ওই শাওন? জানালা দিয়ে বাইরে তাকা? চাঁদ দেখছিস? চরম না?
শাওন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে যেন কিছু বুঝছেনা । সারাক্ষন এটা ওটা ভাবতেই থাকে ও । তাই হঠাৎ কোন কথা বললে সাথে সাথে জবাব দিতে পারেনা । অবশ্য এটা নিয়ে একটা মজার ঘটনাও প্রচলিত আছে । ছোটবেলায় নাকি একবার মসজিদের পুকুর পাড়ের তেঁতুল গাছে ঢিল মেরে তেঁতুল পাড়তে গিয়েছিল ।
কিন্তু ঢিল তেঁতুলে না লেগে মাথায় এসে পড়ে । সেই থেকে এই অবস্থা । অবশ্য তেঁতুলের সাথে এই সম্পর্ক আমাদেরই বানানো ।
হু । চরমই তো ।
এতোক্ষণে !! তা যাবি নাকি বাইরে?
চল যাই ।
আমি আর শাওন একই রুমে থাকি মেসে । আমাদের দুনিয়া বলতে আমাদের মোবাইল,কম্পিউটার, ভার্সিটি । আর আমরা রাতে মাঝে মাঝে ঘুরতে বের হই ব্যাস এইটুকুই । যেদিন ইচ্ছে করে দুজন হাটতে বের হয়ে যাই ।
এদিক ওদিক হাটি , ক্লান্ত হয়ে রিক্সায় ঘুরি ।
আমি রেডি । চল বের হই ।
একটি প্যাকেটে করে লবন নিবো নাকি ?
নেয়াতো দরকার । রাস্তায়তো পানি ।
সারাদিনই তো হালকা বৃষ্টি হচ্ছে । অন্ধকারে জোক লেগে পরে দফারফা হয়ে যেতে পারে , বলে নিজেই শিহরে উঠি । আমরা যে বাসায় থাকি তার সামনের রাস্তা একটু বৃষ্টিতেই ডুবে যায় । আর রাস্তার সেই পানিতে কিলবিল করে জোক । কোন দিকে পানিতে আড়োলন টের পেলেই ওদিকে ছুটে আসে জোক ।
------------------------------------------------------------------
মানুষ না ভেবে থাকতে পারেনা । আমাদের বর্তমান আলোচ্য বিষয় জোক । জোক নিয়ে এটা ওটা বলতেছি আর হাসতেছি আমরা । হঠাৎ শাওন গম্ভীর হয়ে যায় ।
কিরে কি হইছে?
শাওন বলে , ধর এটা আমাদের পৃথিবী ।
বলে দুহাতে পৃথিবী বানালো । আর এইটুকু হচ্ছে বাংলাদেশ । একটা অংশের দিকে ইঙ্গিত করল । আর এই এইটুকু বাংলাদেশ জুড়ে শুধু জোক আর জোক ।
এইবার আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম ।
আমার নাম শূণ্য । নামটি আমার জন্য ১০০% সার্থক । আমার মাঝে এমন কিছু নাই যেটিকে পূর্ণ বলা যাবে । তবে শাওন এর মাঝে আছে । ও সূর্যের মত নানান আলোতে পূর্ণ ।
তাই মাঝে মাঝে ওর জটিল কথা আমি বুঝতে পারিনা । এখনও পারছিনা ।
শাওন বলল, দেখ আমাদের দেশে দূর্নীতিবাজদের কোন অভাব নাই । এদের সাথে যোগ হয়েছে নানা দেশ । সবাই মিলে আমাদের এইটুকু বাংলাদেশকে জোকের মত শুষে যাচ্ছে ।
যদি কোন লবন দিয়ে জোকের মত এদের আমাদের দেশ থেকে খসানো যেত !!
শুনে আমিও দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম । আসলেই খসানোর উপায় জানা নেই ।
চল রিক্সায় উঠি ।
কই যাবি রিক্সায় ?
এমনিতেই ঘুরিনা । নোয়াখালিতে রিক্সার যা ভাড়া ।
কোন বিবেচনা নাই । ১০ টাকার ভাড়া ২০ টাকা এখানে । পারলে আরো বেশি রাখে ।
আরে চল ঘন্টায় ভাড়া নিই । তাহলে কম পড়বে ।
এরা ঘন্টায় ভাড়া কমই রাখে ।
এইযে ভাই যাবেন?
কই যাইবেন?
আপনার যেখানে ইচ্ছে । ঘন্টা হিসেবে ।
না ভাই ঘন্টায় যামু না , আমি বাজারের দিকে যামু । আর এদিক আসুম না ।
কি আর করা । এদেশে যানবাহনেরও কোন নিয়ম নাই । ক্যাব, সিএনজি তে লিখা থাকে ভাড়ায় চালিত,মিটারে চালিত । একেতো বাড়তি ভাড়া চায়,তার উপর তাদের যেদিক ইচ্ছে ওদিকেই যায় । যাত্রী রোগী হয়ে মরে যেতে থাকলেও তাদের কিছু যায় আসেনা ।
সব যায়গায় সিস্টেম লস ।
শূণ্য চল ওই চাচারে জিজ্ঞেস করি । চাচা যেতে পারে ।
চাচা যাবেন? আমরা ঘন্টায় যাব । আপনি যেদিক খুশি যেতে পারেন ।
এক ঘন্টার মাঝে আবার আমদের এখানে নামিয়ে দিতে হবে । সব একসাথে বলে বসলাম ।
যামু । তয় ৭০ টেয়া লাগব ।
৫০ টাকা দিবো ।
যাবেন?
চাচা কি ভাবলো কে জানে । একটু পরে বললো উঠেন । আমরা উঠে গেলাম ।
--------------------------------------------------------------------------
রিক্সা চলা শুরু করল । সে সাথে শুরু হল শাওন এর ফিলোসফি ।
এই দেশ আর কখনোও ঠিক হবেনা । দিন দিন দেশটি রসাতলে যাচ্ছে । এভাবে চললে এক সময় আমরা আমাদের সার্বভৌমত্ত্ব হারাবো ।
কেন ? এমন হবে কেন? দেশের তো উন্নতি হচ্ছে । বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ছে, গ্যাস উত্তোলনের হার বাড়ছে , আমারা 3G ,4G তে উন্নিত হচ্ছি ।
দেশে ল্যাপটপ আসতেছে । বাইরের দেশের সাথেতো দিন দিন নতুন চুক্তি হচ্ছে । তাইনা ? বললাম আমি ।
হ্যাঁ তাই । কিন্তু এর মাঝে কোনটি আমাদের বলতো ? গ্যাস আমাদের, প্রযুক্তি আমাদের না ।
বিদ্যুৎ উৎপন্ন হচ্ছে তাও নানা চুক্তি আর নানা শর্তে । কিছু কিছু কাজ আমাদের নিজেদের মাধ্যমেও হচ্ছে । তবে তা খুবই কম । আমাদের দেশে আসলে অন্য দেশ তাদের পুজি খাটাচ্ছে । আমরা আমাদের শ্রম দিচ্ছি ,মজুরি পাচ্ছি ।
কিন্তু লাভের বিশাল অংশ চলে যায় দেশের বাইরে । দেশের মোবাইল কোম্পানি টেলিটক লস প্রজেক্টে আছে । আমি বুঝিনা যেখানে অন্য কোম্পানি বছরে হাজার কোটি টাকা লাভ করে সেখানে সরকারি কোম্পানি এর লস কেন?? ব্যবস্থাপনা দায়ী না দূর্নীতি ???
তার উপর আমাদের দেশে এখন বিশাল জনসংখ্যা । এত জনসংখ্যা অথচ এর তুলনায় সম্পদ অনেক কম । ১৬ কোটি লোক আমাদের ।
আয়তনে উন্নত দেশসমূহ থেকে আমাদের দেশ ছোট কিন্তু লোকসংখ্যা বেশি । এত লোকসংখ্যা নিয়ে দেশের সার্বিক উন্নতি অনেক কষ্টসাধ্য । তার উপর সম্পদের কোন সুষ্ঠূ ব্যবহার নেই । দেশে মানুষরুপে থাকা ওইসব জোকেরা সব শুষে খাচ্ছে । ---বলেই যাচ্ছে শাওন ।
আমার মাথা নাড়া ছাড়া কিছু করার নেই । কম্পিউটার ঘাটঘাটি করা আর মোবাইলে চ্যাট করা ছাড়া তেমন কিছুই আমি করিনা । তাই তার এসব কথাবার্তার বেশিরভাগই আমার চিন্তা,বোধগম্যের বাইরে । কখনো এসব শুনতেও চাইনা । তবে আজ কেন জানি শুনতে ইচ্ছে করছে ।
কোথায় জানি একটা অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে ।
শাওন তোর কথাগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ । দেশের লোকজন যদি বুঝতো তবে অনেক উপকার হতো । আমি বুঝে কি আর করব ?
কিছু করতে হবেনা । তুই একটু বুঝলি ।
আর একদিন আর একজন একটু বুঝবে । এমনতো না যে আমি সব ঠিক বলি । একজন এক একটি ব্যাপারে জানলে সচেতন হলে তবে যদি দেশের কিছু হয় । স্বাধীনতার পরে আমাদের একটি বিরাট সুযোগ ছিল । তখন লোকসংখ্যা মাত্র ছিল ৭ কোটি ।
তখন যদি ভালোভাবে পরিকল্পনা নেয়া হত,শক্ত ভাবে কেউ হাল ধরতে পারত , আমাদের স্বাধীনতার মহান ব্যক্তিগণ যদি যথাযথ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারতেন তাহলে আজ আমরা সিঙ্গাপুর , মালয়েশিয়ার মত উন্নত থাকতাম ।
কিন্তু এখন লোকসংখ্যাও অনেক বেশি । তার উপর দেশের সিস্টেম তাই এমন যে সব যায়গায় দূর্নীতি । তুই না চাইলেও নানা ফাঁকতালে পড়ে যাবি । প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি থেকে শুরু করে মৃত লাশ নিয়েও আজ দূর্নীতি ।
হাসপাতালে রোগী মারা যাওয়ার পরেও জীবিত বলে নানাভাবে টাকা খসানো হয় এখনও ।
স্বাধীনতার পরে মানুষের একটা জোস ছিল । এই জোস দিয়ে অনেক কিছু করা যেত । এখন দরকার উপযুক্ত নেতৃত্ব । যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পারবেন ।
উন্নতির দিকে জাতিকে এগিয়ে নিতে পারবেন ।
ঠিক বলছিস দোস্ত । কিসের জন্য মানুষ যুদ্ধ করল, আর কি পেল !!!
আব্বাজান একটু কতা কই ??
আমি আর শাওন দুজনেই চমকে উঠলাম । আমরা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমরা রিক্সায় ছিলাম । বাইরে তাকিয়ে দেখি বৃষ্টি শুরু হয়েছে ফোটাফোটা ।
আর আমরাও বাসার দিকে চলছি ।
জি চাচা বলুন কি বলবেন ।
আপনেরা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলায় কইতাছি । হে সময় আমার বয়স আছিল ২০ এর মত । রক্ত গরম আছিল ।
যুদ্ধের কথা হুইনা যোগ দিছিলাম মুক্তিবাহিনীতে । রাজশাহীতে পাঠাইয়া দিছিল ট্রেইনিং করার লাইগা । ১৫ দিনে শিখাইছে গুলি চালান,মাইন, বোমা মারন । এরপর আবার আইছিলাম নোয়াখালি । সেক্টর কমন্ডারের কতামতে কয়েকজন মিইলা নদীর ব্রীজ উরাইছিলাম বোমা মাইরা ।
ওই ব্রীজ দিয়া আইত পাকিস্তানী জোয়ানরা ।
কি বলেন চাচা !!!!! আমাদের চোখ কপালে উঠে গেল । চিৎকার করে বলাম আপনি মুক্তিযুদ্ধা ??
চাচা নির্লিপ্ত । আমাদের দিকে পিছন ফিরে তাকালেন । অন্ধকারে তার চোখ মুখ ঠিকমত বুঝে উঠতে পারলামনা ।
তবে কেমন জানি একটা শীতলতা ।
বলতে লাগলেন, অল্পের জন্য একবার বাঁইচা গেছি । ধরা খাইয়া গেছিলাম । সৈন্যরা আওনের খবর পাইয়া ভাগছিলাম । আমাগো গ্রামের মাতবর খবর দিয়া দিছিল ।
শাওন জিজ্ঞেস করল আপনি রিক্সা চালান যে ? সরকারতো মুক্তিযুদ্ধাদের জন্য অনেক কিছু করতেছে ?আপনার সার্টিফিকেট নাই ?
চাচার কন্ঠে হঠাৎ করে ক্রোধ ফুটে উঠল । কি ওইব সার্টিফিকেট দিয়া ? আমাগো ওই মাতবরেরও সার্টিফিকেট আছে । সে ওহন বীর মুক্তিযুদ্ধা ।
সোনার বাংলার লাইগা যুদ্ধ করছিলাম । বাংলারে ওহন কয়লা বানাই দিছে ।
মাতবরের পোলা চেয়ারম্যান অইছে । আর আমি চালাই রিক্সা !!
বলতে বলতে আমরা প্রায় বাসার দিকে চলে আসছি । আর রিক্সা যাবেনা । সামনে রাস্তায় পানি আর ভাঙ্গা । হালকা বৃষ্টিও হচ্ছে ।
মনে হচ্ছে তুমুল বৃষ্টি আসবে । রাত প্রায় ১০টা বাজে ।
ভাড়া মিটিয়ে চাচাকে বললাম চাচা একটু দাড়ান আপনার একটা ছবি তুলি । পকেটে বাবার টাকায় কেনা দামি মোবাইল আছে । অন্ধকারে ছবি তোলা যায় ফ্লাশ দিয়ে ।
কিন্তু আজ তুলতে পারলাম না , হঠাৎ তুমুল বৃষ্টি শুরু হওয়াতে । চাচা চলে যাচ্ছেন । অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে তার মুখ । আমরা একটি বাসার সামনে দাড়ালাম বৃষ্টি থেকে বাচঁতে । কানে চাচার কথাগুলো বাজছে ।
চাচার শেষ কথা সারা দেশ আঁন্ধারে ডুইবা যাইতাছে, আমার মুখে আলো দিয়া ছবি তুইলা কি ওইব ?? লাগবোনা ছবি তোলন ।
একটু পরে বৃষ্টি কমলে বাসার দিকে পা বাড়ালাম । সামনে রাস্তায় হাটু পর্যন্ত পানি আর পানিতে কিলবিলে জোক !!!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।