আজ দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার ৬ বছর। সিরিজ বোমা হামলা মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত ২৯ জঙ্গী সাজা মওকুফের জন্য হাইকোর্টে আপীল করেছে। এ দিনকে সামনে রেখে আগেভাগেই ঢাকাসহ সারাদেশে কঠোর নিরাপত্তার বলয় গড়ে তোলা হয়েছে। সে বছর আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হন বিচারক, আইনজীবী, পুলিশ, সরকারী-বেসরকারী কর্মকর্তাসহ ৩৩ জন। আহত হন চার শতাধিক।
অনেকে চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। শীর্ষ জঙ্গীদের ফাঁসিতে মৃত্যু হওয়ার পরও জঙ্গীরা নামে-বেনামে এখনও তৎপরতা চালাচ্ছে।
প্রসঙ্গত বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৫ সালের আজকের দিনে দেশের ৬৪ জেলার ৬৩ জেলায় (মুন্সীগঞ্জ বাদে) একযোগে সিরিজ বোমা হামলা চালায় জঙ্গী সংগঠন জেএমবি। হামলার স্থান হিসেবে হাইকোর্ট, সুপ্রীমকোর্ট, জেলা আদালত, বিমানবন্দর, বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাস, জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়, প্রেসক্লাব ও সরকারী-আধাসরকারী গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বেছে নেয় জঙ্গীরা। হামলার স্থানগুলো থেকে জেএমবির লিফলেট উদ্ধার হয়।
লিফলেটে বলা হয়, দেশে কর্মরত বিচারকদের প্রতি একটি বিশেষ বার্তা পাঠালাম। দ্রুত এদেশে ইসলামী হুকুমতো কায়েম করতে হবে। নতুবা কঠিন পথ বেছে নিতে বাধ্য হবে জেএমবি। ইসলামী হুকুমতো কায়েমের বিষয়ে তাদের সঙ্গে দেশ-বিদেশের অনেক শক্তিশালী দেশ ও শীর্ষ রাজনৈতিক দল একমত পোষণ করেছে। অতএব, যারা বিচারক আছেন তাঁরা তাগুতি আইন বাদ দিয়ে ইসলামী আইনে বিচার করবেন।
নতুবা আরও ভয়াবহ বিপদ আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। এ সর্তকবাণীর (সিরিজ বোমা হামলা) পর আমরা নির্দিষ্ট সময় পর্যনত্ম অপেক্ষা করব। তারপর আবার হামলা শুরু হবে। এরপর আবারও দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহরের আদালতগুলোতে সিরিজ বোমা হামলা করেছিল জেএমবি। তবে তা ছিল স্বল্প পরিসরে।
বোমা হামলার ঘটনায় ৩২২টি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে বোমা হামলার দিন ১৫৪টি ও পরে ১১৩টি মামলা দায়ের করা হয়। দায়েরকৃত মামলার মধ্যে ২৮৯টির চার্জশীট দেয়া হয়েছে। বিচারাধীন রয়েছে আরও ১৭৪টি এবং বিচার শেষ হয়েছে ১১৫টি মামলার। ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া হয়েছে ২৫টি মামলার।
এর মধ্যে ৩৫ জঙ্গীকে মৃত্যুদণ্ডা, ১৩১ জঙ্গীকে যাবজ্জীবন ও ১৮৪ জঙ্গীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয় আদালত। ডিএমপির ৩৩টি স্পটে বোমা হামলার ঘটনায় ১৮টি মামলা হয়। এর মধ্যে ৪টি মামলা খারিজ হয়ে যায়। ১৫৪টি মামলার মধ্যে ১৯টি এখনও তদনত্মাধীন।
শীর্ষ জঙ্গী গ্রেফতার ॥ বিভিন্ন হামলার সঙ্গে জড়িত জেএমবির আমির শায়খ আব্দুর রহমানকে ২০০৬ সালের ২ মার্চ সিলেটের পূর্ব শাপলাবাগ এলাকার সূর্যর্দীঘল বাড়ি থেকে, জেএমবির সেকেন্ড ইন কমান্ড সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাইকে ২০০৬ সালের ৬ মার্চ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থানাধীন চেচুয়া বাজারের রামপুরা গ্রাম থেকে, হুজি প্রধান মুফতি হান্নানকে ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর রাজধানীর মধ্য বাড্ডা থেকে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অপারেশনাল কমান্ডার মুফতি মঈন উদ্দিন ওরফে আবু জান্দালকে ২০০৮ সালের ১৪ ফেব্রম্নয়ারি গাজীপুরের বানিয়াচালার মেম্বারবাড়ি মসজিদ থেকে, আব্দুল আউয়াল ওরফে আদিলকে ২০০৫ সালের ১৮ নবেম্বর ঠাকুরগাঁও থেকে, জেএমবির শূরা সদস্য আতাউর রহমান ওরফে সানিকে ২০০৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর রাজধানীর তেজগাঁও ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে, জেএমবির শূরা সদস্য হাফেজ রাকিব হাসান ওরফে মাহমুদকে ২০০৬ সালের ২৮ ফেব্রম্নয়ারি জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম এলাকা থেকে, জেএমবির শূরা কমিটির সদস্য মোঃ সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিন ওরফে তৌহিদকে ২০০৬ সালের ২৫ এপ্রিল চট্টগ্রামের সিডিএ এলাকার একটি বাড়ি থেকে, জেএমবির শূরা কমিটির অপর সদস্য ফারম্নক হোসেন ওরফে খালেদ সাইফুলস্নাহ ওরফে সিরাজ ওরফে আমজাদকে ২০০৬ সালের ৪ এপ্রিল রাজধানীর ডেমরার কোণাপাড়ার ডগাইর এলাকার আইডিয়াল পাড়ের ৮ নম্বর বাড়ি থেকে, জেএমবির সামরিক কমান্ডার মোঃ মোহতাসিম বিলস্নাহ ওরফে বশিরকে ২০০৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের কোণাবাড়ি থেকে, জেএমবির বোমা বিশেষজ্ঞ জাহিদ হোসেন সুমন ওরফে বোমা মিজানকে ২০০৯ সালের রাজধানীর মিরপুর পীরেরবাগ এলাকা থেকে ও জেএমবির আইটি শাখার প্রধান বুয়েট ইঞ্জিনিয়ার মোঃ এমরানুল হক ওরফে রাজীব ওরফে মঈনুল ওরফে আবু তোবা ওরফে ইকবালকে রাজধানীর পলস্নবী এলাকা থেকে চলতি মাসের জুন মাসে গ্রেফতার করা হয়।
শীর্ষ ৬ জঙ্গীর ফাঁসি ॥ ২০০৫ সালের ১৪ নবেম্বর ঝালকাঠিতে বিচারক সোহেল আহমেদ চৌধুরী ও জগন্নাথ পাঁড়ে হত্যার ঘটনাটি সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তোলে। দুই বিচারক হত্যা মামলায় ২০০৬ সালের ২১ মার্চ মামুন, সুলতান হোসেন খান, শায়খ আব্দুর রহমান, আব্দুল আউয়াল, আতাউর রহমান সানি, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই, শাকিল আহমেদ ওরফে মোল্যা ওমর (মৃত) ও মেহেদীসহ ৮ জনকে আসামি করে চার্জশীট দাখিল করা হয়। ২০০৬ সালের ৩০ মে মামলায় রায়ে শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই, আতাউর রহমান সানি, আব্দুল আউয়াল, মাসুম, খালিদ, সাইফুল্লাহসহ মোট ৭ জনকে ফাঁসির আদেশ দেয় আদালত। ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ এদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
সিরিজ বোমা হামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত ২৯ জঙ্গীর সাজা মওকুফের আবেদন ॥ সংশিস্নষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সিরিজ বোমা হামলা মামলায় ফাঁসির দণ্ডাদেশ মওকুফ করতে হাইকোর্টে আপীল করেছে জেএমবির ২৯ জঙ্গী।
যারা আপীল করেছে তারা হলো- হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাকিব হাসান ওরফে হায়দার, নারায়ণগঞ্জের সালাউদ্দিন ওরফে সালেহীন ওরফে সজিব, নওগাঁর নিয়ামতপুরের আবদুল কাইউম, বগুড়ার শেরপুরের হাফেজ মিনহাজুর ইসলাম ওরফে সোহেল রানা ওরফে সানোয়ার হোসেন, জামালপুরের আকতারম্নজ্জামান, খুলনার তরিকুল ইসলাম ওরফে রিংকু, ঝিনাইদহের মনিরম্নল ইসলাম ওরফে মোকলেছ, নাসরম্নলস্নাহ ওরফে শানত্ম, ঝিনাইদহের রোকনুজ্জামান ওরফে সিবুন, গাইবান্ধার আবু তালেব আনছারী ওরফে বাবুল আনছারী, ঝিনাইদহের মোহন, মামুনুর রশিদ, ঝিনাইদহের মুহিদ আহম্মদ, মোজাম্মেল হক ওরফে মোজাম, তুহিন রেজা, সবুজ আলী, শৈলকুপার ফারম্নক হুসাইন, গাইবান্ধার মতিন মেহেদী ওরফে মতিনুর ইসলাম, ঝিনাইদহের মহিরম্নল আল মামুন ওরফে চাঁদ, ঝিনাইদহের বিলাল হোসেন, সাবউদ্দিন, শৈলকুপার রবজেল হোসেন, আজিজুর রহমান।
বিএনপি-জামায়াত জোটের সঙ্গে কানেকশন ॥ ২০০১ সালে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের ভয়াবহ বিসত্মার ঘটে। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত একটি ইসলামী দল ও পাশর্্ববর্তী একটি মুসলিম দেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার আর্থিক সহায়তায় মুফতি হান্নান, শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সুনামগঞ্জ জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানার পেছনে, নাইক্ষ্যংছড়ি, হিমছড়ি, বিলাইছড়ি, খাগড়াছড়ি, মানিকছড়ি, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, পটিয়া, লালখানবাজার, সিলেট ও কঙ্বাজারের উখিয়াসহ আশপাশের দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় মাদ্রাসার নামে ১৫টি ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করে। ট্রেনিংয়ের দায়িত্ব পালন করে ফাঁসিতে মৃতু্য হওয়া শীর্ষ ৬ জঙ্গী।
পুলিশ ২০০১ সালের জানুয়ারিতে চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের প্রধান ও রোহিঙ্গার সামরিক শাখার প্রধান কমান্ডার মোহাম্মদ সেলিম ওরফে সেলিম উলস্নাহকে গ্রেফতার করে।
সেলিম উলস্নাহ সেলিম বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের দু'সহোদর সাংসদের বোন জামাই। দু'সহোদরের একজন বিএনপির এবং অপরজন জামায়াতের সাংসদ ছিলেন। এ দুই সাংসদ সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের মাধ্যমে সেলিম উলস্নাহকে মুক্ত করে দেন। প্রসঙ্গত সেলিম মোহাম্মদ আরাকানের অধিবাসী। সেলিমের সঙ্গে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাকারী হুজি নেতা কারাবন্দী মুফতি হান্নান, মুফতি মাওলানা আব্দুস সালাম, আবু জান্দাল, মোরসালিন ও মুত্তাকিনসহ ভারত ও পাকিসত্মানের শীর্ষ জঙ্গী নেতাদের যোগাযোগ ছিল।
হুজি ও জেএমবি সেলিম মোহাম্মদের কাছ থেকে অস্ত্রও সংগ্রহ করত। দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলা ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় কঙ্বাজারের উখিয়ার জঙ্গী ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে প্রশিৰণপ্রাপ্ত অনত্মত ২০ জঙ্গী অংশ নিয়েছিল।
র্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার এম সোহায়েল বলেন, সিরিজ বোমা হামলার দিনকে সামনে রেখে সারাদেশে কঠোর নিরাপত্তার বলয় গড়ে তোলা হয়েছে। জেএমবিসহ অন্য জঙ্গী সংগঠনগুলো যাতে পুনরায় মাথাচাড়া দিতে না পারে সেই জন্য র্যাবের প্রতিটি ব্যাটালিয়ন ও গোয়েন্দারা তৎপর রয়েছে। আত্মগোপনে থাকা জঙ্গীদের ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে।
[/sb
Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।