'আমার বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ'
-মুহম্মদ জাফর ইকবাল | ১৮ জুলাই ২০১৩
হুমায়ূন আহমেদ আমার বড় ভাই তাকে নিয়ে নৈর্ব্যক্তিকভাবে কিছু লেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, যেটাই লিখি তার মাঝে ব্যক্তিগত কথা চলে আসবে, আশা করছি পাঠকেরা সে জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন।
হুমায়ুন আহমেদ এই দেশের একজন বিখ্যাত মানুষ ছিল, বিখ্যাত মানুষেরা সবসময় দূরের মানুষ হয়, সাধারণ মানুষের কাছে তাদের পৌঁছানোর সুযোগ থাকে না। হুমায়ূন আহমেদ মনে হয় একমাত্র ব্যতিক্রম, কমবয়সী তরুণেরা তার বই থেকে বই পড়া শিখেছে, যুবকেরা বৃষ্টি আর জোছনাকে ভালোবাসতে শিখেছে, তরুণীরা অবলীলায় প্রেমে পড়তে শিখেছে, সাধারণ মানুষেরা তার নাটক দেখে কখনও হেসে ব্যাকুল কিংবা কেঁদে আকুল হয়েছে।
(হুমায়ূন আহমেদ কঠিন বুদ্ধিজীবীদেরও নিরাশ করেনি, সে কীভাবে অপসাহিত্য রচনা করে সাহিত্যজগৎকে দূষিত করে দিচ্ছে তাদের সেটা নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ করে দিয়েছে!) হুমায়ূন আহমেদ শুধু বিখ্যাত হয়ে শেষ করে দেয়নি সে অসম্ভব জনপ্রিয় একজন মানুষ ছিল। আমিও সেটা জানতাম কিন্তু তার জনপ্রিয়তা কত বিশাল ছিল সেটা আমি নিজেও কখনও কল্পনা করতে পারিনি।
তার পরিমাপটা পেয়েছি সে চলে যাওয়ার পর (আমি জানি এটি একধরনের ছেলেমানুষী, কিন্তু মৃত্যু কথাটি কেন জানি বলতে পারি না, লিখতে পারি না। )
....
আমি আর আমার স্ত্রী চব্বিশ ঘণ্টার নোটিসে নিউ ইয়র্কে হাজির হলাম। প্রকাশক মাজহার আমাদের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে নিয়ে গেলেন, সেখানে তার স্ত্রী শাওনের সঙ্গে দেখা হল। ওর বিছানায় নানা ধরনের যন্ত্রপাতি হুমায়ূন আহমেদকে ঘিরে রেখেছে। তাকে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।
অবস্থা একটু ভালো হলে তাকে জাগিয়ে তোলা হবে।
আমরা প্রতিদিন কাকভোরে হাসপাতালে যাই। সারাদিন সেখানে অপেক্ষা করি, গভীর রাতে ব্রুকলিনে ফিরে আসি। হুমায়ূন আহমেদকে আর জাগিয়ে তোলা হয় না। আমি এত আশা করে দেশ থেকে ছুটে এসেছি, তার হাত ধরে চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলব, অভিমানের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল– মুহূর্তে সেই দূরত্ব দূর হয়ে যাবে।
কিন্তু সেই সুযোগটা পাই না।
ইনটেনসিভ কেয়ারের ডাক্তারদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। এতদিনে তারা বিছানায় অসহায়ভাবে শুয়ে থাকা মানুষটির গুরুত্বের কথাও জেনে গেছে। তারা আমাকে বলল, “হুমায়ূন আহমেদ ঘুমিয়ে থাকলেও তারা তোমাদের কথা শুনতে পায়। তার সঙ্গে কথা বলো।
”
তাই যখন আশপাশে কেউ থাকে না তখন আমি তার সঙ্গে কথা বলি। আমি তাকে বলি– দেশের সব মানুষ, সব আপনজন তার ভালো হয়ে ওঠার জন্য দোয়া করছে। আমি তাকে মায়ের কথা বলি, ভাইবোনের কথা বলি, ছেলেমেয়ের কথা বলি। সে যখন ভালো হয়ে যাবে তখন তার এই চেতন-অচেতন রহস্যময় জগতের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে কী অসাধারণ বই লিখতে পারবে তার কথা বলি। তার কাছে সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হলেও এটা যে স্বপ্ন নয় আমি তাকে মনে করিয়ে দিই, দেশ থেকে চলে এসে এখন আমি যে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছি এটা যে সত্যি, সেটা তাকে বিশ্বাস করতে বলি।
ঘুমন্ত হুমায়ূন আহমেদ আমার কথা শুনতে পারছে কি না, সেটা জানার কোনো উপায় নেই। কিন্তু আমি বুঝতে পারি সে শুনছে। কারণ তার চোখ থেকে ফোটা ফোটা চোখের পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে। আমি অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকি। ...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।