ভালো থাকার আছে যে উপায়...... ২১ আগস্ট ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকায় গান্ধীবাদী সমাজকর্মী আন্না হাজারেকে নিয়ে লিখেছেন বুকারজয়ী লেখক, সমাজকর্মী ও কলামিস্ট অরুন্ধতি রায়। ‘আই উড রাদার নট বি আন্না’ শিরোনামের লেখাটি সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
সম্প্রতি টেলিভিশনে বিপ্লবের নাম দিয়ে আমরা যা দেখেছি তার নাম যদি বিপ্লব হয়, তবে তা হবে বেশ লজ্জা ও নির্বুদ্ধিতার পরিচয়। এই সময়ে, জন লোকপাল বিল নিয়ে আপনার মনে যে প্রশ্নই জাগুক না কেন, উত্তরগুলো নিচে দেওয়া হল: আপনি শুধু টিক চিহ্ন দিন। ক. বন্দে মাতরম খ. ভারত মাতা কি জয় গ. ইন্ডিয়া ইজ আন্না, আন্না ইজ ইন্ডিয়া ঘ. জয় হিন্দ।
যদিও সম্পূর্ণ বিপরীত ইস্যু, ধরনও বিপরীত, তবু হয়তো আপনি বলতে পারেন মাওবাদী আর জন লোকপাল বিল বিষয় দুটির মধ্যে একটা মিল আছে। আর তা হল দুটোই ভারত সরকারকে পরাস্ত করতে চায়। একদিকে, মাওবাদীরা গরিব ও আদিবাসী শ্রেণী থেকে নিজেদের সংগঠিত করছে, আর দ্বিতীয় দলটি গান্ধীবাদী। যারা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ পছন্দ করে না, যেখানে অংশগ্রহণকারীরা হলেন নাগরিক মধ্যবিত্ত।
এ বছরের এপ্রিলে আন্না হাজারে প্রথমবারের মতো দুর্নীতিবিরোধী ‘আমরণ অনশন’ শুরু করেন।
এর আগে ‘সুশীল সমাজ’ তকমা এঁটে সরকার আন্না হাজারের দলকে দুর্নীতিবিরোধী একটি নতুন বিলের খসড়া তৈরির কমিটির সভায় আমন্ত্রণ জানায়। এর কয়েক মাস পর দুর্নীতি ঠেকাতে খসড়া বিলটি সংসদে উত্থাপন করা হয়। তবে বিলটির মধ্যে কিছু সমস্যা থাকায় একে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এরপর, ১৬ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় ‘আমরণ অনশন’ শুরু করেন আন্না। তবে এবার শুরু করার আগেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
লোকপাল বিল পাশের যুদ্ধে যুক্ত হয়েছে প্রতিবাদ করার অধিকার আদায়েরও যুদ্ধ। যা গণতন্ত্র বাঁচানোরই যুদ্ধ। কয়েক ঘণ্টা পরই অবশ্য আন্নাকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি নিজেই জেল ছাড়তে অস্বীকৃতি জানান। জনসম্মুখে অনশন করার অনুমতি আদায়ের লক্ষ্যে তিহার জেল ত্যাগ না করে সেখানেই অনশন শুরু করতে চাইলেন তিনি।
তিন দিন ধরে জেলকে ঘিরেই শুরু হয় উত্তেজনা। বাইরে আন্না সমর্থক আর টিভি চ্যানেলের গাড়ির ভিড়। আন্নার ভিডিও ফুটেজ জাতীয় ও অন্য টিভি চ্যানেলে সম্প্রচারের জন্য তার সমর্থকরা নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টিত সেই জেলে ঢুকছেন, বের হচ্ছেন। দিল্লি পৌরসভার ২৫০ কর্মী, ১৫টি ট্রাক ও ছয়টি ক্রেন ঘড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সপ্তাহের ছুটিতে রামলীলা ময়দানের জমকালো প্রদর্শনীর প্রস্তুতি নিয়েই ব্যস্ত। অসংখ্য জনতা, ক্রেনে করে ওপরে সেট করে রাখা টেলিভিশন ক্যামেরা, ভারতের প্রথিতযশা ডাক্তার; সবাই প্রস্তুত আন্নার তৃতীয় দফা অনশনের জন্য।
আর টেলিভিশন উপস্থাপকরা আমাদের উদ্দেশে বলছেন, ‘কাশ্মির থেকে কঙ্কামুরি, এক ভারত’।
আন্না হাজারে যখন গান্ধীবাদের কথা বলছেন, তখন কিন্তু তার চাহিদাগুলো গান্ধীজী মতবাদের সঙ্গে যাচ্ছে না। গান্ধীবাদের ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের সঙ্গে এর বিতর্কটা হচ্ছে, দুর্নীতি দমন আইন ‘জন লোকপাল বিল’ খুবই কঠোর ও র্নিমম। যার মাধ্যমে সমাজের ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার নিচতলা থেকে উপরতলার সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তদন্তকাজ, সন্দেহ ও ফৌজদারি কার্যবিধিতে সোপর্দ করার ক্ষমতা থাকছে লোকপাল বিলের।
এই বিলের নিজের জন্য কোনও কারাগার নেই। কাজ করবে স্বাধীন এক প্রশাসন হিসাবে। ফলে এর জবাবদিহিতারও সুযোগ নেই।
এটি কাজ করুক আর নাই করুক, প্রশ্ন হলো, দুর্নীতিকে আমরা কীভাবে দেখি। দুর্নীতি কি শুধুই বে-আইনীকাজ, অর্থ নিয়ে অনিয়ম, ঘুষ খাওয়া? না-কি এটা বৈষম্যের সমাজে সামাজিক লেনদেনের একটি মাধ্যম।
উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, শপিংমল আছে এমন এক শহরের কথা। যে শহরের রাস্তায় কোনও হকার নেই। তারা সেখানে নিষিদ্ধ। এই অবস্থায়, যে মানুষগুলোর শপিংমল থেকে পণ্য ক্রয়ের ক্ষমতা নেই, যারা হকারের কাছ থেকে কেনাকাটা করে, তারা যদি হকারকে আইন অমান্য করে রাস্তায় বসতে বলে, তখন পরিস্থিতিটা কেমন হবে? ভবিষ্যতে কী সেই হকার লোকপাল প্রতিনিধিকে জবাব দেবেন? বৈষম্যের এই সমাজে এসব সমস্যা দূর করার উপায় কী? না-কি, নতুন করে লোকজন ভেদে এই আইনকে নানা ভাগে ভাগ করা হবে?
আন্নার সমর্থক আর গণমাধ্যমের আচরণ দেখে মনে হয়েছে, যদি আমরা এই অনশনকে সমর্থন না জানাই, তবে ‘প্রকৃত ভারতীয়’ নই। ২৪ ঘণ্টার সংবাদভিত্তিক চ্যানেলেগুলো দেখে মনে হয়েছে দেশে দেখানোর মতো আর কোনও সংবাদই নেই!
মনিপুর রাজ্যে এএফএসপিএ বা বিশেষ ক্ষমতা আইনের বলে সেনাদের স্রেফ সন্দেহের বশবর্তী হয়ে সাধারন মানুষদের খুন করার অনুমতি দেওয়া হয়।
তার প্রতিবাদের ইরম শর্মিলা অনশনের ডাক দিয়েছিলেন। পরে তাকে জোর করে খাওয়ানো হয়েছিল। তার সেই অনশন টিকেছিল প্রায় ১০ বছর। সেই অনশনে যারা সমর্থন জানিয়েছিল তারাও জনগণ না। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন বন্ধের দাবিতে কোদানকুলামের ১০ হাজার গ্রামবাসীও অনশন করছে।
কিন্তু তাদেরকেও জনগণ হিসেবে বিচার করা হচ্ছে না। জগস্তিংপুরে পুলিশের অত্যাচার সহ্য করে আছে তারাও জনগণ না, কিংবা কালিঙ্গানগর, নিয়ামগিরিম বাস্তার, জৈতাপুর-মানুষের যেখানেই তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে মুখর, তাদের কেউই জনগণের মধ্যে পড়ে না, তাহলে জনগণ কারা? ৭৪ বছর বয়সী সেই বৃদ্ধ যিনি জন লোকপাল বিল পাশের দাবিতে আমরণ অনশনের ঘোষণা দিয়েছেন, তার সমর্থনে যারা গিয়েছেন, তারাই কেবল জনগণ? টিভি চ্যানেলগুলো অন্তত সেরকমই করেছে। হাজারেকে তারা ১০ দিয়ে গুণ করে মিলিয়ন বলে প্রচার করেছে। টেলিভিশনগুলো বলছে ‘কোটি কণ্ঠ বলে দিয়েছে’, আর আমরাও বলছি, ‘আন্নাই ভারত’।
আসলেই তিনি কে? তিনি কি তবে নতুন কোনও দেবতা? যাকে জনগণের কণ্ঠস্বর বলা হচ্ছে? আমরা সবসময় শুনে গেছি, কিন্তু জরুরি বিষয়গুলো নিয়ে কখনোই কিছু বলিনি।
প্রতিবেশী কৃষক যখন আত্মহত্যা করেছে তখনও আমরা শুনেছি, বলিনি কিছুই। আমরা কিছুই বলিনি সিঙ্গুর নিয়ে, নন্দীগ্রাম, লালগড়, তদুপরি কৃষকের যন্ত্রণা নিয়ে আমরা কখনোই কিছু বলিনি। সেন্ট্রাল ফরেস্টে ভারতীয় সেনাদের ছড়িয়ে দেওয়ার কথা নিয়ে কেউ কিছু বলেনি। এসব প্রসঙ্গ নিয়ে তো আন্নাও কিছু বলেননি।
অথচ তিনি রাজ থ্যাকারের ‘মারাঠি মানুষ জেনোফোবিয়া’র সমর্থন দিয়েছিলেন।
২০০২ সালে মুসলিমদের ওপর অত্যাচার করে পাওয়া গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীর ‘উন্নয়ন মডেল’-এ তিনি সমর্থন দিয়েছিলেন। পরে জনগণের চাপে ওই সমর্থন তুলে নিয়েছেন। সম্ভবত আÍত্মউপলব্ধি অবিকলই আছে।
আরএসএস-এর সঙ্গে আন্নার পুরনো সম্পর্ক নিয়েও এখন আমরা জেনেছি। আমরা মুকুল শর্মার কাছেও কিছু শুনেছি, তিনি আন্নার গ্রামে পড়েছেন।
তিনি জানিয়েছেন, ২৫ বছর ধরে আন্নার গ্রাম রালেগাঁও সিদ্ধিতে ‘গ্রাম পঞ্চায়েত’ বা ‘কো-অপারেটিভ সোসাইটি’র কোনও নির্বাচন হয়নি। ‘হরিজন’ নিয়ে আন্নার মূল্যায়নও আমরা পেয়েছি। মহাত্মা গান্ধীর ইচ্ছে ছিল ‘প্রতি গ্রামে অন্তত একজন করে হলেও চামার, সুনার, কুমার এবং এরকম আরও হরিজনরা থাকবেন। তারা তাদের নিজেদের নিয়মে নিজেদের পেশা টিকিয়ে রাখবে। এভাবেই গ্রামটি স্বনির্ভরতা অর্জন করবে।
’ কিন্তু এমন কোনও বিষয় তো আন্নার গ্রামে আমরা পাই না।
‘ইয়ুথ ফর ইকুয়েলিটি’ নিয়ে টিম আন্নার এই আন্দোলন কি আপনাকে আশ্চর্য করছে না? আর এসব প্রচারণায় অর্থ যোগাচ্ছে এনজিওগুলো। যাদেরকে আবার অনুদান দিচ্ছে কোকাকোলা বা লেম্যান ব্রাদার্সের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো। আন্নার কাছের লোক অরবিন্দ কেজারিওয়াল ও মনীশ শিশোদিয়ার প্রতিষ্ঠান হলো ‘কবির’। এরা গত তিন বছর ফোর্ড ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে ৪ লাখ ডলার পেয়েছে।
‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভারত’ নামের প্রচারণায় যারা অনুদান দিয়েছেন তাদের তালিকায় রয়েছে দেশটির অ্যালুমিনিয়াম কারখানার মালিক, আবাসন ব্যবসায়ী কিংবা যারা রাজনীতিকদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক রাখেন, তারা। তাদের কাউকে এখনি দুর্নীতি ও অন্যান্য অপরাধে তদন্তের মুখে দাঁড় করানো উচিত। কেন তারা আন্নার পথে চলছেন?
এখন প্রশ্ন হলো, যে দেশের ৮৩ কোটি লোক দিনে ২০ রুপি দিয়ে কায়ক্লেশে দিন কাটাচ্ছে, সেই পরিস্থিতিতে শুধু কিছু নীতিকে শক্তিশালী করে কি তাদের উপকৃত করা সম্ভব? যে নীতিগুলো দেশকে ক্রমে ঠেলে দিচ্ছে গৃহযুদ্ধের দিকে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।