আগামীর স্বপ্নে বিভোর... বেশ ক'দিন হয়ে গেলো কিছুই লেখা হয়নি। তাই হাতটা নিশপিশ করছিলো কিছু একটা লিখতে কিন্তু লিখতে বসলে কেন জানি আলস্য ভর করে কিবোর্ডে রাখা হাতের উপর আর মাথার ভেতর, তাই শেষ অব্দি আর কিছুই লেখা হয়ে উঠেনা। রমজান মাস আসার পর থেকেই দিনের দুই তৃতীয়াংশ সময় ঘুমে ঘুমেই কেটে যায় বাকি এক তৃতীয়াংশ গোসল করা সহ অন্যান্ন কাজে খরচ করে ফেলি তাই ইফতারের পর থেকে ক্লান্তি তাড়াতেই যেন পারিনা। ফেসবুকে বসে দু চার মিনিট সময় কাটাতেও যেন ক্লান্ত হয়ে পড়ি তাই বেডে শুয়ে শুয়ে টিভির রিমোটের বাটন টিপাটিপি করি কিন্তু কোন চ্যানেলেই চোখ স্থির রাখতে পারিনা। সব টিভি চ্যানেলে ঘুরে ফিরে একই খবর, টক শোর নাম করে তেনা ছেঁড়া আর রাজনীতির কদর্য লোকগুলির কাঁদা ছোঁড়া ছুড়ি করা তবুও নিরুপায় হয়ে ইদানিং রাত হলেই টিভির সাথে সম্পর্কটা বাড়ছে।
ইদানিং বাসায় বহুত ক্যাঁচাল হচ্ছে আমাকে নিয়ে। পারিবারিক কোন সিদ্ধান্তে আমি অমত করিনি কখনো কারণ আমি জানি সম্মিলিত ভাবে পরিবার থেকে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে সেই সিদ্ধান্ত কখনোই কোন অকল্যাণ বয়ে আনবেনা। কিন্তু এবার আমার উপর যে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবার প্রচেষ্টা চলছে তাতে আমার বিন্দু মাত্রও সম্মতি নেই। বাবা আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন তার ভাব ভঙ্গিটাই এমন যেন আমার মুখ দেখাটাও নাজায়েজ। মা ত আরো এক কাঠি উপরে আমার মুখ দেখেন বটে কিন্তু মুখের উপর দু চারটা কথা না বললে যেন তিনি ঢোকও গিলতে পারেন না।
অন্য সবাই ত রীতিমত আমাকে সন্দেহের চোখে দেখা শুরু করে দিয়েছে। প্রায় সবাই-ই ফেলুদা হয়ে গেছে আমার সাথে কারো কোন বিশেষ সম্পর্ক আছে কিনা তা বের করার জন্য। আমার মোবাইলে কোন ফোন আসা মাত্রই দরজার ওপাশে পরিবারের সদস্যদের আনাগোনা টেঁর পাই। যখন তারা বুঝতে পারে আমি খুব স্বাভাবিক ভাবে কারো সাথে কথা বলছি তখন হয়তো তারা পরাজিত সৈনিকের মতো বিমর্ষ মন নিয়ে যার যার ঘরে চলে যায়। তবুও সব্বাই কানের কাছে এসে ঘ্যান ঘ্যান করে আমার মত পরিবর্তন করে তাদের সিদ্ধান্তে সম্মতি দিতে।
আমি বিরক্তিতে ফেটে পড়ি, রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে যাই, বাসার বাইরে যতক্ষণ থাকা যাবে অন্তত ততক্ষণ বাবার অগ্নিদৃষ্টি আমাকে দহন করবেনা, মায়ের ভাঙ্গা রেকর্ড থেকেও মুক্তি পাবো। রিক্সায় উঠে কিছুক্ষণ যেতেই ঠের পেলাম ওয়ালেটটা বাসায় ফেলে এসেছি, মনের মধ্যে রাজ্যের বিষাদ ভর করে আছে ঠিক তক্ষণি পরিচিত একজন হাত বাড়িয়ে রিক্সাটা থামালো। তাকে দেখেই বুঝা যায় বেশ ফুর্তিতেই আছে। কুশল বিনিময়ে জিজ্ঞাস করলেন কেমন আছি ? আমি তার হাসি মাখা মুখ খানা আমার হতাশা দিয়ে ঢাকতে চাইনি বলে রাজ্যের সব হতাশা দূরে ঠেলে মুখটাতে কিঞ্চিত নকল হাসি ফুটিয়ে বললাম ভালোই আছি। কিন্তু আমার এ ভালো থাকায় তিনি শান্তি পেলেন না, শান্তির ষোল কলা পূর্ণ করতে ফের প্রশ্ন করলেন বাসার সবাই কেমন আছেন ? আমি দ্বিতীয় বারের মতো মিথ্যাবাদী সেজে বললাম হ্যা সবাই খুব ভালোই আছেন।
তিনি তখন প্রকান্ড একটা হাসি দিয়ে ডান হাতের তর্জনীতে চাবির রিং দুলিয়ে দুলিয়ে চলে গেলেন আমার উত্তর শোনার পর।
আমাদের যাপিত সমাজ জীবনে পরিচিত দুজনের দেখা সাক্ষাতে কুশল বিনিময়ের প্রথম পর্যায়েই দুজনের মুখ থেকেই শোনা যায় "আমি ভালো আছি" কিন্তু কথার পৃষ্ঠে কথা চালাচালি হতে থাকলে দেখা যায় মন্দ থাকার বারোমাসি কিচ্ছা কাহিনীর বেড়াল থলে থেকে বের হতে থাকে অর্থাৎ কেউই ভালো নেই। কেউ শারীরিক দিক থেকে ভালো নয়, কেউ মানসিক দিক থেকে ভালো নয় আবার কেউ অর্থনৈতিক দিক থেকে ভালো নয়। আমরা ভালো থাকার যে মুখোশ পরে থাকি তা উদ্বোধনী বাক্য পর্যন্তই ঠিকে থাকে তারপর ভালো থাকার মুখোশ খসে পড়ে, সকল গোমর ফাঁস হয়ে যায় যথারীতি। আমার প্রতিবেশী এক দাদু, শরীরের মধ্যে তার অসুখের কারখানা।
সারাক্ষণ খুক খুক করে কাশেন। তার বয়সটাই অসুখ তৈরীর মূল উপাদান। প্রতিদিনই নতুন নতুন অসুখের দল দানা বাঁধছেই। লাঠিতে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে রাস্তায় বের হলে আমার সাথে প্রায়ই দেখা হয়ে যায়। তাকেও যখন প্রশ্ন করি দাদু কেমন আছেন ? তিনি তখন "ভা" বলেই "লো"-টা আর বের করতে পারেন না কাশির দাপটে।
অতঃপর বুক থেকে নিঃসৃত কফটা রাস্তার এক পাশে ফেলে দিয়ে টান টান গলায় বললেন ভালো আছি। তার প্রকাশ্য শারীরিক মন্দটাও ঢাকতে চান মিথ্যে ভালোর বুলি দিয়ে। তেমনি করে ভালো আছেন শরীফার বাপ। এই পাড়ায় শরীফার বয়েসী মেয়ে আর একটাও তাদের বাপের ঘরে নেই। সবারই বিয়ে হয়ে গেছে।
কারো কারো সন্তানও যুগের হাওয়ায় বিবাহযোগ্য হয়ে গেছে কিন্তু শরীফার কোন রফা হচ্ছেনা। অনেকেই শরীফার বাপ কলিমুদ্দিনকে আইবুড়ীর বাপ বলে আড়ালে আবডালে ডাকা ডাকি করে। তিনি এও মুখ বুঝে সহ্য করে থাকেন। অনেক কষ্টে কড়া যৌতুকের বিনিময়ে আধবুড়ো একজন বিপত্নীককে পাওয়া গেছে কন্যা সম্প্রদানের জন্য। বিয়ের আর খুব বাকি নেই হাতে গুনা দু-চারদিন আছে কিন্তু এখনো যৌতুকের টাকার যোগাড় হয়নি।
পরিচিত জনের কাছে ঋণ সাহায্য চাইতে চাইতে জিভ বের হয়ে আসা সেই কলিমুদ্দিনকেও জিজ্ঞাস করা হলো কেমন আছেন। তিনি তখন খুব সতর্কতার সাথে জিভটা মুখগহ্বরে ঢুকিয়ে মেকি একটা হাসি দিয়ে বললেন "জ্বি ভাই ভালো আছি"। আয়ের চাইতে ব্যয় যদি বেশি হয় তবে কেউই ভালো থাকার কথা নয় অথচ মুখ ফুটে কেউই বলবে না "আমি মন্দ আছি" এটা বলা যেন রীতি বিরুদ্ধ ব্যপার। বিশ্বাস না হলে আপনার পাশে থাকা এমন কাউকে ভালো আছেন কিনা প্রশ্ন করে দেখুন প্রমাণ হাতে নাতে পেয়ে যাবেন। দশ হাজার টাকা মাইনেতে চাকরি করা এক কেরানী পরিবারসুদ্ধ মার্কেটে গেছেন ঈদের কেনা কাটা করতে।
তার পাঁচ বছর বয়েসি এক মাত্র কন্যার পছন্দের একটা ড্রেস হাতে নিয়েই আৎঁকে উঠলেন ট্যাগে সাঁটানো দামটা দেখে। কেরানীদের মাথা অনেক সময় ক্যালকুলেটরের চাইতেও দ্রুত কাজ করে তাই তিনি নিমিষেই হিসেব কষে বের করে নিলেন ড্রেসটার দাম তার ২৫ দিনের বেতনের সমান। তখন তার পাঁচ বছর বয়েসি কন্যাকে মিথ্যা সান্ত্বনা দেন যে এই ড্রেসটা ভালো নয় এক ধোয়ার পরই রঙ উঠে যাবে। কিন্তু কন্যা এক রোখা সে এটা নিবেই। তাই পাল্লা দিয়ে কেরানী বাপেরও মিথ্যে বুলির ভার বাড়তে থাকে।
মিথ্যা বলছি প্রতিনিয়ত প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে। বিশেষ করে মোবাইল ফোন দেশে আসার পর থেকে মিথ্যা বলার হারটা বহুগুণে বেড়ে গেছে। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে নিজের চোখের সামনেই অনেককে বলতে শুনেছি ভাই আমি এখন ভীষণ ব্যস্ত একটা মিটিংয়ে আছি পরে কল দিয়েন। ঢাকায় থেকেও কাউকে কাউকে বলতে শুনি ভাই আমি এখন এখন বরিশালে আছি, পাঁচ ছয়দিন পর ঢাকায় ফিরবো তখন আপনার সাথে আলাপ হবে।
অতি সম্প্রতি একটা মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা সারাদেশের মানুষকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে।
টিভি সেটের সামনে বসে যখন এই দুর্ঘটনার দৃশ্যাবলী দেখছিলাম তখন নিজের চোখের জলকেও আটকাতে পারিনি। বছর কয়েক আগে ঢাকার মনিপুরি পাড়ায় জিওনিক্স নামের একটা চলচ্চিত্র সম্পাদনা প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে নাট্য নির্মাণ কর্মশালায় প্রশিক্ষণ দিতে আসা তখনকার তারেক মাসুদের সাথে আমার দেখা হয়েছিলো। কিন্তু আমার সাথে এই গুণী মানুষটির কোন পূর্ব পরিচয় ছিলনা বলে তার সাথে আমার কোন ব্যক্তিগত কুশল বিনিময় বা কোন ধরনের কথা হয়ে উঠেনি। আমি সেই ক্লাসে উপস্থিত ছিলাম জিওনিক্সের মালিক এহসানূল হাফিজ জয় ভাইয়ের বিশেষ আমন্ত্রণে। নিজের চর্ম চক্ষু দিয়ে তারেক মাসুদ নামের মেধাবী মানুষটির সাবলিল কথা বার্তা উপস্থাপনা দেখেছি।
উজ্জ্বল সেই স্মৃতি আজ আমাকে আরো বেশী করে কাঁদায়। মানিকগঞ্জের ঘিওরে এই সড়ক দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশের মানুষের মতো আমিও ঘাতক বাস ড্রাইভারকে দোষারোপ করে তার শাস্তি কামনা করি। গোয়েন্দা পুলিশের বিশেষ টিম চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স পরিবহনের ঘাতক বাসের ড্রাইভার জামির হোসেনকে মোবাইল ট্র্যাকিং করে মেহেরপুরের গাংনী থানার চৌগাছা থেকে গ্রেফতার করে ঢাকায় নিয়ে আসে। কিন্তু বিভিন্ন পত্রিকার খবর ও টিভি চ্যানেলের খরব থেকে আমি যতটা জানতে পেরেছি তাহলো দুর্ঘটনার দিন বৃষ্টি হওয়ার কারণে বাসের ড্রাইভার জামির হোসেন একটা বাসের স্বাভাবিক গতির চেয়ে কম গতিতে ৪০/৫০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। অপর দিকে তারেক মাসুদকে বহনকারী মাইক্রোটি স্বাভাবিক গতির চাইতেও বেশি গতিতে ঢাকায় ফিরে আসছিলো।
খবরে প্রকাশ মুখোমুখি সংঘর্ষে বাসের ভেতরের যাত্রীদের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। বাসটা যদি বেপরোয়া ভাবে চলতো তাহলে বাসের যাত্রীদেরও ক্ষয়ক্ষতির খবর আসতো বলে আমার অনুমান। দুর্ঘটনাটা সংঘটিত হওয়ার পর গণপিঠুনির ভয়ে বাসের ড্রাইভার তার বাস নিয়ে নিরাপদে আরিচা ঘাটে পৌছে পালিয়ে যান। কোন দুর্ঘটনায় কারো হতা হতের খবর কারোরই কাম্য নয়। তিনি তারেক মাসুদের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তি হোক কিংবা অতি সাধারণ কেউ হোক।
দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ড্রাইভারকেই আমরা দোষারোপ করতে অভ্যস্থ দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে না দেখেই। তাই আমি মনে করি আগে দুর্ঘটনার কারণ উদ্ঘাটন করা হোক তারপর প্রকৃত দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হোক। কিন্তু আমার কথায় আমিই স্থির থাকতে পারিনা। গলার আওয়াজটা কয়েক গুণে বাড়িয়ে শিক্ষা বঞ্চিত এসব ড্রাইভারদের গুষ্টি উদ্ধার করি চোখ বন্ধ করে। এখানে আমি প্রকৃত সত্যের অনুসন্ধান করিনা কারণ আমি মিথ্যাবাদী।
জবরুল আলম সুমন
সিলেট।
২০শে আগষ্ট ২০১১ খৃষ্টাব্দ। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।