যখন কারো কোনো দায়িত্ব যা পালন করতে সে বাধ্য অথচ করে না অতিরিক্ত কোনো লাভ ছাড়া তখন ঐ লাভকে আমরা ঘুষ বলে থাকি। যেমন কোনো কর্মকর্তার কাজ যদি হয় সীমান্তের ওপার থেকে কোনো বৈধ জিনিস এপারে আসার অনুমতি দান আর তা যদি করতে সে গড়িমসি করে কিন্তু টেবিলের নিচ দিয়ে অথবা গোপনে কয়েকটি নোট দিয়ে দিলে সহজেই অনুমোদন পাওয়া যায় তবে অবৈধ এ সহজ প্রক্রিয়াটিই ঘুষ। আমাদের শিক্ষকদের কাজ হলো শিক্ষার্থীদের ক্লাসে উপযুক্ত শিক্ষাদান আর চিকিত্সকদের রোগীদেরকে উন্নত সেবা প্রদান। অথচ শিক্ষক সে কাজটি ক্লাসে না করিয়ে যদি বাসা-বাড়ি বা কোচিং-এ করান অতিরিক্ত টাকার বিনিময়ে আর চিকিত্সক পার্সোনাল চেম্বারে তবে তাদের এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে ঘুষ ছাড়া আর কী বা বলা যেতে পারে?
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ যথাযথ প্রশ্নই করেছিলেন যে, একজন শিক্ষার্থী ক্লাসে যে পড়াটি বুঝতে পারে না অথচ প্রাইভেট/কোচিং-এ গেলে ঐ শিক্ষকের কাছ থেকেই দিব্যি বুঝে আসছে তার মানে কী? মানে খুবই সোজা—ওনাদের কর্তব্য পালন করাতে গেলে অতিরিক্ত কিছু ছাড়তে হবে। ক্লাসে যা দেয়া তাঁর নৈতিক দায়িত্ব ছিল তা দিতে তিনি গড়িমসি করছেন।
এমনভাবে করছেন যে শিক্ষার্থী যাতে না বোঝে। তাঁর কাছে প্রাইভেট/কোচিং-এ আসতে বাধ্য হয়। আসছেও তাই নতুবা ফেল করলে নিজেসহ পিতা-মাতা সমাজে মুখ দেখাবে কেমন করে! এই যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রী আর অসহায় পিতা-মাতাদের জিম্মি করে প্রাইভেট/কোচিং-এর নামে প্রকাশ্যে ঘুষ বাণিজ্য করে যাচ্ছে তার কি কোনোই প্রতিকার নেই? নিজেদের নৈতিক দায়িত্বটুকু যে শিক্ষকরা পালন করছেন না তাঁদের কাছ থেকে বড় ধরনের অনৈতিক আচরণ পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। যাঁরা সন্তানতুল্য ছাত্রছাত্রীদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করেন, ফেল করানোর ভয় দেখিয়ে প্রাইভেট পড়তে চাপ প্রয়োগ করেন তাঁরা শিক্ষক নামের কলঙ্ক।
শিক্ষকদের বেতন কম, সংসারে সচ্ছলতা আনার জন্য প্রাইভেট পড়ান/কোচিং করান।
এ ধারণা নিতান্তই ভুল, নয়তো একজন শিক্ষকের কয়টা প্রাইভেট পড়ানো লাগে? প্রথম শ্রেণির একজন কর্মকর্তা আর একজন সরকারি কলেজের শিক্ষক একই স্কেলে বেতন পান। ঢাকাসহ বড় বড় শহরের নামি-দামি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা অনেক বেশি বেতনও পান আবার প্রাইভেট/কোচিংও বেশি করান। ক্লাসে ফাঁকি দিয়ে নিজেরা প্রতিষ্ঠান খুলে নিয়ে ব্যাচে ব্যাচে ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে হাজার হাজার টাকা কামাচ্ছেন। যারা প্রাইভেট পড়ার সামর্থ্য রাখে না তাদের কথা একবারও ভাবেন না! এ সমস্ত শিক্ষকের বেতন বাড়িয়ে দেয়া হোক তারপরও এই কোচিং করানো তাঁরা ছাড়বেন না। কারণ এটি শুধু পেশা নয় নেশা হয়ে গেছে, টাকার নেশা।
শিক্ষকদের এ পেশা থেকে বিরত করতে পারলে অনেক শিক্ষিত বেকারের কপালে অন্তত কিছু টিউশনি জুটতো। তবে আশঙ্কামুক্ত যে হওয়া যেতো না সেটি নিশ্চিত। কারণ শিক্ষকরা তখন হয়তো ছাত্রছাত্রীদেরকে প্রেসক্রাইব করে দেবে অমুকের তমুক কোচিং সেন্টারে যেতে হবে নয়তো পাস হবে না, যেমন ডাক্তার সাহেবেরা করে থাকেন ডায়াগনোসিস করাতে পার্সেন্টেজ পাওয়ার আশায়।
আমাদের দেশের ডাক্তাররা বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার যা করেন—রোগীর অসুবিধা শোনার আগেই প্রেসক্রিপশন লেখা শেষ! চোখ বন্ধ করাও লাগে না বলে দিতে পারেন কোন্ ডায়াগনোসিস সেন্টারে গেলে কম খরচে, দ্রুত সময়ে সঠিক রিপোর্ট পাওয়া যাবে। তারপরও মানুষ অনেক টাকা খরচ করে বিদেশে যায় চিকিত্সার জন্য।
কারণ মানুষের আর বুঝতে বাকি নেই প্রেসক্রিপশনে কেন দালালের নাম লেখা থাকে, ডায়াগনোসিস সেন্টারের ঠিকানা থাকে। যদি ডাক্তার সাহেবদের দেয়া ডায়াগনোসিস সেন্টারে যথাযথই কাজ হতো, অপরিচিত রোগীদের ডায়াগনোসিস সেন্টার চেনার দুর্ভোগ লাঘব হতো তবে বিভিন্ন ডাক্তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা দেন কেন? কেন হাতের কাছে রেখে দূরে পাঠান? আবার ডায়াগনোসিস সেন্টারে মাননীয় সে ডাক্তারের নাম বললে নাকি কিছু কমেও করা যায়। মানুষ বিপদে পড়েই ডাক্তারের কাছে যায়। মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে এ ধরনের ডাকাতি করা কখনোই কাম্য নয়।
শিক্ষা এবং চিকিত্সা মানুষের মৌলিক অধিকার।
এ অধিকার দেয়া যাঁদের নৈতিক দায়িত্ব তাঁদের কর্মকাণ্ড যদি এমন অনৈতিক হয় তবে মানুষ যাবে কোথায়? যে শিক্ষক নিজে অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত তাঁর শিক্ষাদান কী হতে পারে? শিক্ষকদের দায়িত্ব কি শুধু পাস করানোর ব্যবস্থা করা নাকি মানুষের ভেতরের মানবীয় সত্তাকেও জাগ্রত করানো? এসমস্ত শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে যে ডাক্তার হচ্ছে, ব্যবসায়ী হচ্ছে, প্রশাসনে যাচ্ছে সে যে গুরুর মতোই হবে সেটিই স্বাভাবিক। তবে সবাই যে একই পথের পথিক এমন নয়। মানবতাবাদী, মানবদরদি শিক্ষক-চিকিত্সক এ সমাজে আছে বলেই সমাজ এখনো টিকে আছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।