টুকলিফাই মারাই আমাদের কাজ, চুরা ছেঁচা দেয়াই আমাদের লক্ষ্য।
ছবিতেঃ ঈদ উপলক্ষে ট্রেনের আগাম টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছে গতকাল। টিকিট কিনতে আগের দিন রাত থেকেই অনেকে অবস্থান নেন কমলাপুর রেলস্টেশনে। তাঁদের কেউ কেউ একসময় ঘুমিয়ে পড়েন। ছবিটি গতকাল ভোর সাড়ে পাঁচটায় কমলাপুর
বাড়তি চাপ নিতে প্রস্তুত নয় রেল।
বর্তমান সরকারের আড়াই বছরে সারা দেশে রেলওয়ের ৮৪টি স্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে। এ নিয়ে বন্ধ রেলস্টেশনের সংখ্যা ১২৫ সারা দেশে মোট স্টেশন ছিল ৩২৯টি। লোকবলের অভাবে এখন এক-তৃতীয়াংশের বেশি স্টেশন বন্ধ।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে রেলের সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নের কথা বলা হলেও তা করা হয়নি।
এদিকে এবার ঈদে সড়কপথের দুরবস্থার কারণে মানুষ রেলপথের দিকে ঝুঁকছে।
কিন্তু রেলওয়ে বাড়তি চাপ নিতে কতটুকু প্রস্তুত? এ প্রশ্নের উত্তরে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী ইউসুফ আলী মৃধা বলেন, ‘রাস্তাঘাটের খারাপ অবস্থার কারণে এবার ঈদে রেলের ওপর যাত্রীর বাড়তি চাপ পড়তে পারে। কিন্তু স্টেশন বন্ধসহ নানা সীমাবদ্ধতার কারণে সেই চাপ নেওয়ার ক্ষমতা এখন রেলওয়ের নেই। ’
রেলওয়ের প্রস্তুতি: ঈদের আগে-পরে মোট সাত দিন অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের জন্য সাতটি বিশেষ ট্রেন পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলওয়ে। সেই সঙ্গে নিয়মিত ট্রেনের সঙ্গে মোট ১৩৭টি বগি সংযোজন করছে। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলে তিনটি বিশেষ ট্রেন ও ৬২টি বাড়তি বগি সংযোজন এবং পশ্চিমাঞ্চলে চারটি বিশেষ ট্রেন ও ৭৫টি বাড়তি বগি সংযোজনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ঈদ উপলক্ষে এই বাড়তি ট্রেন পরিচালনায় অতিরিক্ত কোনো কোচ আমদানি করা হয়নি। কম গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি গন্তব্যের ট্রেন বাতিল করে ঈদের বিশেষ ট্রেন চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে ইঞ্জিন, কোচ ও লোকবলের স্বল্পতা আগের মতোই রয়েছে। এসব কারণে রেলের পক্ষে ঈদে ঘরমুখী যাত্রীর বাড়তি চাপ মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না।
একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন গড়ে ১৮ থেকে ২০ হাজার লোক ঢাকা থেকে ট্রেনে চড়ে।
বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থার কারণে হয়তো এই সংখ্যা ৪০-৫০ হাজার হতে পারে। সে হিসাবে ঈদের আগের তিন দিনে আমরা বড়জোর দেড় লাখ লোক নিতে পারব। কিন্তু ঈদে ঢাকা ছাড়বে ২০ থেকে ৩০ লাখ লোক। ’
রেলের হিসাবে দেখা যায়, প্রতিদিন রেলের দুই অঞ্চলে মোট ২৯৩টি ট্রেন চলাচল করে। এসব ট্রেনের স্বাভাবিক চলাচলের জন্য প্রতিদিন অন্তত ১৪৫টি ইঞ্জিন (লোকোমোটিভ) দরকার।
কিন্তু কোনো দিনই ১১০-১১২টির বেশি ইঞ্জিন পাওয়া যাচ্ছে না। পূর্বাঞ্চলে ইঞ্জিনের এবং পশ্চিমাঞ্চলে লোকবলের তীব্র সংকট রয়েছে।
রেল কর্মকর্তারা জানান, নতুন আমদানি করা চারটি ইঞ্জিন ১৫ আগস্ট চলাচল শুরু করেছে। গতকাল রোববার রংপুর থেকে ঢাকা পর্যন্ত ‘রংপুর এক্সপ্রেস’ নামের একটি নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে নতুন ইঞ্জিন দিয়ে। কিন্তু এতেও রেলে ইঞ্জিনের সংকট থেকে যাচ্ছে।
ইঞ্জিনের মতো কোচের সংকটও প্রকট। কারণ, ২০০৮ সালের পর রেলের জন্য কোনো কোচ সংগ্রহ করা হয়নি।
রেল সূত্র জানায়, রেলের মঞ্জুরিকৃত মোট জনবল ৪০ হাজার ২৬৪ জন। কিন্তু এখন কর্মরত আছেন প্রায় ২৭ হাজার। বিশেষ করে, স্টেশনমাস্টার, সহকারী স্টেশনমাস্টার, ট্রেনচালক, সহকারী চালকের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও কারিগরি পদগুলো অবসরজনিত কারণে খালি হলেও তা পূরণ করা হয়নি সময়মতো।
এ কারণে দিন দিন রেলের সংকট তীব্র হচ্ছে।
বর্তমান সুবিধায় প্রতিদিন গড়ে ট্রেনে ভ্রমণ করে সোয়া দুই লাখ থেকে আড়াই লাখ লোক। ঈদের সময় এই সংখ্যা বহু গুণ বেড়ে যায়।
লোকবলের সংকট, নিয়োগ বন্ধ: রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, একটি রেলস্টেশন সার্বক্ষণিকভাবে চালু রাখতে অন্তত তিনজন মাস্টার এবং দুই থেকে তিনজন করে পয়েন্টসম্যান দরকার। ১৯৯০ সালের পর থেকে রেলের নিয়মিত নিয়োগ বন্ধ রয়েছে।
কোনো স্টেশনমাস্টার অবসরে যাওয়ার পর শূন্য পদে কোনো নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না।
জানা যায়, স্টেশনমাস্টারের পদের সংখ্যা এক হাজার ১২১ জন। কিন্তু গত জুলাই মাস পর্যন্ত কর্মরত আছেন মাত্র ৫৮০ জন। একজন গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনমাস্টার অবসরে গেলে প্রথমে কম গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন বন্ধ করে দিয়ে সেই স্টেশনের মাস্টারকে সেখানে নেওয়া হয়।
সূত্রমতে, রেলের পশ্চিমাঞ্চলের পাকশী সেকশনের গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন ভেড়ামারা।
এখানকার দুজন মাস্টার অবসরে যাওয়ার পর অন্য দুটি স্টেশন আংশিক বন্ধ রেখে সেখান থেকে মাস্টার এনে ভেড়ামারা চালু রাখতে হয়েছে। এই স্টেশনের জ্যেষ্ঠ মাস্টার রোস্তম আলী আগামী অক্টোবরে অবসরে যাচ্ছেন। তখন আরও একটি স্টেশন বন্ধ করে দিয়ে হলেও ভেড়ামারা চালু রাখা হবে।
এ প্রসঙ্গে রেলের পাকশী সেকশনের সহকারী ট্রাফিক কর্মকর্তা একরামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে কম গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন বন্ধ রেখে গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন চালু রাখা হচ্ছে। এ নিয়ে প্রতি মাসে আমরা উচ্চপর্যায়ে চিঠি দিচ্ছি।
কিন্তু পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। ’
রেল কর্তৃপক্ষ নতুন নিয়োগের কোনো ব্যবস্থা না করে স্টেশনমাস্টারের জন্য দৈনিক চার ঘণ্টা করে অতিরিক্ত সময় (ওটি) কাজ করাচ্ছে। অনেক সময় বাড়তি পরিশ্রমের কারণে তাঁদের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
যমুনা নদীর উত্তর পাশের জেলাগুলোকে রেলের পশ্চিমাঞ্চল এবং দক্ষিণ পাড়ের জেলাগুলোকে পূর্বাঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
স্টেশন বেশি বন্ধ হয় এ সরকারের আমলে: রেলের দুই অঞ্চলের সংশ্লিষ্ট নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, লোকবল-স্বল্পতার কারণে রেলস্টেশন বন্ধ করে দেওয়া শুরু হয় ২০০৭ সালের পর থেকে।
২০০৮ সালে স্টেশন বন্ধ হয়েছে ১৬টি। এরপর ২০০৯ সালে ২৬টি এবং ২০১০ সালে ৩৪টি স্টেশন বন্ধ করে দিতে হয়েছে। এ বছরের প্রথম ছয় মাসে (গত জুন পর্যন্ত) ২৪টি স্টেশন বন্ধ করা হয়। বছর শেষে বন্ধ স্টেশনের সংখ্যা ৪৫ ছাড়িয়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন।
মাস্টার-সংকটের কারণে গত জুন মাসে পূর্বাঞ্চলে পাঁচটি স্টেশন বন্ধ করে দিতে হয়।
এগুলো হলো: ফাজিলপুর, শর্শদি, রাজাপুর, ময়নামতি ও মাইজদীকোর্ট। পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পাকশী রেলস্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে গত ২২ মে। এই স্টেশন বন্ধের কারণে রেলের প্রথম দীর্ঘতম সেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দিয়ে ট্রেন চলাচল ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। কারণ, ট্রেন ঈশ্বরদী থেকে পাকশী হয়ে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পার হয়ে ভেড়ামারা যায়। এখন পাকশী বন্ধ হওয়ায় নিরাপদে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ অতিক্রমের জন্য কিছু ট্রেনকে হয় ভেড়ামারা অথবা ঈশ্বরদীতে অপেক্ষা করতে হবে।
রেলের পশ্চিমাঞ্চলের উপপরিবহন কর্মকর্তা সুজিত কুমার বিশ্বাস বলেন, এই রুটের হালসা ও আলমডাঙ্গা আংশিকভাবে চালু রাখা হয়েছে। এই দুই স্টেশনসহ আরও কিছু স্টেশন শিগগিরই বন্ধ করে দিতে হবে। এটা হলে ঈশ্বরদী থেকে খুলনা পর্যন্ত পণ্যবাহী ট্রেন চালানো যাবে কি না সন্দেহ।
সব ট্রেন বিলম্ব: স্টেশন বন্ধের কারণে ট্রেনের গন্তব্যে পৌঁছাতে বিলম্ব হচ্ছে। কারণ, মধ্যবর্তী কোনো স্টেশন বন্ধ থাকলে ট্রেনকে গতি কমিয়ে সতর্কতার সঙ্গে ওই স্টেশন পার হতে হয়।
এ ছাড়া বন্ধ স্টেশনের ট্রেনলাইন ঠিক আছে কি না, তার ছাড়পত্র (ক্লিয়ারেন্স) নিতে হয় আগের সচল স্টেশন থেকে। একই পথে চলাচলকারী কম গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনকে দাঁড় করিয়ে রেখে অপরটিকে চলাচলের ব্যবস্থা করতে হয় সচল স্টেশন থেকে। এসব আনুষ্ঠানিকতা সারতেও কিছু বাড়তি সময় লাগে। ফলে বন্ধ স্টেশনের কারণে ট্রেন এখন আর স্বাভাবিক গতি নিয়ে চলতে পারছে না।
বিষয়টি স্বীকার করে রেলের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক ইউসুফ আলী মৃধা বলেন, স্টেশন বন্ধের কারণে প্রতিটি ট্রেনের গন্তব্যে পৌঁছাতে দেড়-দুই ঘণ্টা থেকে আরও বেশি দেরি হচ্ছে।
কারণ, ঝুঁকি নিয়ে ট্রেন চলাচল সম্ভব নয়।
রেলের পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের আন্তনগর ট্রেন ‘সুবর্ণ এক্সপ্রেস’ গন্তব্যে পৌঁছাতে এখন সময় নিচ্ছে ছয় থেকে সাড়ে ছয় ঘণ্টা। ১৯৮৫ সালে যখন ট্রেনটি চালু করা হয়েছিল, তখন এটির গন্তব্যে পৌঁছানোর সময় ছিল পাঁচ ঘণ্টা। বন্ধ স্টেশনের কারণে ট্রেনের গতি কমাতে হয়, এ জন্য বিলম্ব হচ্ছে। সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনকে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ট্রেন বিবেচনা করা হয়।
রেলের হিসাবে, পশ্চিমাঞ্চলের লালমনিরহাট থেকে ঢাকার মধ্যে চলাচলকারী লালমনি এক্সপ্রেস নয় ঘণ্টায় গন্তব্যে পৌঁছার কথা। কিন্তু এখন সময় লাগছে ১৫-১৬ ঘণ্টা।
দিনাজপুর ও ঢাকার মধ্যে চলাচলকারী আন্তনগর ট্রেন ‘একতা এক্সপ্রেস’ ১৮-২০ ঘণ্টার আগে কোনো দিন গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছে না। কিন্তু রেলের হিসাবের খাতায় সময় লাগার কথা পৌনে ১০ ঘণ্টা।
পূর্বাঞ্চলে চট্টগ্রাম ও সিলেটের মধ্যে চলাচলকারী আন্তনগর ট্রেন পাহাড়িকা ও উদয়ন এক্সপ্রেস স্বাভাবিক সময়ের অন্তত দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা দেরিতে চলাচল করছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের আন্তনগর ট্রেন মহানগর সাত ঘণ্টার পরিবর্তে আট-নয় ঘণ্টায় এখন গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছে। সূত্র ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।