মনে আছে--ব্ল্যাকআউট
ফিরোজ এহ্তেশাম
ভোর। দিগন্তব্যাপী ধানক্ষেত। দূরে, ক্ষেতের আইল ধরে হেঁটে যাচ্ছেন একজন বাউল। তাঁর পরনে লাল পোশাক, কাঁধে ঝোলানো শিঙা। যেতে যেতে তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন।
তারপর আকাশের দিকে মুখ করে বাজিয়ে দিলেন তাঁর শিঙা। সেই শিঙার ধ্বনি যেন ঘোষণা করে দিল দিনের এই সূচনালগ্নটিকে। আর এভাবেই, একইসাথে সূচনা ঘটল ‘ব্ল্যাকআউটে’র। ব্ল্যাকআউট-টোকন ঠাকুর রচিত ও পরিচালিত এই ডিজিটাল ফর্ম্যাটে বানানো ফিল্মটি প্রথমবার দেখানো হয় রাশিয়ান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে, দ্বিতীয়বার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। দুই কেন্দ্রেই আমি গিয়েছিলাম সিনেমাটি দেখতে।
‘ফিল্মলাইনে’ এটাই টোকনের প্রথম কাজ। টোকন তাঁর প্রথম কাজটার বাংলা নাম দিয়েছেন ‘মনে নেই’।
আমি একজন সাধারণ দর্শকমাত্র, চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ নই। ফলে সিনেমার টেকনিক্যাল বিষয়গুলো আমার অনায়ত্ব। তাই একজন সাধারণ দর্শকের দৃষ্টিকোণ থেকেই এই সিনেমা সম্পর্কে আমার অনুভূতিগুলো বলার চেষ্টা করব।
তা, ‘মনে নেই’ দেখে প্রথমেই যা আমার মনে হয়েছিল, তা মনে আছে। মনে হয়েছিলÑবাহ্, ভালোই তো! টোকনের সাহস আছে অন্যরকম কিছু করার। এমনকি সিনেমার বাণিজ্যিক দিকটির কথা ভেবেও তিনি কোথাও আপোষ করেন নাই।
সিনেমাটিতে কিছু চরিত্র তো দারুণ অভিনয় করেছে। ভালো অভিনয় এবং সিনেমার অধিকাংশ জুড়ে উপস্থিতির কারণে প্রধান চরিত্র দুটির কথা দর্শকদের মনে না থেকে উপায় নাই।
তবে ছোট্ট একটি জায়গায় অভিনয় করেও যিনি দর্শকদের মনে দাগ কেটেছেন কিংবা যাঁর অভিনয় আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে তাঁর নাম জুয়েনা ফেরদৌস মিতুল। মাদলের মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তিনি। যাকে বলে ‘পারফেক্ট পারফর্ম’, স্বল্প সময়ের ছোট্ট এই চরিত্রটিতে তা-ই করে দেখিয়েছেন তিনি। মনে হয়েছে এই চরিত্রে এর চেয়ে ভালো অভিনয় সম্ভব ছিল না। এই চরিত্রের জন্য তাঁকে নির্বাচন করাটা যথাযথ হয়েছে।
সিনেমাটির আবহ সংগীত সুন্দর, অ্যানিমেশনের কাজ প্রশংসাযোগ্য, ফুটেজের ব্যবহার বুদ্ধিদীপ্ত, সংলাপেও কৃত্রিমতা নাই। সর্বোপরি এডিটিঙে রয়েছে মুন্সিয়ানার ছোঁয়া। এসব তো গেল ইতিবাচক দিক। নেগেটিভ দিক কী কিছুই নেই? আছে। কিছু চরিত্রের অভিনয় সাবলীল মনে হয় নাই।
কোথাও কোথাও শব্দধারণের অসতর্কতার জন্য সংলাপ বুঝতে কষ্ট হয় কিংবা কষ্ট করেও বোঝা যায় না (আর হায়, ততক্ষণে সাবটাইটেলও মুছে যায়)।
ব্ল্যাকআউটে কিছু বাস্তব চরিত্রকে, যাকে বলে ডকু-ক্যারেক্টার, অবিকল হাজির করা হয়েছে- সংগীত শিল্পী কফিল আহমেদ, চিত্রশিল্পী ধ্রুব এষ, চারুকলার মাটির অলংকার বিক্রেতা দাদু মমিন আলী মৃধা দাদু, বাঁশিওয়ালা লাবু মিয়া, চা-সিগারেটের দোকানদার আজাদ... ও বিমল বাউল।
প্রথম যে দৃশ্যটি দিয়ে ‘ব্ল্যাকআউট’ ও এই লেখাটির শুরু, সেটি একটি স্বপ্নদৃশ্য। স্বপ্নটি দেখছেন একজন কবি। নাম তাঁর মাদল।
স্বপ্নে অতীতের ফেলে আসা সবুজ ভোর আর দিগন্তবিস্তৃত গ্রামের দৃশ্য দেখতে দেখতে কবির ঘুম ভাঙে বর্তমানে, দুপুর ১২টায়, ঢাকা শহরের ৭ তলা বাড়ির টপ ফ্লোরে, সংকীর্ণ এক চিলেকোঠায়। এইভাবে প্রথমেই দুটি দৃশ্যের মধ্যে কতকগুলো বৈপরীত্যের দ্বন্দ্ব ও ঐক্য দিয়েই শুরু হয় ফিল্মটি। এরপর বিছানায় শুয়ে শুয়েই বাথরুমে যেতে থাকা রুমমেট রাফিকে মাদল জিজ্ঞাসা করে, কয়টা বাজে, আজকে কী বার। তারপরই বিছানার পাশে রাখা টইটম্বুর অ্যাশট্রে উল্টে ফেলে অসর্তকতায়।
মাদলÑফ্লাশব্যাকে আটকে যাওয়া স্মৃতিকাতর, অন্তর্মুখী এক যুবক।
তার সিংহভাগ বর্তমান জুড়ে কেবল অতীত-অতীত। সে এখন কবিতা লেখে না, শুধু অতীতের জাবর কাটে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তার অতীতও ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসে। শাল্মলীর মুখও আর মনে পড়ে না। খালি ‘ব্ল্যাকআউট-ব্ল্যাকআউট’ লাগে।
রাফি চিত্রশিল্পী। তার প্রেমের সম্ভাবনা। তার ছবির মডেল মিটিকে সে কল্পনা করে। মিটি সুন্দর ও উচ্চাকাক্সক্ষী। যথারীতি একদিন সে তার রূপ নিয়ে চলে যায় দূরে, বিজ্ঞাপনের মডেল হতে, বিদেশে।
তাকে নিয়ে আঁকা ছবিগুলো রাফি কালো রংতুলিতে মুছে ফেলে, পুড়িয়ে ফেলে তার জন্য কেনা শাড়ি। তারপর দুই বন্ধু এক বিন্দুতে এসে মিলিত হয়, গলা জড়িয়ে নাচতে থাকে। শেষে বিছানায় শুয়ে পড়ে ‘কুকুর কুকুরিসম ডাকাডাকি করে’। অতি সংক্ষেপে এই হলো ব্ল্যাকআউট। একইসাথে স্মৃতিকাতরতা ও বিস্মরণ, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ, রোমান্টিক কল্পনা ও দগদগে বাস্তবতা আর ফাঁকে ফাঁকে কলবেলের হঠাৎ সচকিত করা হ্রেষাধ্বনির মতো জীবনের উদ্দমতাÑএসবের সমন্বয় ও মিথষ্ক্রিয়াই টোকন ঠাকুরের ব্ল্যাকআউট।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।