আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দি ভার্জিন কুইন

“আমি নিরালায় একা খুজেঁ ফিরি তারে, ‍স্বপ্নবিলাসী, কল্পনাপ্রবণ আমার আমিরে.........” (১) ইতিহাস আমার খুব প্রিয় একটা বিষয়। ডাক্তারি করতে করতে একসময় যখন হাপিয়ে উঠি তখন ইতিহাসের সুধা পান করতে অসম্ভব ভালো লাগে। ইতিহাসের মজার মজার জিনিস পড়তে পড়তে নিজের অজান্তেই চমতকৃ্ত হই। এই যেমন ধরুন না, আমরা জানি রোমান ইতিহাসে রিপাবলিককে রক্ষার জন্য জুলিয়াস সিজারকে সিনেটে হত্যার পিছনে সবচেয়ে বেশি যার অবদান ছিলো সে হলো ব্রুটাস, সিজার যাকে পুত্রসম মনে করতো। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই ঘটনার প্রায় পাঁচশত বছর পূর্বে রোমুলাস ও রেমাস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রোম নগরীর শেষ রাজা টারকুইন দ্যা প্রাউডকে বিতাড়িত করে রোমান রিপাবলিক গঠন করার পিছনে যে ব্যাক্তিটির অবদান সবচেয়ে বেশি তাঁরও নাম ব্রুটাস।

আবার গ্রিক ইতিহাসের দিকে তাকাই, সেই ৫০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দের দিকে পারসিক রাজা দরায়ুস আর তাঁর ছেলে জেরেক্সেস গ্রিসের নগর রাষ্ট্রগুলিকে দখল করতে চেয়েও পারে নি, অথচ সেই ঘটনার দুইশ বছর পর গ্রিসেরই নগররাষ্ট্র মেসিডোনিয়ার অধিপতি আলেক্সজান্ডার দি গ্রেট পুরো পারসিক সাম্রাজ্য দখল করেন। ইসলামের ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরাই। উমাইয়া খেলাফতের প্রায় সব খলিফাই ধর্ম থেকে দূরে সরে গিয়েছিলো, ইসলামের মূলনীতিগুলো তারা খুব কমই মেনে চলতো, শুধুমাত্র একজন খলিফা ছাড়া। তাঁর নাম উমর ইবন আজীজ, যিনি দ্বিতীয় উমর নামেও পরিচিত ছিলেন। শুধুমাত্র খোলাফায়ে রাশেদীনের দ্বিতীয় খলিফার নামের সাথে মিলের জন্যই কী তিনি উমাইয়া খেলাফতের একমাত্র ধর্মভীরু এবং জনপ্রিয় খলিফা ছিলেন? আমরা রামায়নে পড়েছি, রামের বনবাসের সময়কালে লংকা দ্বীপের রাবন সীতাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।

তারপর রাম দেব-দেবী এবং হনুমানদের সাহায্য নিয়ে লংকা দ্বীপ আক্রমন করে, পরবর্তীতে বিভীষনের জন্য রাবনকে পরাস্ত করা সম্ভব হয় এবং লংকা ধ্বংস্তুপে পরিণত হয়। আর ট্রয়ের যুদ্ধে দেখা যায়, প্যারিস স্পার্টার রানী হেলেনকে ট্রয়ে নিয়ে আসলে, হেলেনের স্বামী মেনেউলাস, তার ভাই আগামেমননসহ আরো অনেকের সাহায্যে ট্রয় দ্বীপ আক্রমন করে, যুদ্ধে প্রায় সব দেবতা-দেবীরা জড়িয়ে পড়ে এবং সবশেষে অডিউসিয়াসের ট্রোজান হর্সের জন্য রাজা প্রায়াম পরাজিত হয়, ট্রয় ধ্বংস্তুপে পরিণত হয়। সীতাকে অপহরণ আর হেলেনের স্বেচ্ছায় চলে আসা ছাড়া পৃথিবীর দুই প্রান্তের দুইটি ঘটনার বেসিকে কোনো অমিল আছে কী? আমাদের ভারতবর্ষ প্রায় দুইশ বছর শাসন করেছে ইংরেজরা। ভারতে যখন ইংরেজ শাসন শুরু হয়, প্রায় একই সময়ে আমেরিকাতে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটে। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, ১৭৮১ সালের দিকে লর্ড কর্ণওয়ালিস আমেরিকাতে জর্জ ওয়াশিংটনের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়, আর সেই একই ব্যাক্তি ১৭৮৬ সালে গভর্নর জেনারেল হিসেবে ভারতবর্ষে আসে।

ইংলিশ রাজপরিবারের ইতিহাসও অনেক চমকপ্রদ। ইংল্যান্ডের রাজা হেনরী-VIII বহু বিবাহ করার জন্য রোমের চার্চের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে ছয়টি বিয়ে করেন আর তারই মেয়ে রানী এলিজাবেথ-I ইতিহাসে কুমারী রানী হিসেবে পরিচিতি পান। (২) ইংল্যান্ডের ইতিহাসে রানী প্রথম এলিজাবেথের অবদান অপরিসীম। ইংল্যান্ডকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নেবার জন্য তিনি স্মরনীয় হয়ে আছেন। তাঁর সময়েই ইংল্যান্ডের কাছে স্পেনের ‘দ্যা ইনভিন্সিবল আর্মাডা’ পরাজিত হয়, ফলে সামরিক ক্ষেত্রেও ইউরোপে ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

অথচ রানী প্রথম এলিজাবেথ ছিলেন অবিবাহিত, ইতিহাসের পাতায় কুমারী রানী হিসেবে সমধিক পরিচিত। কিন্তু কেনো তিনি অবিবাহিত ছিলেন? যেইমাত্র ১৫৫৯ সালের ১৫ই জানুয়ারী মাত্র ২৬ বছর বয়সে এলিজাবেথের অভিষেক হয়, তখন থেকেই সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন ছিলো-কে হবে রানীর স্বামী? যেহেতু তিনি ছিলেন টিউডর বংশের শেষ উত্তরাধিকারী, ধারণা করা হয়েছিলো তাঁর রাজত্বের প্রথম দিকেই এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে তাঁর বিয়ে করা, বিশেষ করে পরবর্তী বৈধ উত্তরাধিকারীর জন্ম দেওয়া, যাতে তাঁর মৃত্যুর পর রাজসিংহাসন নিয়ে গৃহযুদ্ধের সূচনা না হয়। লেডী এলিজাবেথ, ১৫৪৬ সালের দিকে সেই সময়ে ইউরোপের সবচেয়ে প্রার্থিত পাত্রী ছিলেন রানী প্রথম এলিজাবেথ। ইউরোপের বিভিন্ন রাজপরিবার, ইংল্যান্ডের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ ব্যাক্তিরা রানীকে বিয়ে করতে চাইলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন, স্পেনের রাজা ফিলিপ (যে কি না এলিজাবেথের সৎ বোন রানী মেরীর স্বামী ছিলো), সুইডেনের প্রিন্স এরিক (খুব দ্রুতই যার সুইডেনের রাজা হবার কথা), আর্চডিউক চার্লস (রোমান হলি এমপেরোর ফার্ডিনান্দের ছেলে), ইত্যাদি ইত্যাদি।

এদের মধ্যে একমাত্র স্পেনের রাজা ফিলিপকেই এলিজাবেথ সরাসরি ‘না’ করেন। রানীর সভাষদরা আলোচনা করতেন কাকে বিয়ে করলে কি ধরনের সুবিধা, কাকে বিয়ে করলে কি ধরনের অসুবিধা হবে। শুধু এটা বোঝা যেতো, রানীর বিয়ে নিয়ে পুরো ইউরোপের আগ্রহ থাকলেও একজন মাত্র ব্যক্তির তেমন কোনো তাড়াহুড়ো ছিলো না, আর সে হচ্ছে স্বয়ং রানী প্রথম এলিজাবেথ। প্রকৃতপক্ষে এটা কখনোই জানা যাবে না, রানীর নিজের বিয়ে করার কোনো উদ্দেশ্য ছিলো কী না। তাঁর কিছু সভাষদদের সামনে তিনি কখনো কখনো বিয়ে না করার কথা প্রকাশ্যেই বলেছিলেন।

আবার এটা ভাবাও ভুল হবে যে, আসলেই তাঁর বিয়ে করার উদ্দেশ্য ছিলো না। কারণ, সিংহাসনে আসীন রানীর বিয়ে অনেকটাই জটিল একটা বিষয় এবং ভুল কাউকে বিয়ে করার কারণে তাঁর অবস্থা তাঁর সৎ বোন রানী মেরীর মতো হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিলো। এলিজাবেথ এমন কাউকে স্বামী হিসেবে বেছে নিতে পারছিলেন না যার কোনো জনপ্রিয়তা রানীর প্রজাদের মধ্যে নেই (যে ভুল করেছিলেন রানী মেরী, স্পেনের রাজা ফিলিপকে বিয়ে করে), আবার এমন কাউকেও গ্রহন করতে পারছিলেন না যাতে সে তাঁর রাজ্য পরিচালনার কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে (এর ফলে সভাষদরা বিরুপ হতে পারে)। এইসব বিবেচনা করে এটা ঠিক হয় যে, এলিজাবেথের সাথে এমন কারো বিয়ে হবে যে ইউরোপের কোনো ক্ষমতাশালী রাজা হবে না, কিন্তু পদমর্যাদা খুব ভালো হবে এবং শুধুমাত্র রানীর স্বামী (Queen’s Consort)হিসেবেই থাকবে। সেই হিসেবে ইউরোপের ক্ষমতাশালী রাজারা বাতিল হয়ে গেলেও রানীর মন্ত্রীরা প্রাথমিকভাবে সুইডেনের প্রিন্স এরিককে রানীর স্বামী হিসেবে ভেবেছিলেন।

কারণ, এরিক ছিলেন ইংল্যান্ডের জনগনের মাঝে তুমুল জনপ্রিয় এবং এলিজাবেথের মতো সেও ছিলো প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মমতের অনুসারী। কিন্তু সুইডেনের রাজপরিবারের খুব বেশী সম্পত্তি না থাকায় অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবার সম্ভাবনা নেই বলে এই বিয়ে শেষ পর্যন্ত হয়নি। লর্ড রবার্ট ডুডলি এরই মধ্যে রানী নিজেই তাঁর বিয়ের ব্যাপারটাকে আরো জটিল করে তুলেন তাঁর বাল্যবন্ধু লর্ড রবার্ট ডুডলির প্রেমে পড়ে। সেই সময় রবার্ট ডুডলি বিবাহিত ছিলেন। এমন গুজবও ছড়িয়ে পড়েছিলো রানীকে বিয়ে করার জন্য ডুডলি তার স্ত্রীকে ডিভোর্স দিবেন।

কিন্তু ডুডলির বাবা ডিউক অব নর্থাম্বারল্যান্ড বিশ্বাসঘাতকতার জন্য রানী মেরীর রাজত্বের সময় মৃত্যুবরন করায় প্রজাদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন না। তার উপর ঐ সময়ে হঠাৎ করে ডুডলির স্ত্রী রহস্যজনকভাবে সিড়ি দিয়ে পড়ে গিয়ে মারা যাওয়াতে, এলিজাবেথ ডুডলিকে বিয়ে করা থেকে বিরত থাকেন, যাতে কেউ মনে করতে না পারে যে এই রহস্যজনক মৃত্যুর সাথে এলিজাবেথের কোনো সম্পৃক্ততা আছে। রবার্ট ডুডলির পর সবচেয়ে ভালো পাত্র ছিলেন ডিউক অব এলেনকন, ফ্রান্সিস। তিনি ছিলেন ফ্রান্সের রাজার ভাই। বয়সে ছোট এবং ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও ফ্রান্সিসকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার কারণ ছিলো স্পেনের সাথে ইংল্যান্ডের সম্পর্কের অবনতি।

এর ফলে ইংল্যান্ড ফ্রান্সের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে উৎসাহী হয়ে উঠে এবং এই বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়। তাছাড়া ফ্রান্স ক্যাথলিক হলেও, স্পেনের মতো তীব্র প্রটেস্ট্যান্ট বিরোধী ছিলো না। ফ্রান্সিস নিজেও তাঁর দেশের প্রটেস্ট্যান্টদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। কিন্তু ফ্রান্সে হঠাৎ করেই ‘বার্থেলোমিউ ম্যাসাকার’ (নারী ও শিশুসহ ৬০০০ হাজার ফ্রেঞ্চ প্রটেস্ট্যান্ট হত্যাকান্ড) ঘটে যাওয়াতে কিছুটা সমস্যা দেখা দেয়। এরপরও ফ্রান্সিস ইংল্যান্ডে আসেন, রানী এলিজাবেথ তাঁকে পছন্দ করেন (যদিও ফ্রান্সিসের গালে গুটি বসন্তের অনেক দাগ ছিলো, এবং তাঁর চেহারা খুব একটা সুন্দর ছিল না), সভাষদদের সামনে তাঁকে বিয়ে করার ঘোষনা দেন, প্রকাশ্যে চুমু খান এবং আঙ্গুলে আংটি পড়িয়ে দেন।

কিন্তু আবারো ধর্ম এবং রাজনীতি বড় বাধা হয়ে দাড়ায়। ইংল্যান্ডের যারা গোড়া প্রটেস্ট্যান্ট ছিলেন, তারা এই বিয়ের বিরোধীতা করতে লাগলেন। তাঁর মন্ত্রীপরিষদও বিভক্ত হয়ে পড়ে, প্রজাদের মধ্যেও অসন্তোষ শুরু হয়। ফলে ফ্রান্সিসের সাথে বিয়ে হতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত হলো না। এভাবে এলিজাবেথের বয়স হয়ে যায় চল্লিশের উপরে।

গত বিশ বছর ধরে যে মহিলা ছিলেন সমগ্র ইউরোপের সবচেয়ে আকাঙ্খিত পাত্রী, তাঁর এখন আর সন্তান জন্ম দেওয়ার বয়স নেই। রাজনীতি আর ধর্মের বেড়াজলে পড়ে মধ্যযুগের ইংল্যান্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ রানীকেই আজীবন অবিবাহিত থাকতে হলো। যে রানী তাঁর রাজত্বের শুরুতে বলেছিলেন, খুব খুশি হবেন যদি তাঁর কবরে লেখা থাকে “ A queen having lived and reigned such and such a time, lived and died a virgin” , শেষ পর্যন্ত তাঁর ইচ্ছাই বাস্তবে পরিণত হলো এবং তিনি ইতিহাসে পরিচিত হয়ে রইলেন The Virgin Queen হিসেবে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।