আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এক টুকরো চলন্ত ক্যাম্পাস

যখন স্কুলে পড়তাম তখন থেকেই রাস্তার নানা ধরনের যানবাহনের মধ্যে একটি বাস সবসময় আমার নজর কেড়ে নিত। বাসটির বিশেষত্ব এটি ঢা.বি.এর বাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম আঁকা আর বড় করে ‘’ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’’ লেখা লাল বাসটির গায়ে। সাঁই করে বাসটি যখন যেত, তখন মনে হতো, ইস! কবে যে এই বাসে চড়ব? হয়ত এই বাসে চড়ার স্বপ্ন থেকেই চান্স পেয়ে গেলাম ঢা.বি.তে। বিশ্ববিদ্যালোয়র টিএসসি অডিটোরিয়ামে আমাদের ওরিন্টেশন হল।

আমি সেখানেআমার বিভাগের নতুনদের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা বক্তব্য রেখেছিলাম। বক্তব্যটিতে আমি এই বাস, ঢা.বি্‌, ঢা.বিকে নিয়ে আমার স্বপ্ন এইসব নিয়ে কথা বলেছিলাম। জানি না, কেমন হয়েছিল আমার বক্তব্য। তবে মুহুর্মুহু হাততালিতে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। আমার বক্তব্য শেষে যখন বন্ধুদের সারিতে এসে বসলাম, ওরা সবাই বলল খুব নাকি ভাল হয়েছে।

কি জানি? বন্ধুরা ওমন বলেই থাকে। এদিকে স্টেজে ওন্যান্য বিভাগের নতুন বক্তারা বক্তব্য রেখেই চলছে, আর আমি সেদিকে কান না দিয়ে সমান তালে বন্ধুদের সাথে বক বক করেই যাচ্ছি। হঠাৎ শুনি, বিজ্ঞান ফ্যাকাল্টির ডিন স্যার আমার বক্তব্যের বাস সংক্রান্ত প্রসংগটি নিয়ে কথা বলছেন। বিষ্ময়ের ধাক্কাটা সামলে ভেতরে ভেতরে একটু গর্ববোধ করতে লাগলাম। পরবর্তীতে ক্যাম্পাসে অনেকেই আমাকে দেখলে বলত,’’আরে, তুমিই তো টি এস সিতে বাস নিয়ে কথা বলেছিলে।

‘’ ক্যাম্পাসে আমার তারকা (???) খ্যাতি তখন থেকেই। এরপর টানা ৮ বছর (সেশনজট এবং ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি কারণে নির্ধারিত ৫ বছরের সাথে আরো ৩ বছর) বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসেই যাতায়াত করেছি। সত্যিই এই. বাসগুলো ছিল যেন এক টুকরো একটা চলন্ত ক্যাম্পাস। এক সময় বাসের বাইরে থেকে বাসটিকে দেখতাম। এবার বাসের ভেতর থেকে দেখতে লাগ্লাম প্তহের মানুষদের কৌতুহলী দৃষ্টি।

খুব মজা লাগত তখন। ঢা.বি.এর বাসের নামগুলোও ছিল চমৎকার। কিঞ্চিৎ (আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রথম বাস, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বন্ধুদের এখান থেকেই পেয়েছিলাম । প্রচণ্ড ভীড়ের কারণে বাসটি বেশির ভাগ সময় কাত হয়ে থাকত। তাই এক বন্ধু এর নাম দিয়েছিল ‘’কাইতচিৎ।

‘’) ক্ষণিকা(মগবাজার থেকে টংগীতে চলে যাবার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকিটা সময় এই বাসে যাতায়াত করেছি। ডাবল ডেকার, লক্ক্র ঝক্কর মার্কা এই বাসেও কত বন্ধু, আর কত স্মৃতি!), আনন্দ, শ্রাবণ,ফাল্গুণী, হেমন্ত,, বৈশাখী, চৈতালী, উল্লাস, মৈত্রী, ঈশা খাঁ,তরংগ। এছাড়াও মেয়েদের হলে যাতায়াত করার জন্য দুটি ছোট মিনিবাস। বাসে যাবার সময় অনেক মজার ঘটনা ঘটত। সেসব কথা বলতে গেলে আরেকটা আরব্য রজনী লেখা হয়ে যাবে।

তবু দু’এক্টা ঘটনা বলছি। প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা। বাসে হুড়মুড় করে সবাই উঠল। প্রচণ্ড ভীড়। তখন তো আর বাসে চড়ার অভ্যস ছিল না, তাই খুব কষ্ট হচ্ছিল।

ক্যাম্পাসে পৌঁছানোর পরে দেখি দুই হাতে প্রচণ্ড ব্যাথা। ব্যাপারখানা কি? মনে পড়ল বাসের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে ঝুলে আসার কথা। এরপর থেকে কিন্তু আর কখনো হাতে ব্যথা হয়নি। বাসে তো কোন্দিন বসার সুযোগ হয়নি, এত ভীড় থাকত। এই বাসগুলোর দুটো দরজা।

সামনেরটা ছাত্রীরা আর পেছনেরটা ছাত্ররা ব্যবহার করার জন্য। প্রথম ২৫টা সিট মেয়েদের আর পেছনের ২৫টা ছেলেদের। দোতলা বাসে নিচতলায় মেয়েরা আর উপরতলায় ছেলেরা। চমৎকার সহাবস্থান। এবার ক্ষণিকা বাসের ঘটনা বলি।

বাংলাদেশে প্রথম চালু করা হলো মহাখালীর ফ্লাইওভার। এই দোতলা বাসে করেই আমরা প্রথম ফ্লাইওভারে ফ্লাই করি। সে কি উত্তেজনা! পুরোটা সময় সবাই মিলে হৈ হৈ করে চিৎকার করেছিলাম। একবার তো ফ্লাইওভারে উঠে বাসের ব্রেক ফেল হয়ে গেল। কিছুতেই বাস থামছে না।

রোলার কোস্টারের গতিতে বাস ছুটে চলছে। আমরা জীবনে যে যত রকম দোয়া দরুদ জানি সব পড়ছি। অনেক কসরত করে বাসের মামা বাস থামাতে সক্ষম হলেন স্টাফ রোড পেরিয়ে যাবার পর। ‘’যেন প্রাণ আসল ধড়ে। ‘’ নানা ধরনের বাসে চড়েছি।

এসি বাস, লোকাল বাস, ভার্সিটির বাস। তবে ভার্সিটির বাসের মত ভীড় আমি কোথাও দেখিনি। বিশেষ করে বৃহস্পতিবারের ডাউন ট্রিপে তো স্মরণকালের ভীড় হত। বাসে তিল ধারণের জায়গা নেই। তবু দেখা যাচ্ছে ১০-১২ জন এখনো উঠতে পারেনি।

আর তাদের ফেলে রেখেও আমরা কিছুতেই যাব না। একে তো ছাত্র-ছাত্রী, তার উপর আমাদের ব্যাগের বোঝা। একেকজন চারটা/পাঁচটা ব্যাগের নিচে হারিয়ে গেছে। আমাদের ব্যাগগুলো বহন করার জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক্তি বাস দেয়া দরকার ছিল। এমনও হত বাস চলতে শুরু করেছে, আমরা চিৎকার করে মামাকে বাস থামাতে বলছি।

বন্ধুকে ফেলে রেখে কিভাবে যাই?’’যদি হয় সুজন, তেঁতুল পাতায় ন’জন। ‘’ভীড় দেখে অনেকে যেতে পারত না। অবশেষে তাদের ফেলেই যেতে হত আমাদের, মন খারাপ করে। তবে কিছু কিছু বিশেষ দিনে কিন্তু বাস আশ্চর্যরকমভাবে ফাঁকা যেত। যেমনঃ ভ্যালেন্টাইনস ডে।

আমরা যারা হাঁদারাম, কপালে কিছুই জোটাতে পারিনি, মনের দুঃখ চেপে প্রায় খালি বাসে বাসায় ফিরে আসতাম। ক্যাম্পাসে বসে অন্যের সুখ দেখলেও যে হিংসে হয়! ভার্সিটির বাসে আরো একটা মজার ব্যাপার ছিল। বাসের মামারা রাস্তায় নিজেদের মহারাজা মনে করতেন। অন্য কোন যানবাহন তোয়াক্কা করতেন না। ‘’কিঞ্চিৎ’’ বাসের ডাইভার আর হেল্পার মামাদের দেখতাম প্রতিদিন রাস্তায় দামী প্রাইভেট কারগুলোতে একটু ধাক্কা দিয়ে যেত।

কারণ, মামারা জানেন, বাসভর্তি ছাত্রদের সামনে, যত বড় হোমড়া চোমড়াই হোক না কেন, তাকে গাড়ির মায়ায় মামাদের কাছে মাফ চাইতেই হবে। এই মনোভাবটা সব বাসের মামাদের মধ্যেই ছিল। পথে কোন সমস্যা হলে অন্যরা আটকে যেত। কিন্তু আমাদের বাস আটকায় এমন সাধ্য কার আছে? কখণ কোন সমস্যা হলে ছাত্ররা বিশাল ভাব নিয়ে বাস থেকে নামতে শুরু করত। যেন রাস্তার সব গাড়ি ভেঙ্গে ফেল্বে।

আস্লে কিন্তু কিছুই করবে না। আর আমরা ছাত্রীরা বাসের ভেতরে বসে এইসব কাণ্ড দেখে না হেসে পারতাম না। আমাদের বাসকে ঘিরে সাধারণ মানুষের সমীহ করাটা খুব উপভোগ করতাম সে সময়। সুন্দর দিনগুলো খুব দ্রুতই পেরিয়ে যায়। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হয়ে ক্যাম্পাসকে যতটা মিস করি, ঠিক ততটাই করি ভার্সিটির বাসকে।

আজ যখন বাসটা আমার চোখের ‘’সামনে দিয়া রঙগ কইরা চইল্লা যায়’’, আমি সেই স্কুলে পড়ার সময়ের মত একই রকম উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ি। স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। ইস! আবার যদি এই বাসে করে যেতে পারতাম! ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১০। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।