সমাজ থেকে কল্পিত দ্বন্দগুলো দূর হোক। ক্রোমোজোম তত্ত্বের ফলে হোক বা শফী তত্ত্বের (তাঁর ধারণা, নারী-পুরুষের প্রজননক্ষমতা যে কমে যাচ্ছে তার একমাত্র কারণ মেয়েরা বেপর্দা হয়ে বাইরে ঘোরাফেরা করে। অফিস করে। মার্কেটে যায়। মানুষের এই বেলেল্লাপনার কারণে মানুষের শুক্রঘাটতি দেখা দিয়েছে।
ফলে পুত্রসন্তান কম পয়দা হচ্ছে)ফলে হোক জানুয়ারী ০২, ২০১২ সালের সকাল ৯.৩০ টা কণ্যা সন্তানের জনক হিসাবে নতুন পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করার সৌভাগ্য হয়। সন্দেহ নেই যে অন্যান্য অনেকের মত কন্যা সন্তানের জনক হওয়ার খবর শুনে আমার চোখও অশ্রুসিক্ত হয়, না দুঃখে নয় আনন্দে। তবে ইউটিউবে আল্লামা আহমেদ শফী সাহেবের ওয়াজ শোনার পর মনে হচ্ছিল দুঃখেই কন্যাসন্তানের জনক হওয়ার খবর শুনে অশ্রুস্তি হওয়া উচিৎ ছিল। সন্দেহ নেই শফী সাহেবদের দৌরাত্ম যদি বেড়ে যায় তবে কন্যা সন্তানের জনক হওয়ার কারণে আগামীতে সুখের বদলে দুঃখে কাঁদতে হবে।
লেখার উপরের অংশটুকু আবর্তনী হিসাবে কাজ করবে, সেটা লেখার পুরোটা পড়লে বুঝতে পারবেন।
এক।
১২ জুলাই, ২০১৩ ছিল মালালার ১৬ তম জন্মদিন। মালালার জন্মদিন কবে সেটা আগে থেকে জানা না থাকলেও কাকতালীয় ভাবে ঐ দিন বিবিসি’র অনলাইন খবর দেখতে গিয়ে জাতীসংঘে মালালার দেওয়া বক্তৃতা বিবিসি লিড নিউজ হিসেবে সৌভাগ্যবশতঃ টেক্সট এবং ভিডিও উভয় ফরমেটে পেয়ে যাই। (মালালার বক্তৃতার ভিডিও লিংক http://www.youtube.com/watch?v=RXIwkg3SXnU). এবং ঐ দিনই আল্লামা শফীর ওয়াজটিও ইউটিউবে শুনতে পাই (ওয়াজের লিংক Click This Link একজন ইসলামী জঙ্গী সংগঠগুলোর গুপ্ত হামলা, আত্মঘাতী হামলাসহ ইত্যাদি ধরনের হামলায় বিপর্যস্ত পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকার মিনগোরাতে জন্মগ্রহণ করে বেড়ে উঠেছে। অন্যজন মডারেট মুসলীম দেশের অস্থীর গণতান্ত্রীক শাসন ব্যবস্থার মধ্যে জীবনের অন্তপ্রহর পার করছে।
লক্ষণীয় ব্যাপার হলো-নানান ধরনের প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠা মালালা মাত্র ১৫ বছরে যে সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং শিক্ষার গুরুত্ব আত্বস্থ করতে পেরেছে অন্যজন ৯৩ বছর বয়সেও সেই মূল্যবোধ ও শিক্ষাবোধ অর্জন করতে পারেনি।
মালালার বক্তৃতায় শফী সাহেবদের অবস্থানের পূর্বাভাষ
ইংরেজী অংশটুকু জাতীসংঘে দেওয়া মালালার বক্তৃতার অংশ এবং পাশেই সেই বক্তৃতার বাংলা অনুবাদ করে দেওয়া হয়েছে-
১. মালালা : Dear brothers and sisters, do remember one thing: Malala Day is not my day. Today is the day of every woman, every boy and every girl who have raised their voice for their rights. প্রিয় ভাই ও বোনেরা একটা বিষয় মনে রাখুন মালালা দিবসটি আমার দিবস নয়। এই দিনটা প্রত্যেকটা নারী-পুরুষ, বালক-বালীকার জন্য যারা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য তাদের কথা বলে।
শফি সাহেবের বিপরীত অবস্থান : মালার যেখানে নারীদের অধিকার আদায়ের কথা বলছে শফী সাহেব সেখানে ধর্মের অজুহাতে নারীদের কথা বলার অধিকারকে হরণ করার ওয়াজ করে বেড়াচ্ছেন।
২. মালালা : Dear sisters and brothers, we realise the importance of light when we see darkness. প্রিয় ভাই ও বোনেরা-আমরা যেখানে অন্ধকার দেখি সেখানের আলোর গুরুত্ব উপলব্ধি করি।
অন্যদিকে শফি সাহেব-যেখানে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যেতে দেখছেন সেখানে অন্ধকারের গুরুত্ব উপলব্ধি করছেন এবং শিক্ষার আলোকে নিভিয়ে অশিক্ষার অন্ধকারকে স্থায়ী ভাবে আবির্ভূত করতে চাইছেন।
আমার মনে হয় এই পর্বে মালালা সবচেয়ে চমৎকার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন-
৩. মালালা : The extremists are afraid of books and pens. The power of education frightens them. They are afraid of women. The power of the voice of women frightens them. This is why they killed 14 innocent students in the recent attack in Quetta. And that is why they kill female teachers. That is why they are blasting schools every day because they were and they are afraid of change and equality that we will bring to our society. And I remember that there was a boy in our school who was asked by a journalist: “Why are the Taliban against education?”He answered very simply by pointing to his book, he said: “A Talib doesn’t know what is written inside this book.”
চরমপন্থীরা কলম এবং বইকে ভয় পায়। শিক্ষার আলো তাদেরকে ভীত করে। তারা ভয় পায় নারীদেরকেও।
তারা নারীদের কন্ঠ শক্তিতেও ভীত হয়। যার কারণে কোয়েটায় তারা সম্প্রতি ১৪ জন নিষ্পাপ ছাত্র-ছাত্রীকে হত্যা করেছে। এবং এই কারণে তারা শিক্ষিকাদের হত্যা করে। এই কারণে তারা স্কুলে হামলা চালায় কারণ তারা পরিবর্তন এবং সমতায়নকে ভয় পায় যেটা আমারা আমাদের সমাজে এনেছি। আমার মনে পড়ে আমাদের স্কুলের একজন ছাত্র এক সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করেছিল-তালেবানরা কেন শিক্ষার বিরুদ্ধে? তিনি বলেছিলেন এটা খুব সহজ ব্যাপার, একজন তালেবান জানেনা যে বইয়ের মধ্যে কি লেখা আছে।
শফী সাহেবের ওয়াজে উপরের অনুচ্ছেদের সত্যতা: মালালার বক্তৃতা অনুযায়ী উপরের অনুচ্ছেদ থেকে বোঝা যায়, শফি সাহেবরা বই এবং কলমকে ভয় পান কথাটা শফী সাহেবের ওয়াজের সাথে মিলে যাচ্ছে এটা কোন কাকতালীয় ব্যাপার নয়। একজন তালেবান যেমন জানে না যে বইয়ের মধ্যে কি আছে অনুররূপভাবে শফী সাহেবও জানেননা বইয়ের মধ্যে কি আছে। যেমনটি আপনি নতুন কোথাও গেলে সেখানে কি আছে জানেন না বলে সেই জায়গাটিকে আপনি ভয় পান। যৌক্তিক কারণেই বইয়ের মধ্যে কি আছে নারীগণ দেখুক বা জানুক তা শফী সাহেবরা চাননা। নারীগণ যদি বই খুলে দেখে তার মধ্যে কি আছে, নারীরা সাহসি হবে কিন্তু শফী সাহেবরা ভীতুই থেকে যাবেন।
ফলশ্রুতিতে শফি সাহেবদের নারীদের উপর অযৌক্তিক প্রভাব বিস্তারের একচ্ছত্র অধিকার বাধাগ্রহস্থ হবে এবং নারীরা শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে গেলে শফী সাহেবদের নারীকন্ঠে ভীত হওয়ার আশঙ্কাও থেকে যাবে।
মালার উপরের বক্তৃতার সত্যতা প্রমাণের জন্য সংক্ষেপে শফী সাহেবের অটোবায়োগ্রাফী তুলে ধরা হলো- আহমদ শফীর জন্ম ১৯৩০ সালে, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থানার পাখিয়ারটিলা গ্রামে। ১০ বছর বয়সে তিনি দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসায় ভর্তি হন। ওই বয়সে কিছুদিনের মধ্যে তিনি পিতা-মাতা উভয়কে হারান। এরপর ১০ বছর দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসায় অতিবাহিত করেন।
২০ বছর বয়সে (১৯৫১ সালে) তিনি ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসায় ভর্তি হন। তথ্যসূত্র :
Click This Link.
উপরের আলোচনার প্রেক্ষিতে যদি ফলাফল টানি তাহলে যা পাব তা হলো br /> ১. জাতীসংঘে দেওয়া মালালার বক্তব্যের বিবরণী থেকে তালেবানদের ব্যাপারে যা জানা গেলো তালেবানদের ভূমিকার সাথে আল্লামা শফীর ভূমিকার অভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। উল্লেখ্য যে-হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে তালেবানদের সাথে গোপন যোগাযোগ থাকার অভিযোগও রয়েছে।
২. যেহেতু শফী সাহেবরা বইতে কি আছে খুলে দেখেননা এবং বইকে ভয় পান সেহেতু এই ভয় তারা সমাজে গুজব আকারে অন্যদের মাঝেও ছড়িয়ে দেয়।
৩. যেহেতু শফী সাহেবদের নারী কন্ঠ শোনার অভ্যাস নেই সেহেতু তারা নারী কন্ঠকে তেতুল মনে করবে সেটাই স্বাভাবি।
দুই :
শঙ্কার কিছু ক্ষেত্র :
আল্লামা শাহ আহমদ শফী বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, বাংলাদেশ কওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড এর চেয়ারম্যান, দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদরাসার মহাপরিচালক এবং চট্টগ্রামের হাটহাজারী থেকে পরিচালিত সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এর আমীর।
১) ইসলামী চিন্তাবীদ হিসাবে যেহেতু আহমদ শফী ইসলাম প্রচারের ন্যস্ত থাকবেন সেহেতু ইসলামের অংশবিশেষের ভুল ব্যাখ্যা ইসলাম ধর্ম অনুসারীদের কাছে পৌঁছাবে যা নারী শিক্ষা বা নারী অগ্রগতীতে অন্তরায় সৃষ্টি করবে।
২) যেহেতু দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদরাসার মহাপরিচালক সেহেতু ঐ মাদ্রাসার ছাত্ররা কি শিখবে সেটা সহজেই অনুমেয়।
৩) যেহেতু বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান সেহেতু কওমী মাদ্রসাভূক্ত শিক্ষা ব্যবস্থাকে কোন ভাবেই মুলধারার শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে সংযুক্ত করা সম্ভব হবে না বা কওমী মাদ্রাসার ছাত্ররা মুলধারার ছাত্রদের সাথে প্রতিদ্বন্দীতায় টিকতে পারবেনা ফলশ্রুতিতে এই সকল ছাত্রদের ভবিষ্যৎ চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে। পরিশেষে তারাও আল্লামা শফীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে অর্থাৎ বিভ্রান্তমূলক ওয়াজ করে বেড়াবে যার প্রভাব শতকের পর শতক এদেশের মানুষকে বয়ে বেড়াতে হবে।
৪) হেফাজতে ইসলাম-এর বাংলাদেশের আমীর হওয়ায় রাজনতিতে হেফাজতে ইসলামের একটি শক্তিশালী প্রভাব আছে। তাছাড়া জাতীয়তাবাদীদলের সাথে হেফাজতে ইসলামের তেতুলীয় তাত্ত্বিকতার একটি সংঘর্ষ থাকলেও চলমান রাজনৈতীক প্রেক্ষাপটে সখ্যতা গড়ে উঠেছে। বলা হচ্ছে যে-হেফাজতে ইসলাম ইস্যুতে ও আওয়ামী সরকারের নানান ধরনের অনিয়ম ও ব্যর্থতার কারণে সর্বশেষ ৫টি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী দল সমর্থীত প্রার্থীগণকে ব্যাপক ব্যাবধানে জয়লাভ করেছে। এই ধারাবাহিকতায় যদি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে জাতিয়তাবাদী দল সরকার গঠন করে, সেখানে কোন না কোন ভাবে হেফাজতে ইলামের একটা প্রভাব থাকবে। যৌক্তিক কারণেই দেশের বিভিন্ন নীতি নির্ধারণী ব্যাপারে তাদের অংশগ্রহণ থাকবে এবং তখন দেশে তালেবানীয় শাসন ব্যবস্থার প্রভাব পড়বে।
জাতীয়তাবাদী দলটি ধর্মীয় ব্যাপারে মধ্যপন্থী হওয়ায় সেটা হবেনা বলেই আশা করছি তবে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল এই মেয়াদের মৌলবাদ শক্তির উত্থানের কথা ভুলে যাবার নয়।
৫) শফী সাহেবদের যদি চূড়ান্ত বিজয় হয়, আর আমার মেয়েকে যদি আল্লাহ আরও কম পক্ষে ১০-১২ বছর বাঁচিয়ে রাখে তাহলে কি ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়িয়ে বিয়ে দিতে হবে সেখানে গিয়ে তার স্বামীর নামের প্রভুর টাকা গুণবে? এই দেশের মানুষের আর্থিক আত্মিক উন্নয়নে কোন তার ভূমিকা থাকবে না?। ওফ! ভাবতেই জানি কেমন লাগছে!
তিন।
এইবার দেখি ইসলাম ধর্ম লেখা-পড়া বা জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে কি বলেছেন-
• "Acquisition of knowledge is binding on all Muslims, male and female." সকল মুসলীম নারী-পুরুষকে জ্ঞান অর্জন করা বাধ্যতামূলক।
• "Seek knowledge, from the cradle to the grave." দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন কর।
• "Acquire knowledge, even if you have to go to China for it." জ্ঞান অর্জনের জন্য যদি চীনেও যেতে হয়, যাও।
উপরোক্ত আলোচনাসমূহের প্রেক্ষিতে বলা যায়-শফী সাহেব ওয়াজে যা বলেছেন প্রকৃতপক্ষে ইসলাম ধর্মে বর্ণিত শিক্ষা তথা জ্ঞান অর্জন সংক্রান্ত তথ্যের সাথে সাংঘর্ষিক। তাহলে শফী সাহেব কার প্রতিনিধিত্ত্ব করছেন? ইসলামের নাকি মৌলবাদী অপ-শক্তির?
উপসংহার : যিনি (আল্লামা শফী) নারীর শিক্ষাকে ভয় পান তিনি কিভাবে ইসলামকে হেফাজত করার সাহস পাবেন?
একটি বিচ্ছিন্ন মতামত যা মালালার সম্পর্কে পড়তে গিয়ে জানলাম-
হাজার তালেবানীর বুলেটকে একজন বালিকা ভয় পায়না কিন্তু হাজার তালেবানী একজন বালিকার একটি কলমকে ভয় পায়। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।