদের পরিবারটা ছিল গোলগাল একটা জাম্বুরার মতো। তার এক একটি কোরকে দাদা-দাদী,চাচা-চাচি,ফুপুদের বসবাস। সব মিলিয়ে দশ-বারো জন। মাঝের শুন্যতাটুকু ভরাট করে সবগুলো কোরককে একসুত্রে গেঁথেছিলেন মা। আমি ঘুমে থাকতেই মা উঠে এঁটো বাসন-কোসন মেজে উনুন চাপায়।

সকালের চা,আমাদের স্কুলের টিফিন,বাবা-চাচ্চুদের প্রাতঃরাশ সঙ্গে অফিসের লাঞ্চ। অন্তত, চার পদের কম নয়। ঘন্টার কাঁটা আটটা ছোঁয়ার আগেই মা এসব তৈরি করে ফেলতো। হয়তো তখনই আমি চেঁচিয়ে উঠতাম-মা, জুতোর ফিতে খুঁজে পাচ্ছি না। বাবা বলে শার্টের বোতামটা।

বাথরুম থেকে মেজ চাচ্চু আওয়াজ দেয়-দিন ভিখারীর শ্যাম্পুটা চাই। দাদা কেশো গলায় -বৌমা,চা কই ? ওষধটাও দিতে ভুলে গেছ। সত্যি বৌমা, তোমার আজ-কাল কিছুই মনে থাকে না। এদিকে চাচাত ভাইয়ের হরলিকস গুলোতে মা'র ভুল হয়না। মেজ চাচি বলে রেখেছে-দুপুরের রান্নাটাও করে রাখতে।

তার শরীরটা বিশেষ ভাল যাচ্ছে না। পরিবারের হর্তা-কর্তারা সবাই পেটে তা দিয়ে বেরিয়ে যায়। কেউ জিজ্ঞেস করেনা-রাঁধুনিটির পেটে দানা-পানি, কিছু পড়েছে কিনা ? স্কুলে না গেলে আমি জানি,বেশিরভাগ দিনই মা সকালে কিছু খায় না। আগের রাতের ভাত বেঁচে গেলে খায়। মা হেসে বলে, শাস্ত্রে আছে দানা ফেলতে হয়না।

চা তৈরি শেষে দাদার জন্য তেল-রসুন গরম করে মা। বুড়োর বাত ছিল। এরপর নির্দিষ্ট সময় অন্তর কিছু ট্যাবলেট। এরই মাঝে গোয়ালিনিটা চলে আসে। তাকে বসিয়ে রেখে মা খড়িগুলো নিয়ে ছাদে শুকোতে দেয়।

কালু (হাইল্যা) একেকদিন কাঠের গুঁড়ো নিয়ে আসতো। আশে-পাশের দু্ই-তিন ঘর কৃষিজীবি পরিবারের কাছ থেকে মা প্রতিদিন গোবর নিয়ে রাখতো। কালু গুঁড়ো নিয়ে এলে মা সেই গোবর মুঠো বানিয়ে তাতে কাঠের গুঁড়ো ছড়িয়ে শুকোতে দিত। দেখতে অবিকল,বিষ্কিটের গুঁড়ো মাখা কালোজাম ! মাঝে-মধ্যে জ্বালানির টান পড়লে মা ওই ঘুঁটো পুড়িয়েই দুপুর চালিয়ে নিত। গোয়ালিনিকে বিদায় করে মাকে ছুটতে হতো কুসুম গরম তেল-রসুন নিয়ে।

উঠোনে জাকিয়ে বসা দাদার পায়ের বাড়ন্ত ব্যাথার ক্ষনিক উপশম ঘটাতে। এরই ফাঁকে বালতিতে মা কিছু কাপড়-চোপড় ভিজিয়ে রাখতো। বালতিটা দাদার কেদারা থেকে বেশি দুরে নয়। রোজ কাচাকাচি। রোজ মাজামাজি।

সংসারটা ঝকঝকে-তকতকে। কিন্তু দুপুরের খাবার খেতে মায়ের রোজ তিনটা-চারটা বেজে যায়। দাদা-দাদীকে খাইয়ে তবে মা আর চাচি খায়। খাওয়ার পর ছাদে গিয়ে কুমড়োর বড়ি দেয়া,আচারের বোয়মটা কাক আর চঁড়ুইয়ের ঠোঁট থেকে চোখে চোখে রাখা কিংবা কাঁথা সেলাই করতো মা। শীতের দিন উল বুনতো।

আমার সোয়েটারের খরচটা বেঁচে যেত। ফুরসত পেলে মা সাহিত্যের গলি-ঘুপচিতে হেঁটে বেড়াতে পছন্দ করতো। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার খুব প্রিয় লেখক। পাড়ার লাইব্রেরি থেকে মেজ চাচ্চু বই এনে দেয়। পাঁচটা নাগাদ স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে প্রতিদিনের মতো সেই ভাত-ডাল-ভাজির জঙ্গল।

অন্য কিছু করতে পার না ! যাও খাবো না। জিদ করেনা, খেয়ে যা সোনা। আমি খেলতে যাচ্ছি। মা দৌড়ে এসে আমাকে ধরে কয়েক গাল খাইয়ে তবেই ছাড়তো আর বলতো-'‌সন্ধ্যার আগেই ফিরবি। বাবা এসে দেখতে না পেলে কিন্তু মারবে।

' জামাটা ছিঁড়ে এনেছিস। তোর আজ রক্ষে নেই খোকা। দাঁড়া তোর বাবা আসুক। বাবা এসে জুতো খোলার আগেই আমার সারাদিনের কর্মকান্ডের মাশুল বুঝিয়ে দিতেন। কখনো হাতে কখনো কাঠের স্কেলটি দিয়ে।

মাকে দেখতাম শুধু ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে। তুমি সবচেয়ে খারাপ মা। বাবাকে সব বলে দাও। দাঁড়াও আজ বাবা এলে আমিও বলবো-সেদিন দাদা-দাদী ঘুমিয়ে পড়ার পর তুমি আর চাচি মিলে মুখে পান গুঁজে, বুড়ো-বুড়ির কাপর-চোপড় পড়ে ভেংচি কেটেছ। আমায় পান খেতে দাওনি।

টিফিনে রোজ রুটি খেতে আমার ভাল লাগেনা। ওরা সবাই কত কি আনে ! দুইটা টাকা দেবে ? ফনেল চাচার ভেলপুরি খাবো। আজ না, কাল দেব। রোজই এক কথা বলো। দাও, নাতো।

মাসে বড়জোর তিনবার। তাও আমি জমিয়ে রাখি। ছয় টাকা হলে বিকেলে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে কুলফি খাই। তারপর ভাল করে জিভ ধুই। নইলে বাসায় ফিরে জিভের রং দেখে তুমি টের পেলেই সর্বনাশ ! একটা ঘুড়ি কিনবো, সেই পয়সাটাও তুমি দাওনা।

ওদিকে, কেটে যাওয়া ঘুড়ি ধরলে বাবা মারে। বাবা-চাচারা সন্ধ্যায় ফিরে চা-নাস্তা করে। তুমি হেঁশেলেই থাক। আমরা ভাই-বোনেরা খাই দশটা নাগাদ। সবকিছু কিছু গুছিয়ে তোমার খেতে খেতে একটা বাজে।

আমি আর বোন আগেই ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে যখন উঠি, তখন তুমি রসুইঘরে। তুমি কখন ঘুমোও মা ! দাদার বড্ড শুচিবাই। সেদিন কালু তার গ্লাসে পানি খেয়েছিল বলে কি চড়টাই না মারলো ! আমি কাউকে বলিনি তুমি লুকিয়ে ওর বউয়ের জন্য নিজের নতুন শাড়ীটা দিয়ে দিয়েছ। আমি কাউকে বলিনি গোয়ালিনির চালের সংকট হলে তার ভরসা তুমি।

এখন আমি হাইস্কুলে। বেশ সাহস হয়েছে। তাই জীব বিজ্ঞানের ভেতর তিন গোয়েন্দা থাকে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে মাসুদ রানা। পড়ার সময় কান খাড়া করে থাকি তোমার চুড়ির আওয়াজের দিকে,কখন তুমি চলে আস।

তোমার হাতের চুড়ির আওয়াজ আমি ঠিক বুঝতে পারি। বাকি সবার থেকে ওটা আলাদা। ঠিক যেমন তোমার কাপড়ের আঁচলের গন্ধ! আমাকে কোনদিনই পড়ানোর সময় তোমার ছিল না। তুমি অবশ্য ইংরেজিও ভাল পারতে না। পড়াবে কি ! তুমি কিছুই জান না মা।

তুমি একটা অপদার্থ। ইদানিং তুমি বোনটাকে নিয়ে পরেছ। ও নাকি বড় হচ্ছে। এখন ওর সঙ্গেই সময় কাটে তোমার। দাদা-দাদী মরে গেছে।

জাম্বুরার কোরকগুলোও পট পট করে ছিঁড়েছে। সবার হাড়ি আলাদা। তবুও এখনো উষা তোমায় টেক্কা দিতে পারেনা। ঠিক চারটায় উঠে পড়ো। বলো-নামাজের জন্য ওটা নাকি অভ্যাস হয়ে গেছে।

ঠিক ঘুম ভেঙ্গে যায়। এখন অবশ্য একটু তাড়াতাড়ি শুতে যাও। কিন্তু আগেও সারাদিন যা করতে এখনও প্রায় তাই। বাবার কাছে আসার পর থেকে তুমি নতুন কিছুই করলে না মা। বোনের বিয়ে হয়ে গেছে।

ওরা চলে যাওয়ার দিন,তুমি খুব কেঁদেছিলে। আর একবার অত কাঁদতে দেখেছি তোমাকে। যেদিন বাবা মারা গেল। তারপর চাকুরীর জন্য যেদিন আমি বাড়ি ছাড়লাম। বছরে দুইবার আসতাম।

তুমি কতো রান্না করো। তোমার বিশ্বাস,বাড়ির বাইরে আমার বোধহয় ঠিক করে খাওয়া জোটে না। তোমাকে বুঝিয়ে আর পারি না। আসলে তুমি তো কিছুই জানো না মা। পড়ে আছো সেই মান্ধাতার আমলে।

এখনকার মায়েরা তাদের সন্তানকে তাদের পায়ের ওপরই বেড়ে ওঠায়। তোমার মতো আচলতলে সন্তানের চোখ ঢেকে কেউ রাখে না। তোমার জন্যই আধুনিকতার সঙ্গে আমার আলাপটা অনেক দেরিতে হয়েছে মা। কত পিছিয়ে পড়েছি আমি। সব দায় তোমার।

বউ-ছেলেপুলে নিয়ে এখন নিজের বাসায় থাকি। তুমিও থাক আমার সঙ্গে । তিতির-তিনাবদের নিয়ে সারাদিন মেতে থাক। কতবার বলেছি,একটু বাইরে যাও। দুনিয়াটা চোখ মেলে দেখ।

বোনটার ওখান থেকে কিছুদিন ঘুরে এসো। কিন্তু আমি তো আর তোমার আগে জন্ম নিতে পারিনি। তাই,ওসব বায়না উড়িয়ে দাও হেলায়। কিন্তু, তুমি তো ইন্টারনেট চালাতে জানো না মা। গ্যাসের রেগুলেটরটা পর্যন্ত এখনও লাগাতে পারোনা।

এখনো হাতেই কাচাকাচি কর তুমি। ঘুম থেকে ওঠার সময়টা শুধু পিছিয়ে গেছে এক ঘন্টা। তবুও আজও যতো রাতেই বাড়ি ফিরি না কেন, না খেয়ে খাবার আগলে বসে থাক তুমি। নয়টা বাজলেই বউকে দিয়ে ফোন করাও-কোথায় আছি। কখন ফিরছি ? শার্টটা একদিনের বেশি পড়লে নিজেই কেচে রাখ।

জুতোর ফিতেটা অবধি হারায় না আমার। একদিন আমার কপালে একটা চুমু খাবে মা ? খুব সাধ আমার। কখনো পাইনি ওটা। আমরা যে পরিবেশে বড় হয়েছি, তখন এসবের চল ছিলনা। নেশা করলে তার আমেজ থাকা পর্যন্ত, কেরামান-কাতেবিনরা নাকি দুই কাঁধ ত্যাগ করে।

প্লাবিত চোখে এখন বাড়ি ফিরি প্রায় রাতে। মদিরার গন্ধ লেপ্টে থাকে শরীরে। তখনও, খাবার আগলে আমার পথ চেয়ে সেই একজনই বসে থাকে। আমায় পিছিয়ে দেয়া মা। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।