আর বের হয়েই দেখি এক গাড়ি পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে আসল এখানে। হ্যাঁ আমাকে থানায় কোন এক অজানা চেম্বারে রাখা হয়েছে।
যায়গাটাকে পায়খানার সাথে তুলনা করলে ভাল লাগত- কিন্তু সামনে এক সারি লোহার গ্রিল থাকায় এটাকে আসামী সেল বলতে হচ্ছে। প্রচন্ড দুর্গন্ধ যায়গাটা। সাথে অন্ধকার ও।
অন্ধকার কে অসহ্য লাগে আমার। এখানে আসার পর আমার কম দামী মোবাইল সেট টা কেড়ে নিয়েছে ওরা।
একটা কল করতে চাইতেই কেউ একজন জোড়ে সোরে একটা থাপ্পড় মেরেছে। উফ গালের বাম পাশে এখন ও জ্বলছে। কি জন্য আমাকে এখানে আনা হল সেটা আমাকে না জানিয়েই সুলেমান নামে এক পুলিশ কনস্টেবল লাথি দিয়ে এখানে ফেলে রেখে গেছে আমাকে।
অনেক টা গরুকে যেভাবে মানুষ মারে সেভাবে। লাথিটা আরেকটু উপড়ে পড়লেই নিশ্চিত আমার কিডনিটা নষ্ট হয়ে যেত। কি জানি কোন রহমতে আমাকে লাথিটা কোমরের নিচেই মেরেছে।
উফ আর পারছিনা। প্রচন্ড বমি আসছে আমার।
সামান্য সিগারেট কিনতে গিয়ে আজ এভাবে পুলিশে ধরেছে। মনে ছিল না এ রকম একটা ঘটনা ঘটতে পারে। এইতো কয়দিন আগে পুলিশের সহযোগিতায় ছয় জন কলেজ পড়ুয়া ছেলেকে গণপিটুনি তে মারা হয়েছে। আর ক্রসফায়ার তো এখন চুটকির খেল। কখন যে আমাকে ক্রসফায়ারে দেয় কে জানে।
উফ- আর পারছিনা। কেউ একজন এখানে আমার আগে এসে বমি করে গেছে। ওর বমির কারন কি জানিনা। আমার ওর কারনেই বমি আসছে। এখন ও আমার বাম পাশের নিচু দিকটাতে জমে আছে বমি।
কেউ দয়া করে ও পরিষ্কার করে দেয় নি।
হটাত করে সামনে আলো জলে ঊঠল- খুব ক্ষিন আলো- কে যেন আসছে। গটগট আওয়াজ তুলে কেউ একজন আসছে। আমি শুনতে পাচ্ছি। সাথে একটা চাবির গোছা।
তারপর এসে দরজা খুলে আমাকে ডাকল- আমি সামনে যেতেই আমার শার্টের কলার ধরে টেনে নিয়ে এল আরেকটা রুমে। রুমে অনেক পাওয়ারের একটা বাতি জ্বলছে। কত পাওয়ার জানতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু পুলিশকে জিজ্ঞেস করতে ও ভয় লাগছে। আমাকে একটা চেয়ারে বসানো হল।
তারপর সব চুপচাপ। কেউ একজন মাথার উপরের লাইট টা অফ করে দিয়ে চলে গেল। আমি বসে আছি আবার অন্ধকারে।
অনেক ক্ষন পর দুইজন পুলিশ আসল। যথারীতি লাইট জ্বালিয়ে আমাকে একটা থাপ্পড় দিয়ে কথা শুরু করল।
এবারের থাপ্পড় টা আগেরটার চাইতে ও জোরে দিল সামনে এসে বসা নাম না জানা পুলিশ। বুকের উপরের নাম লেখা ব্যাজ টা খুলে রেখেছে। যেন আমি নাম না জানতে পারি। কিনবা হয়ত অন্য কোন কারনে। তারপর পান খাওয়া মুখ থেকে পিচ করে পিক মাটিতে ফেলে তাচ্ছিল্য ভাবে আমার সামনে একটা কাগজ রাখল।
একটা কলম দিয়ে বলল-
“ লেখ এখানে- নিজের নাম লেখ- বাপের নাম লেখ। তারপর লেখ যে কাঠাল বাগান এলাকায় তুই আর তোর সহযোগী কালু মোস্তফা গ্রুপের সাথে তুই ডাকাতি করতে যাবার আগে আমাদের হাতে ধরা পড়েছিস”
আমি তো কথা শুনেই থ- কি বলে এ সব- আমি বললাম-
“স্যার আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে- আমি কোন কালু মোস্তফা কে চিনিনা। আমি নিচে নেমে ছিলাম সিগারেট কিনতে” –
বলার আগেই পেছন থেকে কেউ একজন আমার মাথায় সজোরে মারল একটা বাড়ি- চোখের সামনে অন্ধকার হওয়া শুরু করল। চোখে দেখলাম না বেশ কিছুক্ষন। এর মাঝে কেউ একজন আমাকে মাটিতে শুইয়ে লাথি মারা শুরু করল।
যেন পুলিশ হিসেবে ওকে বাটার বুট জুতা দেয়াই হয়েছে আমাকে বুকে পিঠে লাথি মারার জন্য।
অনেক ক্ষন পর আমাকে আবার বসানো হল আবার সেই টেবিলে। ততক্ষণে আমার সারা শরীর অবশ হয়ে গেছে। হাতের আঙ্গুল গুলোর মাঝে মধ্যমা টা থেতলে গেছে অনেক আগে। এখন কোন অনুভুতি নেই।
আমাকে এবার একটা টেপ রেকর্ডার এ স্বীকারোক্তি দিতে বলল ওরা। আমি কথাই বলতে পারছিনা- দেখে কেউ একজন বলল-
‘স্যার হালারে এখন ছাইরা দেন। আসেন আগে পাশের রুমের গুন্ডাটারে সাইজ করি । হালা নাকি ঢাকা ইউনিভার্সিটি তে পড়ে- আসেন দেখায়া দেই ওরে ঢাকা ইউনিভার্সিটি”- বলেই গট গট করে চলে গেল আমাকে রুমে তালা দিয়ে- তারপর আমার কিছু মনে নেই।
--------------------------------------------------------------------
যখন ঘুম ভাঙল তখন আমি মাটিতে পড়ে আছি।
শরীরে একফোটা ও শক্তি নেই। কিন্তু আমার কান সজাগ আছে আগের মত। হয়ত শরীরে একটাই অংগ আছে সেখানে পুলিশের লাথি পড়েনি। তাই কান দুটোতে একটা বিশ্রী চিৎকার শুনে আমার ঘুম ভেঙ্গেছে। ঘুম না বলে অচেতনতা বলাই ভাল।
অনেক ক্ষন পর আমার ভয় লাগতে শুরু করল। আমি প্রথমে জেগেই মনে করেছিলাম আমি স্বপ্ন দেখছি। পড়ে বাম হাতটা নাড়াতে গিয়েই দেখি আর নাড়াতে পারিনা। খুব ব্যাথা করছে মাসল গুলোতে। তারপর মনে পড়ল সব কথা।
আমি কিভাবে এখানে এলাম- কে আমাকে কি বলল- সব। শুধু মাঝের অচেত্ন সময়টা তে কি হয়েছে জানিনা।
এমন সময় সেই চিৎকার আমি আবার শুনলাম- পৈশাচিক একটা চিৎকার। কেউ কারো মুখ চেপে ধরে রেখে শরীরে দা দিয়ে কোপ দিলেই কেবল এই চিৎকার করতে পারবে কেউ। তখন মনকে প্রবোধ দিলাম আমি থানাতে আছি।
এখানে বেশীর চেয়ে বেশি আমাকে পেটাতে পারে। আঙ্গুলে সূচ ফোটাতে পারে। কেউ তো আমাকে কোপাতে আসবেনা। ঠিক এমন সময় আরেকটা চিৎকার শুনে ভয়ে আমার লোম খাড়া হয়ে যায়। একই রকম- কিন্তু এবার অনেক হালকা।
যে চিৎকার করছে সে যেন এখন অনেক দুর্বল। আর পারছেনা । আমি কি হয়েছে জানতে পারছিনা। রুম পুরোটা অন্ধকার। কিছু দেখা যাচ্ছেনা।
তবুও চিৎকার কোনদিক থেকে আসছে সেটা বুঝতে চেষ্টা করছি। কাছাকাছি কোথাও থেকে আসছে – কিন্তু আমি বুঝতে পারছিনা। কি করব সেটাও বুঝছি না।
হটাত আবার শুনতে পেলাম সেই চিৎকার। এবার বুঝলাম- এটা আসছে আমার সামনের দিক থেকে।
আমি কোন রকমে হামাগুড়ি দিয়ে যেতেই বাঁধা পড়ল। সামনে লোহার ঠান্ডা নিরেট দেয়াল। তারপর কান পাতলাম সেই দেয়ালে। তারপর আমি যা শুনলাম তাতেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল আমার। কেউ একজন চিৎকার করছে- “ বাঁচাও বাঁচাও বলে’ আর অনেক গুলো মানুষ- হয়ত চার পাঁচ জন হবে- হা হা করে হাসছে।
তারপর কেউ একজন খপ খপ করে কিছু একটা শব্দ করতেই সেই চিৎকার ভেসে আসল আবার। তারপর কান্না। চিৎকার করে কান্না। কেউ একজন বলে উঠল-
“ বল তুই কালু মোস্তফার গ্রুপের লিডার- স্বীকার কর। শেষ বারের মত স্বীকার কর বলতাসি- নাইলে কিন্তু আরেকটা পা ও আমি কাইটা ফালামু কইলাম”
শুনেই আমার বুকের ভেতর টা কেঁপে উঠল।
তাহলে কি এতক্ষন এভাবে পুলিশ একটা পা কেটেছে একজন নিরপরাধ মানুষের? কি করেছিল মানুষটা? হয়ত আমার মত কিছুই করেনি। শুধু শুধু উপরওয়ালা দের খুশি করতে একজন নিরপরাধ মানুষের পা কেটে ফেলল?
চিন্তায় ছেদ পড়ল- আরেকটা প্রাণ ফাটানো চিৎকার শুনে। এবার কান্নার শব্দে আমার কান যেন ঝালা পালা হবার জোগার। তখন ই তিন চার জন সেই নাম না জানা মানুষটাকে বুটের লাথি মারতে শুরু করল। প্রথম দিকে গোঙ্গানির শব্দ ভেসে আসছিল।
মিনিট খানেক পর তাও নেই। শুধুই বুটের লাথির আওয়াজ ভেসে আসল আমার কানে। যেন আমার মাথার ভেতর ঘটনা টা ঘটছে। অনুভব করতে চেষ্টা করলাম সেই নাম না জানা মানুষটার কথা। না জানি ওর জন্য ওর মা ভাত বেড়ে বসে আছে।
ও আসছেনা দেখে একে ওকে কান্না কাটি করে জানতে চাইছে ছেলের কথা। ওই মা হয়ত জানবে ও না যে উনার ছেলে মারা গেছে একটু আগে। পুলিশের হাতে জীবন খুইয়েছে।
ভাবতেই মায়ের মুখটার কথা মনে পরে গেল। আর আমি দাঁড়ানো থেকে বসে পরলাম।
শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা টের পাচ্ছি। কেউ যেন আমাকে ১০০০ ওয়াটের কারেন্ট পাস করিয়ে দিয়েছে।
এমন সময় মনে হল- কি দরকার সেই ছেলেটার মত পুলিশের হাতে প্রাণ খুইয়ে? কি দরকার? বেঁচে থাকলে আবার আমি নিজের জীবনে ফিরে যেতে পারব। তারচেয়ে এখন আমি স্বীকার করব যে আমি কালু মোস্তফার দলের লোক। পুলিশকে একবার ও মারতে হবেনা।
আমি অকপটে সব স্বীকার করব। মন গড়া অনেক কথা বলব- যা আসে মনে।
মনে মনে যখন ঘটনার প্লট সাজাচ্ছি এমন সময় আবার ভেসে আসতে থাকল দুটো পায়ের শব্দ। দুইজন আসছে। দুইজন আসছে আমার দরজার দিকে।
কিন্তু আমার দরজার সামনে এসেই থেমে গেল ওরা। ওয়াকিটকির শব্দ পাচ্ছি। কেউ একজন কিছু একটা অর্ডার দিল ওদের। ওরা আসল না। বাম দিকে চলে যেতে যেতে একজন হুকুম দিল এক ইনস্পেকটর কে-
“ একটা ভ্যানে করে ওই লাশটাকে আর এই ১২৩ এর ছেলেটাকে নিয়ে যা।
রামপুরায় কিছু লোক জড়ো করা হয়েছে বলে আই.জি. স্যার জানালেন। এই দুইটাকে ডাকাত বলে ওই লোক গুলার হাতে তুলে দে। যেন একবারে শেষ করে দেয়। আর শোন কেউ যেন কোন কথা বলতে না পারে। এই বিষয় জানাজানি হলে একদম বান্দরবানে পোস্টিং হবে।
যা- যা বল্ললাম ঠিক মত করে আয়”- বলেই গটগট করে হেটে চলে গেল একজন।
শুনেই আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল। আমাকে গন পিটুনিতে দেয়া হবে। মানুষ আমাকে যা খুশি তেমন করে মারবে? এভাবেই কি মৃত্যু লেখা ছিল আমার? এই কি তবে শেষ সময়ের শ্বাস নেয়া? আহ কত স্বপ্ন ছিল বাবার- অনেক বড় ইঞ্জিনিয়ার হব- মা সাধ করে আমাকে ডাক্তার বানাতে চেয়েছিল। সেটাও হবেনা।
হায় আমার আদরের বোন মিনুর সাথে আর কোনদিন খুনসুটি করতে পারবোনা। আমাকে ওরা ডাকাত হিসেবে খবরের কাগজে মৃত হিসেবে দেখবে। আর চিৎকার করে বলবে-
“আমার ভাই কোনদিন ডাকাত ছিলনা। আমার ভাই ছিল ছাত্র”...
ভাবনার মাঝে ছেদ পড়ল- হটাত এগিয়ে আসা শুরু করল জুতার আওয়াজ । আমার দিকেই এগিয়ে আসছে।
হয়ত আজরাইল এভাবেই এগিয়ে আসে। তারপর চোখ বন্ধ করে দিলাম ক্লান্তিতে। কেউ যেন দরজার সামনে দাড়িয়ে বড় একটা শ্বাস নিল-তারপর আমার সেলের দরজার তালাতে চাবি ঢোকানোর শব্দ হল- খুট...
আমি শেষ বারের মত নিজের অপূর্ণ ইচ্ছা গুলোর কথা চিন্তা শুরু করলাম। আহা যদি বেঁচে থাকতে পারতাম এই সুন্দর পৃথিবীতে......
(সমাপ্ত)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।