আমি রক্ত খাই। আরো রক্ত চাই আমার। বাংলাদেশ নামে ছোট্ট একটা দেশের মহাসড়ক আমি। আমার উপর দিয়ে চলতে গেলে আপনাকে কোনো নিয়ম মানতে হবে না, বৈধ লাইসেন্স লাগবে না, শুধু একটু স্টীয়ারিং হুইল ঘোরাতে পারলেই হোলো। আর দুর্ঘটনা ঘটালেও ক্ষতি কী! পুলিশি তদন্তের সময় একটু লুকিয়ে থাকবেন, আর থানা হাজতে থাকতে হলে কিছুদিনের মধ্যেই জামিন পেয়ে যাবেন।
আমি বাংলাদেশের মন্ত্রীদের বিবেচনায় আস্থা রাখি, এ্মন জনবহুল দেশে কি আর সব নিয়ম মানা যায়? আপনারাই বলেন, জনসংখ্যা কোনোভাবে কমছে না, প্রতি বছর যদি দুই আড়াইশ লোক এভাবে কমে, আখেরে কার লাভ? আপনাদেরই তো! নিজের ভালো পাগলেও বোঝে, আপনারা বোঝেন না? যারা বোঝেন তারা মানবাধিকার কর্মীদের বুঝিয়ে বলবেন, খামোখা রাস্তায় দাঁড়িয়ে চেঁচামেচি না করে বাসায় গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমান। এদেশে সবাই প্রাণী। দাম বাড়ানোর পরেও যদি প্রতিদিন গরু, ছাগল, মুরগী জবাই হয়, আপনাদের তো দাম বাড়ে নাই, বরং কমছে, তাহলে কি আপনারা আরো নির্বিচারে মারা পড়বেন না? বাসসুদ্ধ মানুষ, লঞ্চসুদ্ধ মানুষ, শয়ে শয়ে মানুষ মরবেন, নিজের বাড়িতে খুন হবেন, রাস্তায় পুলিশের গুলিতে মরবেন, খুন হয়ে জবাই হয়ে নদীতে ভেসে পড়বেন, রাস্তায় পড়ে থাকবেন। আরে ভাই, গরু ছাগল জবাই হলেও তো মাংস কাজে লাগে। আর আপনারা মরলে উলটো সৎকার করতে হয়, কি জ্বালা!
আপনি কি বঝেন, এ দেশে মরে গেলেই বরং আপনি ভালোভাবে বাঁচতে পারবেন? বেঁচে থাকবেন কার জন্য বলুন তো ? বাবা তার বাচ্চাকে কুরবানি দিয়েছে, মায়ের প্রেমিক খুন করছে শিশু সন্তানকে, স্বামী স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারছে, ভাই সম্পত্তির লোভে গায়েব করে দিচ্ছে ভাইকে… আপনার কি সত্যিকারের কেউ আছে , কে দেখতে আসছে, মারা গেলেন না বেঁচে থাকলেন?
যা বলছিলাম, আমার রক্ত চাই, আরো, অনেক।
অবশ্যই মন্ত্রী মিনিস্টারদের না, তাদের সামনে পুলিশের গাড়িবহর, পেছনে চামচাদের, ওই রক্ত পাবার দূরাশা আমি করি না। আমি কি আপনাদের মতো বোকা না।
আপনাদের স্মৃতিশক্তিতে আমার আস্থা নেই, কারণ আপনারা ভুলে যান আগের সরকার কী করেছে, তাই বারবার সরকার পরিবর্তন হয়। তাতে অবশ্য আমার কোনো সমস্যা নেই, কেননা মন্ত্রী আর চামচাদের কাছে বঙ্গবন্ধু আর জিয়ার নামের যত গুরুত্ব, তত মাথাব্যথা নেই দেশের সমস্যা নিয়ে। তাই আমার চিন্তারও কোনো কারণ নেই, দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতিতে দাম কমবে মানুষের, কমতে কমতে ছাগলের দামের ( ভুলে গেলেন নাকি সেই যে লঞ্চ ডুবিতে মানুষ মারা গেলে ব্লাক বেঙ্গল টাইগার দিয়েছিলো ) সমান হবে, পত্রিকাওয়ালারা মাতামাতি করবে, কিছুদিন পর আবার দুর্ঘটনা ঘটবে।
অতএব আমার রক্তের অভাব নেই।
আপনাদের কি ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে? স্মৃতিশক্তি কম হলেও আপনাদের ধৈর্য তো কম না। বছরের পর বছর প্রতিশ্রুতি শুনতে শুনতে সর্বংসহা হয়ে গেছেন, তাই এখন আর কিছু স্পর্শ করে না আপনাদের। এই তো সেদিন সবাই বলাবলি করছিলো মিলন নামক হতভাগা কারো কথা, শুধু ডাকাত সন্দেহ হলেই কাউকে মেরে ফেলতে দ্বিধাবোধ করেনি না আপনারা। জানেন আমারই কস্ট হয় যখন কেউ বলাবলি করে, অমুক মেয়েটি বখাটেদের অত্যাচারে আত্মহত্যা করেছে, আহা কি কস্টটাই না জানি পেয়েছিলো মেয়েটি!
যাই হোক, নিজের কথা বলি।
আমার উপর কতো মানুষের যে প্রাণ গেলো, কতো রক্ত পেলাম, তবে কি না জানেন, বিখ্যাত মানুষের রক্ত পাবার মজাই আলাদা। কতো পত্রিকায় আমার নাম উঠবে! দেশ বিদেশের মানুষ জানবে আমাকে। কত মানুষের রক্ত আমি পান করেছি, সবার নাম আমি জানি না, আমি কেনো আপনারাও জানেন না। বিদেশীর রক্তও পেয়েছি আমি, সেই যে থাইল্যান্ড থেকে এসে আমাকে বুকে রক্ত দিয়ে গেলো রাজকুমারীর সহকারী! তবে বলুন আমি কি ভুল বলেছি? আপনারা মানুষের নাম জানেন না, কত মানুষ প্রাণ দিলো তাও জানেন না, কিন্তু আমার নাম জানেন, বলুন ঠিক কিনা?
নাম জেনেও লাভ নেই, ব্যবস্থা নিতে পারবেন না।
সব রক্তের স্বাদ একই রকম, সাধারণ মানুষের রক্ত তো পানসে, আলাদা কোনো মজা নেই।
মনে হয় মন্ত্রী মিনিস্টারদের রক্ত অন্যরকম, নাহলে এ্যাতো গুলো মানুষকে কিভাবে কব্জা করে রাখে? কি সুন্দর নাদুশ নুদুশ তেল মাখা চেহারা, বিদেশি চকচকে বিনাশুল্কে আমদানি হওয়া গাড়ি, দেশের খেটে খাওয়া মানুষের গায়ের রক্ত পানি করা টাকার তেল, ওহ আমি আর খাওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না!
হায় হায়, এসব কী চিন্তা করছি আমি! তাদের রক্ত শুষে নিলে কে চাপ দিবে পরীক্ষা ছাড়াই অপরিপক্ক চালকদের ভারী যানবাহন চালাবার লাইসেন্স? না, আমি তাদের রক্ত খাবোনা, তারা শত শত বছর বেচে থাকুক, ঘুষ খেয়ে অনিয়ম করুক, মানুষের পর মানুষের লাশ ভেসে যাক, একদিন আমি রক্তের জোয়ারে সমুদ্র হবো। তারপর? কিছুদিন পত্রিকায় আমার নাম উঠবে, মাতামাতি করবে কিছু বেঁচে যাওয়া লোক, তারপর ভুলে যাবে। আর এভাবেই কমতে থাকবে মানুষ, তারপর একদিন শুনবো সেই কাঙ্ক্ষিত সংবাদ, “বাংলাদেশে জনসংখ্যা কমে গেছে, জনসংখ্যার লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী অমুক পুরস্কার পেয়েছেন। ” ঠিক কি উপায়ে জনসংখ্যা কমানো হলো তা জানতে বিদেশী পর্যবেক্ষক আসবেন, আপনারা ভুরিভুরি টাকা দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করে দেবেন, এ তো নতুন কিছু না, আপনারা দুর্নীতিতে বরাবরই প্রথম, না হয় আর একবার হলেন, বিশ্বের বৃহত্তর স্বার্থে এটুকু ত্যাগ বাংলাদেশ করতেই পারে।
আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি, আমার বিশ্রাম দরকার।
মহাসড়ক ঘুমিয়ে যায়। একটু পর তার নাক ডাকার শব্দ পাওয়া যেতে থাকে। সে স্বপ্ন দেখে অঝোর বৃষ্টিতে একটি মাইক্রোবাস এগিয়ে আসছে, সংঘাত হলো বড়ো একটি ডিলাক্স বাসের সাথে, মুহুর্তে মাইক্রোবাসটি দুমড়ে মুচড়ে গেলো, ভেতরের মানুষগুলো চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে গেছে, রক্ত চুয়ে পড়ছে তার বুকে। হটাৎ সে বুঝতে পারে, সে স্বপ্ন দেখছিলো না, সত্যি রক্ত পান করছে।
সে অনুভব করে মানুষগুলোর রক্তের স্বাদ অন্যরকম, খুব সম্ভবত খাঁটি মানুষের।
কিছুক্ষণের মাঝেই সে জেনে যায়, সে যাদের রক্ত পান করেছে তারা দেশের বরেণ্য
মানুষ, সে বুঝতে পারে যারা সত্যিকারের বাংলাদেশকে গড়তে চেয়েছিলো তাদের রক্ত অন্যরকম। তাদের রক্ত শুদ্ধ, সে তার মা মাটির কাছে জেনেছে, শুনেছে মুক্তিযুদ্ধের কথা, মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের কথা।
তখন তার মনে হতে থাকে সব মানুষই অসাধারণ, সবার মাঝেই স্বপ্ন থাকে। তার কাছে রক্ত কেমন বিস্বাদ লাগতে থাকে, এই প্রথম সে উপলব্ধি করে জীবনের মূল্য অনেক বেশি, প্রতিটি স্বপ্নই মূল্যবান। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।