আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এই কথাগুলো আমাদের জন্যে

এই ব্লগের কোন লেখা আমার অনুমতি ব্যতীত কোথাও ব্যবহার না করার অনুরোধ করছি পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে, ঘুরে ঘুরে সে তার নিজস্ব নিয়মেই পূর্ণ করছে একটি বছর, সেই বছরকে আমরা কেউ গণনা করছি রোমান নিয়মে, কেউ করছি ভারতীয় নিয়মে, কেউ বা করছি আরবদের নিয়মে; সেই সূত্রে বছর ঘুরে আসছে আমাদের কাছে অনেক রকম উৎসব, আমরা সেই উৎসবগুলো পালন করছি গাঢ় আনন্দ নিয়ে, আমাদের নিরানন্দ দেশের দুঃসহ জীবনযাত্রায় সেইসব উৎসব সামান্য উচ্ছাস নিয়ে আসছে, আমরা উৎসবের দিনগুলিতে ভাসছি নিষ্পাপ ছেলেমানুষী উৎসাহে; সাধ্যমত চেষ্টা করছি উৎসবের দিনটিকে যথাসাধ্য উপভোগ করতে। আমাদের দেশের সিংহভাগ মানুষ যখন মুসলিম, তখন ঈদ আমাদের দেশে নিঃসন্দেহে একটি প্রধান উৎসব, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আমরা পালন করে থাকি ঈদের দিনটিকে, ঈদকে কেন্দ্র করে এই দেশের ঘরে ঘরে নেমে আসে মাসব্যাপী উৎসবের ছোঁয়া। দেশের বিপণিবিতানগুলোতে এই উৎসবের ছোঁয়া লাগে অন্য এক সুরে, ঝলমলে আলোকসজ্জা আর প্রচুর বাহারী উপকরণে ছেয়ে যায় ফুটপাথ থেকে প্রাসাদোপম বিপণিবিতানগুলো; আমরা হৃষ্টচিত্তে ঘুরে বেড়াই এক দোকান থেকে আরেক দোকানে, পছন্দসই নতুন জামাই শুধু নয়, অর্থনৈতিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে আমাদের বাসস্থানগুলোর বিভিন্ন অংশও নতুন করে সাজিয়ে তুলি। এই দিনে প্রচুর সুস্বাদু খাবারের সুঘ্রাণে ভরে থাকে আমাদের ছোট্ট ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের অনেকগুলো একক, আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের দিয়ে থাকে ঈদ উপলক্ষে বিশেষ অতিরিক্ত অর্থের যোগান, আমরা সেই অর্থে রঙিন করে তুলি আমাদের জীবন; হোক না সেটা কেবল এক দিনের জন্যেই, তবু আমরা সুখী হওয়ার চেষ্টা করি বছরের বাকি দিনগুলোর দুঃখকে ভুলে থাকার জন্য। আমাদের মাঝে অনেকেই আছেন, যাঁদের ঈদপূর্ব সময়ে পরিবারের সবার জন্যে নতুন জামা, একটা দিনে একটু খাবারের প্রাচুর্যের জন্য তাকিয়ে থাকতে হয় না চাকরিক্ষেত্র থেকে পাওয়া ঈদের অতিরিক্ত অর্থটুকুর দিকে; তাঁরা সারা বছরই কিনতে পারেন দেশের সবচেয়ে দামী নতুন জামাটি, ঈদ উপলক্ষে তাঁরা চলে যান দেশের বাইরে কেনাকাটা করতে, শুধু মানুষই নয়, তাঁদের ঘরের সোফাটিও ঈদ উপলক্ষে পায় নতুন কুশন, তাঁদের গাড়িটি ঠাঁই পায় পুরোনো গাড়ির দোকানে, তাঁদের গাড়ি-বারান্দায় ঠাঁই করে নেয় নতুন গাড়ি।

তাঁদের পুরো বাড়ির দেয়ালগুলো মলিন মনে হয় তাঁদের কাছে, নতুন রঙ করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে সেগুলোর, তাঁদের আধুনিক বিলাস সামগ্রীগুলোও প্রতিস্থাপিত হয়ে উঠে অত্যাধুনিক বিলাস সামগ্রী দিয়ে। তাঁদের বছরের বাকি দিনগুলোতে কষ্ট করে থাকতে হয় না, তাঁদের ভাবতে হয় না দৈনন্দিন বাজার-দর নিয়ে, তাঁরা সারা বছরই সুখী থাকেন, তাই ঈদের দিনটিতে তাঁরা এই দেশে সুখ পান না, তাঁরা ঈদটি পালন করেন বিদেশের ঝকঝকে তকতকে নয়নাভিরাম সমুদ্র সৈকতে; বাংলাদেশের ধূলো-কাদাময় পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতে তাঁরা নিরাপত্তা বোধ করেন না, সুখ বোধ করেন না। সম্পূর্ণ অন্যদিকে যদি তাকাই, ঈদে নতুন জামা দূরে থাক, একটু ভাল খাবার ভাগ্যে জুটবে কি না সন্দেহে আছেন এমন মানুষের সংখ্যাও এই দেশে কম নেই। অসংখ্য গ্রাম আছে এই দেশে, যেই গ্রামের বাতাসে ঈদের সকালে ভেসে আসে না সুস্বাদু খাবারের সুঘ্রাণ, অসংখ্য ঘর আছে যাঁদের কাছে ঈদ আনন্দবার্তা বয়ে আনতে ব্যর্থ- ঈদ যাদের কাছে হীনমন্যতা বোধের আরেক নাম। হাজারটা পরিবার পাওয়া যাবে, আগের বছরের ঈদে যেই পরিবারটি হাসিখুশি ছিল, এক বছরের ব্যবধানেই সেই পরিবারের কর্মক্ষম একমাত্র মানুষটি পৃথিবী ছেড়েছেন দেশের প্রতিটি বর্গফুট মাটিতে ওঁৎ পেতে থাকা অজস্র মৃত্যুকূপের কৃপায়; এবারে সেই পরিবারের কাছে ঈদ একটি বিপুল পরিহাস, হাস্যকর প্রলাপ।

আমরা, সমাজের সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষেরা, এইসব মানুষের গল্প পড়ি খবরের কাগজে, পড়ে দুঃখ প্রকাশ করি, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে দেই কিছুটা ক্ষোভের অনল, তারপর আবার ব্যস্ত হয়ে যাই দৈনন্দিন ব্যস্ত কর্মজীবনে; আমাদের মনুষ্যত্বের নিম্নগামীতায় আমাদের ক্ষোভের অনলও ম্রিয়মাণ, আমাদের অনল স্ফূলিঙ্গ হয়ে ওঠার আগেই ছাই হয়ে যায়, তাই আবারো ঘটতে থাকে একই ঘটনার পুনারাবৃত্তি, আমাদের দুঃখ প্রকাশ বড়জোর পরিতাপে পরিণত হয়, এর বেশি কিছু আমরা করি না, আমরা আমাদের জীবনযাত্রায় আবারো অভ্যস্থ হই; আবারো ঈদের মতো উৎসব আসে বছর ঘুরে, আমরা চক্র ভাঙার দুঃসাহস দূরে থাকুক- সদিচ্ছাটুকুও দেখাতে পারি না। চক্রানুযায়ী আবারো এসেছে ঈদ, আবারো ঝলমলে আলোকসজ্জার মাঝে আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি নতুন আনন্দের খোঁজে, আহত ফেলানির আর্তচিৎকার আটকে আছে এখনো কাঁটাতারের দেয়ালে, আমরা আমাদের বাজার সয়লাব করে ফেলছি "শিলা-কি-জাওয়ানি" জাতীয় পোষাকে, আমরা সেটাই কিনছি, ঐ পোষাকের প্রতিটি সুতোর ফাঁকে আটকে থাকা ফেলানির কালচে রক্ত আমাদের শরীর স্পর্শ করছে না, আমরা কি এতটাই বোধশক্তিহীন হয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত? আমরা তো এই দেশের সাধারণ মানুষ, আমরা বছরের বাকি দিনগুলো চেঁচামেচি করে পিঁয়াজের কেজি এক টাকা কমানো সাধারণ মানুষ, আমরা একটি দিনের আনন্দের জন্য দুঃখ পুষে রাখা সাধারণ মানুষ, আমরা কেন এতটা বোধশক্তিহীন হয়ে যাব? আমরা ঈদের ছুটিতে দল বেঁধে গ্রামের বাড়ি যাই প্রচন্ড ভীড়ের যানবাহনে, আমরা প্রায় প্রতি ঈদেই দলে দলে মারা যাই দুর্ঘটনার শিকার হয়ে, আমরা বিদেশের সৈকতে সূর্যস্নান করতে যেতে পারি না, আমাদের তরুণ প্রজন্ম একটু আনন্দ করতে আমাদের বিপদজনক সৈকতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরে, আমরা কেন বোধশক্তিহীন হয়ে যাব? ঈদ উপলক্ষে আমাদের নতুন গাড়ি আসে না বন্দর থেকে, আমরা ঈদে পর্যাপ্ত সিএনজি না পেয়ে সপরিবারে পায়ে হেঁটে ঘুরতে যাই, আমাদেরই কেউ না কেউ গণপিটুনিতে মারা যান অথবা ডাকাত সন্দেহে পুলিশের মার খেয়ে আধমরা হয়ে যান, আমরাই তো সেই সাদামাটা মধ্যবিত্ত বাঙালি, কেন আমরা এতটা বোধশক্তিহীন হয়ে বেঁচে থাকব? এবারের ঈদ আমাদের জন্যও, বরাবরের মতোই হয়তো সামান্য আনন্দের প্রয়োজনে আমরা অন্তত পরিবারের মানুষগুলোকে রঙিন করে তুলব, কিন্তু আসুন না প্রিয় পাঠক, অন্তত একবার ভাবি সেই পরিবারগুলোর কথা, যারা এই বছরটিতে আমাদের কাছে নিজের প্রাণপ্রিয় ভাই অথবা বোন অথবা বাবা অথবা মায়ের চিকিৎসার জন্যে অর্থ সাহায্য চেয়েছিলেন। আসুন না, ভাবি সেই পরিবারগুলোর কথা যাদের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তিটি মারা গেছেন আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের অক্ষমতা আর ব্যর্থতার কারণে। আসুন না একটু হাসি ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করি আলোকজ্জল বিপণিবিতানের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মলিন পোষাকের শিশুটির রূক্ষ ঠোঁটে, আসুন না একটাবার অন্তত মানুষের মতো মেতে উঠি ঈদ-উৎসবে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।