তক ২১ জুলাই ২০১১-২২ অগস্ট ২০১১। এই এক মাস এক দিন চুরচুর করে দিয়েছে ভারতীয় ক্রিকেটকে। পয়লা নম্বরের গজদন্ত মিনার থেকে নিমজ্জিত ভারত এমন বিশ্রী ভাবে হেরেছে যে, অনেক খ্যাতি ডুবে গিয়েছে অখ্যাতিতে। অনেককে নিয়ে হাজির হয়েছে সংশয়। এক-আধ জনই কেবল ভাল নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ।
মহেন্দ্র সিংহ ধোনি: সোমবার সকালে খেলা শুরুর আগে তাঁর সঙ্গে করমর্দন করতে গিয়েছিলেন বিদেশি টিভি ভাষ্যকার। ধোনি হাঁ হাঁ করে ওঠেন। ডান হাত নয়। ডান হাত নয়। হাতের অবস্থা নাকি এমনই চোটগ্রস্ত যে, জোরে হ্যান্ডশেক করলেও অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে।
প্রশ্ন হল তা হলে সহবাগ-ইশান্তের মতো ওয়ান ডে থেকে অব্যাহতি চেয়ে দেশে ফিরছেন না কেন? চোট লুকিয়ে খেলছেন কেন? ব্যাটিং-কিপিং-অধিনায়কত্ব সবেতেই এ বার তাঁর ভাঁটার টান। এত জঘন্য ফিল্ড সাজিয়েছেন সময় সময় যে, জনমত তৈরি হয়ে গিয়েছে ইংল্যান্ড সফরে কিপারকে কোনও দেশের ক্যাপ্টেন করে পাঠানো ঠিক নয়। ব্যাটিংও খুব খারাপ। শেষ দিন ওভালে কোথায় দলের হার বাঁচাবেনএকটা বাজে স্ট্রোকে উইকেট বিসর্জন দিয়ে গিয়েছেন। তার চেয়েও জরুরি, ইংল্যান্ড সফরের ভাল ফলের জন্য কোনও মডেলই আগাম তৈরি করেননি।
যা সৌরভের আমলে হত। কুম্বলের আমলে হত। বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়া কি ধোনিকে আত্মতুষ্ট করে দিয়েছিল? প্রশ্নটা বারবার উঠে তাঁর মার্কশিটকে প্রভাবিত করেছে।
৩.৫/১০
রাহুল দ্রাবিড়: ভারতের পক্ষে ম্যান অব দ্য সিরিজ। দাপিয়ে খেলেছেন সুইং আর সিমিং পিচে।
সচিন যে ট্র্যাকে ৯১ করলেন তা তো সিরিজের সবচেয়ে নিচু বাউন্সের ছিল। ইংলিশ উইকেট ছিল প্রথম দু’টো টেস্ট। সেই দু’টোতেই সেঞ্চুরি। মোট ৪৬১ রান একটা হেরো দলের হয়ে। প্রশ্ন হল, ভারতীয় ক্রিকেটের স্বার্থে অপ্রিয় হওয়ার ঝুঁকি নিয়েও কি তিনি মহাগুরুত্বপূর্ণ কাজটা করবেন? বোর্ডকে বলবেন কি যে, টিমের সংস্কৃতি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
কোচ ডানকান ফ্লেচারকে আরও ক্ষমতা দেওয়া হোক। যাতে তিনি নতুন করে দল গড়তে পারেন।
৯.৫/১০
বীরেন্দ্র সহবাগ: সুনামের প্রতি চরম অপব্যবহার করেছেন। মাত্র ক’দিন আগেও সর্বকালের সেরা ভারতীয় ওপেনার হিসেবে গাওস্করের সঙ্গে তাঁর নামটাই উঠত। এ বারের সফর এবং গত কয়েকটা সফরে উপমহাদেশের বাইরে সহবাগের পারফরম্যান্স প্রশ্ন তুলে দিয়েছে সিমিং পিচে কোনও দিনই কি এমন ব্যাটিং ঔদ্ধত্য নিয়ে তিনি রান পেতে পারেন? নিজেকে তিনি কী করে ফিট ঘোষণা করে দিলেন তা নিয়েও প্রশ্নের বন্যা।
বিজয় মার্চেন্টের এ দেশে ভিজে পিচে রেকর্ড তুলে ধরে প্রবীণরা কেউ কেউ বলছেন, জল আর দুধে একটা সময়ে তফাত হয়েই যাবে। যা জবাব দেওয়ার সুযোগ পাওয়ার জন্য সহবাগকে অপেক্ষা করতে হবে ডিসেম্বরের অস্ট্রেলিয়া সফর পর্যন্ত।
৩/১০
গৌতম গম্ভীর: খুব খারাপ ব্যাট করেছেন। বরাবরের সাহসী ক্রিকেটার। ভগৎ সিংহ যাঁর জীবনের আদর্শ।
কিন্তু সিরিজে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে তাঁর সাহস এবং কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা নিয়ে। ২ এপ্রিল ওয়াংখেড়ের ইনিংস এখন বিস্মৃত। শেন ওয়ার্ন বলেছেন, “আমি তেন্ডুলকর বা ধোনি হলে ওর কলার চেপে বলতাম, কী এমন হয়েছে তোমার যে, অমিত মিশ্রকে তোমাকে রক্ষা করতে পাঠানো হবে? চলো ব্যাট করতে যাবে!” কেকেআর-এ তিনি যে এগারো কোটি টাকা রোজগার করেন, সেটা তুলে ধরে কোনও কোনও দৈনিক কটাক্ষ করেছে, সপ্তাহ পিছু আয়ে গম্ভীর তো ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের অনেক ফুটবলারের আগে। তা হলে এই পারফরম্যান্স কেন?
২.৫/১০
সচিন তেন্ডুলকর: নিজেকে ভীষণ ভাবে তৈরি করেছিলেন ইংল্যান্ডে এ বার সফল হওয়ার জন্য। প্রেক্ষাপট পুরো তৈরি ছিল।
তিনি তো শুধু ভারতের হয়ে ব্যাট ধরছেন না, আইসিসি-র পক্ষেও খেলছেন। তাঁর শততম সেঞ্চুরিতে ক্রিকেটেরও অসাধারণ বিজ্ঞাপন হবে। পুরো আবহটাই ছিল, এসো তোমার জন্য মণ্ডপ সাজানো। কোনও রকমে শুভদৃষ্টি করে আমাদের কৃতার্থ করো। তিনি প্রচুর নেট প্র্যাক্টিসও করেছিলেন।
কিন্তু ম্যাচ খেলেননি বলে সুইং-সিমিং উইকেটের বাস্তব পরিবেশে অনুশীলনটা হয়নি। আর সেটাই কালসর্পের মতো ঢুকে এল। এক-আধ বার অবশ্য দুর্ভাগ্যজনিত কারণেও আউট হয়েছেন। যেমন এজবাস্টনের দ্বিতীয় ইনিংস। ওভালের শেষ দিনে।
৫.৫/১০
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ধোনিকে এখন কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।
এখন নেমে তিনে
ইংল্যান্ড -১ পয়েন্ট-১২৫
দক্ষিণ আফ্রিকা-২ পয়েন্ট-১১৮
ভারত -৩ পয়েন্ট-১১৭
সুরেশ রায়না: ওভালে শেষ দিন আউট ছিলেন না। কিন্তু লর্ডসের এক ইনিংস বাদ দিলে গোটা সিরিজে বল হাতড়েছেন। প্রমাণ করেছেন তিনি উপমহাদেশে সিংহ। তার বাইরে বেড়াল।
ভারতীয় ক্রিকেটমহলে কারও কারও অভিমত হল, রায়নাকে টেস্ট ক্রিকেটে নিয়ে আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। তাঁকে ছাপ্পা মেরে রাখা হোক ওয়ান ডে বা টি-টোয়েন্টির জন্য।
২/১০
বেঙ্কট সাই লক্ষ্মণ: ব্যর্থ তো শুধু নন, প্রমাণ করে দিয়েছেন যতই তিনি কঠিন কঠিন ম্যাচ জেতান, তাঁর টেকনিক্যাল সমস্যা রয়েছে। বাউন্স যেমন সামলান, সুইং পারেন না। ইংল্যান্ডে এটা তৃতীয় সফর ছিল এবং এক বারও সেঞ্চুরি পেলেন না।
তাঁর ফ্রন্টফুটে না আসতে পারা সহাস্যে বারবার কাজে লাগিয়েছেন অ্যান্ডারসন-রা। আর তাঁকে বোধহয় হায়দরাবাদের সর্বকালের সেরা বলা যাবে না। সর্বকালের অন্যতম সেরা বলতে হবে।
৩.৫/১০
অমিত মিশ্র: অফস্পিনার তৌসিফ আমেদকে দেখিয়ে যেমন ইমরান উদ্দীপ্ত করতেন তাঁর টিমকে, সে ভাবেই অমিত মিশ্রকে দেখিয়ে ধোনি বলতে পারেন তাঁর ব্যাটসম্যানদেরএ যদি দু’টো ইনিংস এমন অনায়াসে খেলতে পারে, তোমরা পারলে না কেন? সমস্যা হল অমিতকে যে কারণে নেওয়া হয়েছিল, সেখানে তিনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ। অমিতপ্রেমীরা বলেন, ধোনি তাঁকে সাহস জোগান না কখনও।
লেগস্পিনার ক্যাপ্টেন উৎসাহ না দিলে বড় হতে পারে না। এই অভিযোগ সত্যি হলেও ৩৮ ওভারে ১৭০ রান দিয়ে বিনা উইকেটের তাতে ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে হতচ্ছাড়া বোলিং হিসেবের দিক থেকে এটা থেকে গেল বারো নম্বরে।
৪.৫/১০
ইশান্ত শর্মা: যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। লর্ডসের একটা স্পেলে ইংল্যান্ডকে ধসিয়ে দিয়েছিলেন ৬২-৫।
কিন্তু তার পর লাঞ্চ শেষ হতে কেন যে ক্যাপ্টেনকে গিয়ে বললেন না, ছন্দে আছি। বল করব। এটা ভারতীয় ক্রিকেটের চিরকালীন রহস্য হয়ে থাকবে। ধোনি জোর করেননি। আর লাঞ্চে বিশ্রাম পাওয়া তিনিও বল করতে চাননি।
ভাবা যায়?
৫/১০
শ্রীসন্থ: যেমন বিরক্তিকর, একঘেয়ে বোলিং, তার মতোই নিত্য দিনকার টুইট। এ দিন ব্রিটিশ দৈনিক তাঁর একটা টুইট দেখেছে। ‘আমি দুর্বল বলে প্রতিবাদ করি না নয়। আমি শক্তিশালী বলে সমালোচনাকে উপেক্ষা করতে পারি। ’ নীচে লিখেছে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
এমন সিমিং পিচ পেয়ে যে গোটা সিরিজে ৬১ গড় দিয়ে মাত্র আট উইকেট পায় তাঁর সম্পর্কে তো সত্যিই মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন!
২/১০
লজ্জার এক মাস
প্রথম টেস্ট: দ্বিতীয় ইনিংসে ১০৭-৬ থেকে ২৬৯ রানে ডিক্লেয়ার করার মাঝে ইংল্যান্ডের আর একটাও উইকেট পড়েনি। বোলারদের দুরবস্থায় বল হাতে ধোনিও।
দ্বিতীয় টেস্ট: ব্রডের হ্যাটট্রিকের ধাক্কায় প্রথম ইনিংসে ২১ রানে ৫ উইকেট চলে যাওয়া। জেতার জন্য ৪৭৮ তুলতে নেমে ১৫৮ রানে শেষ ধোনিরা।
তৃতীয় টেস্ট: সহবাগের ‘কিং পেয়ার’।
দু’ইনিংসেই প্রথম বলে আউট। ইশান্ত-শ্রীসন্থদের বদান্যতায় ফর্মে না থাকা কুকের ২৯৪।
চতুর্থ টেস্ট: প্রথম ইনিংসে একটা সময় ৭৯ ওভার বল করেও ভারতীয় বোলাররা উইকেটহীন। হোয়াইটওয়াশ বাঁচানোর দিনে ৭ রানে ৫ উইকেট হারানো।
পুনশ্চ: বিশ্বের সবচেয়ে গ্ল্যামারাস ব্যাটিং লাইন আপের আট ইনিংসে সর্বোচ্চ স্কোর ৩০০।
সিরিজে সর্বোচ্চ গড় দ্রাবিড়ের (৭৬.৮৩)। প্রথম ছয় ব্যাটসম্যানের মধ্যে দ্বিতীয় সেরা তেন্ডুলকর (৩৪.১২)।
চার টেস্টে ইংল্যান্ড অলআউট হয়েছে মাত্র দু’বার। ভারত আটে আট বারই।
আর পি সিংহ: ওভালে আর পি-র যা পারফরম্যান্স কিছু না লিখেটিখে এক মিনিট মৌন পালন করা উচিত।
শুধু প্রশ্নটা থাকবে মৌনতা কার উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত হবে? তিনি, না তাঁর ক্যাপ্টেন? যে ক্যাপ্টেন তাঁকে মায়ামি বিচ থেকে সরাসরি উড়িয়ে আনলেন ক্রিকেট ম্যাচ জেতাতে? টেস্ট ক্রিকেট কি এতই সোজা যে, সব ফ্লুকে হয়ে যাবে? আর পি ওভালে ভারতের শোচনীয়তম বিজ্ঞাপন।
০/১০
কোচ ডানকান ফ্লেচার: বিশ্বক্রিকেটে ডিআরএস পদ্ধতি চালুর পিছনে তিনি অন্যতম প্রভাবশালী মুখ। অথচ তাঁর দলই কি না পূর্ণাঙ্গ ডিআরএস মানতে রাজি হয়নি। এই ইংল্যান্ড দল তাঁর হাতে গড়া। নাড়িনক্ষত্র তিনি জানেন।
কিন্তু অধিনায়ক নির্ভর দলে যদি কোচকে সিদ্ধান্ত নিতে না-ই দেওয়া হয়, তিনি কী করবেন? ভারতীয় ড্রেসিংরুমে সবচেয়ে হতাশাজনক পরিস্থিতি তাঁর। নিজের তৈরি দলের কাছে মর্যাদা-যুদ্ধে এমন ০-৪ চুনকাম হলেন। আসলে কাজ করতে দেওয়াই হচ্ছে না। কার্যত তিনি বন্দি। নামটা কেবল ভারতীয় ক্রিকেটকে ধার দিয়েছেন।
ফ্লেচারের উপযুক্ত তুলনা কে? খুব সহজ উত্তরআগ্রা দুর্গে বন্দি শাহজাহান।
মার্কশিট নেই/ তাঁকে কেউ পরীক্ষায় বসতেই দেয়নি।
লজ্জার সিরিজ (চার বা তার বেশি টেস্টে হার)
• পাঁচ টেস্টের সিরিজে ০-৪ বনাম অস্ট্রেলিয়া ১৯৪৭
• পাঁচ টেস্টের সিরিজে ০-৫ বনাম ইংল্যান্ড ১৯৫৯
• পাঁচ টেস্টের সিরিজে ০-৫ বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১৯৬১-৬২
• চার টেস্টের সিরিজে ০-৪ বনাম অস্ট্রেলিয়া ১৯৬৭-৬৮
• পাঁচ টেস্টের সিরিজে ০-৪ বনাম অস্ট্রেলিয়া ১৯৯১-৯২
http://www.anandabazar.in/23khela2.html ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।