আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটগল্প-ভুল

ইন্দ্রানী। অতিরিক্ত ছিপছিপে শরীরের অধিকারী। দেখে বুঝার উপায় নেই যে, জীনের একুশ-টি ফাগুণ পার করেছে । বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বাংলার খুঁটিনাটি জানতে জানতে দু'টি বছর পার করেছে। পরাশুনাই তার ধ্যান-ঞ্জান।

গত দুইটি বছর সে পার করেছে ক্লাস এ ফার্স্ট হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। একবার ও সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি দেখে তৃতীয় বছরটিতে সে এবার সংকল্পবদ্ধ, যে করেই হোক ফার্স্ট সে হবেই। ইন্দ্রানীর সাথে তাদের-ই ক্লাসের মীম এর ভালো সম্পর্ক। ইন্দ্রানী তার মনের গুপ্ত ঘরটা বেশ ভালোভাবেই সবার কাছ থেকে আড়াল রেখেছে। শুধুমাত্র মীম ই মনে হয় ওই ঘরের কিছুটা খবর জানে।

ইন্দ্রানী যখন তার সংকল্প পূরণে বইয়ের পাতায় তার দৃষ্টিসীমা বেঁধে রেখেছে, মীম তখন সুমন এর সাথে কবে তার শুভ-দৃষ্টি হবে সে ভাবনায় মগ্ন। সুমন তাদের ই ক্লাসের একটু বাউন্ডুলে টাইপ ছেলে। সৃষ্টিকর্তার অদ্ভুত নিয়মে এই বাউন্ডুলে টাইপ ছেলে-গুলোই মেয়েদের পরম আরাধ্য হয়ে যায়। মীম এর সুপ্ত বাসনার কথা ইন্দ্রানীর অগোচর। সহপাঠী স্বরুপ মীম আর সুমনের কথা-বার্তা হয়ই।

ইন্দ্রাণীকে মীম প্রায় প্রায় ই সুমন এর কথা বলত। সুমন নাকি মীম কে বলেছে,”আচ্ছা ইন্দ্রানীর কি পড়াশুনা ছাড়া আর কোন কাজ নেই?সারাদিন শুধু পড়াশুনা আর পড়াশুনা। মানুষের তো একটু গল্প-গুজব ও করতে মন চায়। ও একটা আস্তা নিরামিষ“ ইন্দ্রানী এই কথা শুনে একটু রেগে গিয়ে বলেছিল “তো কি করব? ওর মত সারাদিন টো টো করে ঘুরব নাকি? বাপ-মায়ের কুলাঙ্গার ছেলে। উপার্জন করে কাওকে চালানোর মুরোদ ওর নেই”।

ইন্দ্রাণীর এই কথায় মীম একটু দুঃখই পেলো। সে কোনমতেই এই কথা সুমনের কাছে গোপণ রাখতে পারলনা। সুমন ইন্দ্রানীর তার সম্পর্কে বলা কথাগুলো শোনার পর কোণ প্রতিক্রিয়ায় দেখালোনা যদিও মনে মনে সে কিছুটা আঘাত পেলো। এইদিকে মীম মনে মনে ভাবলো, সুমন কত বুদ্ধিমান। ইন্দ্রাণীর এই কথা শুনার পর গায়েই মাখলনা।

ইন্দ্রাণীর কাছে সুমন আর তার মধ্যে কি পার্থক্য তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার জন্য সে উপায় খুজতে লাগল। একদিন কথাচ্ছলে বললো, “জানিস ইন্দ্রাণী সুমনকে যদি তার সম্পর্কে কোন খারাপ কথা বলা হয়, তাহলে সে গায়ে ই মাখেনা। অথচ তুই বা আমি হলে কথার পিঠে আর একটা কথা না বলে পারিনা। “ ইন্দ্রাণী প্রত্যুত্তরে বললো, এসব সব লোক দেখানো, ভিতরে ভিতরে সে ঠিক ই রাগে জ্বলে। সুমন এর মহানুভবতা সম্পর্কে মীম যতই প্রমাণ দিতে যায় ইন্দ্রাণী কিছু না কিছু বলে তা ধূলিসাৎ করে দেয় আর মীম আবার দ্বিগুণ উৎসাহে আরো আরো প্রমাণ হাজির করে দেয়।

প্রথম প্রথম সুমনকে ইন্দ্রাণীর অসহ্য লাগতো কিন্তু দিন যেতে না যেতে আর মীম এর মুখে সুমন এর নানা গল্প শুনতে শুনতে সুমনকে তার ভালোই লাগতে শুরু করলো। কিন্তু এই কথা মীমকে জানতে দেয়া যায় কিভাবে? সেও সুমনের প্রতি তার নেগেটিভ কথা-বার্তা অব্যাহত রাখলো। এইদিকে মীম এর সাথে সুমন এর বেশ ভালোই বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। অনলাইনে তারা ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতে লাগলো। আর মীম ও তার চ্যাট বৃত্তান্ত প্রতিদিন এসে ইন্দ্রাণীকে সবিস্তারে বলতে লাগলো।

সুমনের প্রশংসার পঞ্চমুখ মীম একদিন ইন্দ্রাণীকে এসে বললো,তুই যদিও সুমনকে দেখতে পারিসনা। অথচ সুমন তোকে কত ভালো বলে। বলে, মেয়েটা চাইলেই কত ছেলে-বন্ধু ওর জুটে যেতো। কি সুন্দর দু’টা চোখ। দেখ ও অন্য ছেলেদের মতো না বলেই একটা মেয়ের সামনে অন্য একটা মেয়ের প্রশংসা এত সহজে করলো।

অন্যদিনের মতো ইন্দ্রাণী কোন উত্তর দাঁড় করাতে পারলোনা। শুধু মৃদু স্বরে বললো, “আমি তো এমনই”। আর মনের ভিতর লক্ষ্য লক্ষ্য বার ঘুরপাক খেতে লাগলো মীম এর বলা সে একটা কথা,”কি সুন্দর দু’টা চোখ”…। পরের দিন ক্লাসে সুমনের সাথে ইন্দ্রাণীর দৃষ্টি বিনিময় হয়ে গেলো। একবার না বেশ কয়েকবার।

তার পরের দিন ও এক ই ঘটনা। তার পরের দিন, তার পরের দিন...এভাবে অনেক দিন। এদিকে সুমনের প্রতি মীম এর যে অন্যরকম দুর্বলতা তা জানা ইন্দ্রাণীর বাকি রইলনা। তবুও ইন্দ্রাণীর দৃষ্টিসীমা আজকাল বইয়ের বাইরেও সুমনের দিকে প্রসারিত হলো। তার পড়াশুনার প্রতি এতদিনের মনোযোগ যেন ধীরে ধীরে কমে আসতে লাগলো সুমনকে আরো জানবার দিকে মনোযোগ বাড়ার জন্য।

একদিন সুমন ইন্দ্রাণীকে এসে বললো-“জামিল স্যার এর লেকচার টা তোমার কাছে আছে? আমি একটু ফটোকপি করব”। ইন্দ্রাণীর ঘরে গিয়ে শুধুই মনে হতে লাগলো সুমন তো অন্য কারো কাছ থেকেই এটা নিতে পারতো। আমার কাছ থেকে চাইলো কেন? ও কি আমার সাথে কথা বলতে চায়”? তিনদিন পার হলেও সুমন ইন্দ্রাণীকে লেকচার ফেরত দিলনা। ইন্দ্রাণীকেই বলতে হলো,”সুমন তুমি আমার কাছে লেকচার নিয়েছিলে...ওইটা...”। সুমন বললো –“ও আচ্ছা লেকচার টা সাথেই রাখি।

দিতে ভুলে যায়”। এইভাবেই সুমন এর সাথে ইন্দ্রাণীর টুক-টাক কথা বলা শুরু। সুমনের কিছু কিছু কথাবার্তায় ইন্দ্রাণীর মনে হতে লাগলো সুমন যেন তার প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। অকারণেই তার কাছে যেন আজকাল লেকচার চায়, কথা বলতে চায়। আবার একদিন রবীন্দ্রনাথ এর “শেষের কবিতা” দিয়ে বললো তুমি তো অন্যকিছু পড়োইনা।

এইটা পড়ে দেখো। ভালো লাগবে। শেষের কবিতা ইন্দ্রাণীর এক রাতেই পড়া শেষ হয়ে গেলো। পরের দিন এসে বললো- তোমার কাছে আর কোন বই হবে? এইভাবে গল্পের বইয়ের বিনিময় এর সাথে সাথে ইন্দ্রাণীর হৃদয়টা ও যে কখন বিনিময় হয়ে গেলো ইন্দ্রাণী তা টেরই পেলনা। এক সময় ইন্দ্রাণীর মনে বিশ্বাস জন্মালো সুমন তাকেই ভালোবাসে।

ইন্দ্রাণী মনে মনে মীম এর প্রতি সমবেদনাই অনুভব করলো। বেচারী মীম যদি জানতে পারে সুমন ইন্দ্রাণীকে ভালোবাসে তাহলে অনেক কষ্ট পাবে। সুমন যেটাকে বন্ধুত্ব ভাবছে মীম হয়তো মনে মনে সেটা ভালোবাসা বলে ভুল করছে। একদিন ঝুম বৃষ্টি নামলো। ইন্দ্রাণী বসে বসে সুমনের দেয়া “নৌকাডুবি” পড়ছিল।

মীম এসে বললো, এই ইন্দ্রাণী চলনা বৃষ্টিতে ভিজি। সুমন আমাদের ডাকছে। ইন্দ্রাণী মনে মনে ভাবলো সুমন হয়তো ইন্দ্রাণীকেই ডাকছে। লজ্জা পেয়ে দু’জনের ই কথা বলেছে। ইন্দ্রাণী বললো, যা তুই যা।

আমি যাবোনারে। মীম সুমনের সাথে বৃষ্টিস্নাত হতে চলে গেলো। আর ইন্দ্রাণী মনে মনে ভাবতে লাগলো , সুমন নিশ্চয় আমি না যাওয়াতে অনেক কষ্ট পেয়েছে। থাক, আমি যে মীম এর চাইতে ও আলাদা ও সেটা বুঝতে পারবে। বৃষ্টি থেমে গেলে সুমন, মীম কাউকেই সে দেখতে পেলোনা।

দেখা পেলো পরদিন। দু’জনের ই মুখ লজ্জায় লাল। সবাই তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছে আর শুধুমাত্র বন্ধুত্বের সম্পর্কে নিজেদের আবদ্ধ না রাখার জন্য। মীম নয়, সুমন ই নাকি মীমকে কাল বৃষ্টিতে নিজের মনের কথা বলেছে। ইন্দ্রাণী বিশ্বাস ই করতে পারছিলনা, সে এতোদিন যা ভেবেছে সবই ভুল।

সুমনের সাথে তার সব ছোটোখাটো ঘটনার সে বারবার বিশ্লেষণ করতে লাগলো। এবার মনে হতে লাগলো সে নয়, তার পাশে থাকা তার থেকে অনেক সুন্দরী মীমকেই হয়তো সুমন সারাদিন দেখতো। আর ইন্দ্রাণীর বোকা চোখ সুমনের নিশানা নিজেকে ভেবে এতোদিন কি ভুলটাই না করেছে। ইন্দ্রাণীর ফার্স্ট হওয়ার সংকল্পের কথা আবার মনে পড়ে গেলো। সে আবার নতুন উদ্যম এ পড়া শুরু করলো।

কিন্তু আগের সে উদ্যম যেন কোনমতেই ফিরে আসলোনা। সুমনের বন্ধুত্ব তার কাছে অসহনীয় লাগলো। ফাইনাল পরীক্ষার দশ দিন আগে সে বুঝতে পারলো, এইবার তার ফার্স্ট হওয়া দূরে থাক নিজের স্থানটি ও ধরে রাখা ও অসম্ভব......।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।