বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা... আজ কাজী আনোয়ার হোসেনের জন্মদিন। ১৯৩৬ সালের ১৯ জুলাই ঢাকায় কাজী আনোয়ার হোসেন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম কাজী শামসুদ্দিন আনোয়ার হোসেন। ডাক নাম 'নবাব'। তাঁর পিতা প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন।
আর মাতা সাজেদা খাতুন। তাঁরা ছিলেন ৪ ভাই, ৭ বোন । ঢাকা মেডিকেল কলেজের পূর্ব সীমানায় উত্তর ও দক্ষিণ কোণে যে দুটি দোতালা গেষ্ট হাউজ এখনো দেখা যায়, সেখানেই উত্তরের দালানটিতে আনোয়ার হোসেনের ছেলেবেলা কেটেছে। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময় বাড়ি বদল করে তাঁরা দক্ষিণ দিকের গেষ্ট হাউসে চলে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের কিছু অংশ ছিল দক্ষিণ দিকে।
ড. কাজী মোতাহার হোসেন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। পরে অবশ্য তাঁরা বাসা বদল করে সেগুনবাগিচায় নিজেদের বাসায় (২৪/৪, কাজী মোতাহার হোসেন সড়ক) চলে আসেন।
১৯৫২ সালে সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে কাজী আনোয়ার হোসেন ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএ ও বিএ পাস করেন। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করেন।
পড়াশুনা শেষ হওয়ার পর তিনি রেডিওতে নিয়মিত গান গাইতে শুরু করেন। নিয়মমাফিক কোনো প্রশিক্ষণ না নিলেও তাঁদের বাড়িতে গানের চর্চা সবসময় ছিলো। তাঁর তিন বোন সানজীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন ও মাহমুদা খাতুন এখনও রবীন্দ্র সঙ্গীতের সাথে ওতপ্রতোভাবে জড়িত। তিনি ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা বেতারের সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন।
১৯৬২ সালে তিনি কণ্ঠশিল্পী ফরিদা ইয়াসমিনকে বিয়ে করেন।
কিন্তু ১৯৬৭ সালে তিনি রেডিও কিংবা টিভিতে গান গাওয়া এবং সিনেমার প্লে-ব্যাক ছেড়ে দেন। ১৯৬৩ সালে মে মাসে বাবার দেয়া দশ হাজার টাকা নিয়ে শুরু করেন সেগুনবাগিচায় প্রেসের যাত্রা। আট হাজার টাকা দিয়ে কেনেন একটি ট্রেডল মেশিন আর বাকিটাকা দিয়ে টাইপপত্র। দু'জন কর্মচারী নিয়ে সেগুনবাগান প্রেসের সেই শুরু। যা পরবর্তীকালে নাম পাল্টে হয় সেবা প্রকাশনী।
পরবর্তীতে তাঁর প্রকাশনা সংস্থা বাংলাদেশে পেপারব্যাক গ্রন্থ প্রকাশ শুরু হয়। বিশ্ব সাহিত্যের প্রখ্যাত উপন্যাসের অনুবাদ এবং কিশোর সাহিত্যের ধারাকে অগ্রসর করার কাজে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৬৪ সালের জুন মাসে প্রকাশিত হল কুয়াশা-১, যার মাধ্যমে সেগুনবাগান প্রকাশনীর আত্মপ্রকাশ ঘটে। কাজী আনোয়ার হোসেনের এক মেয়ে ও দুই ছেলে। তাঁর মেয়ে শাহরীন সোনিয়া একজন কন্ঠশিল্পী।
বড় ছেলে কাজী শাহনূর হোসেন এবং ছোট ছেলে মায়মুর হোসেন লেখালেখির এবং সেবা প্রকাশনীর সাথে জড়িত।
তাঁর অধিকাংশ উপন্যাস ও গল্প বিদেশী কাহিনীর ছায়া অবলম্বনে রচিত। তাঁর ভাষাশৈলী অসাধারণ রকমে স্বাদু। মৌলিক রচনাগুলোও চমকপ্রদ। বয়স হয়ে যাওয়ায় এখন তিনি প্রধানত সম্পাদকের কাজ করেন।
যদিও প্রকাশের ক্ষেত্রে বইগুলো তাঁর নামেই প্রকাশিত হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, যাঁরা তাঁর হয়ে লিখেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। 'মাসুদ রানা' তাঁর সৃষ্টি করা একটি কাল্পনিক চরিত্র। ১৯৬৬ সালে 'ধ্বংস পাহাড়' প্রচ্ছদ নামের প্রথম গ্রন্থটি থেকে শুরু করে সেবা প্রকাশনী থেকে 'মাসুদ রানা' সিরিজে এই চরিত্রকে নিয়ে প্রায় চার শতাধিক গুপ্তচর কাহিনীর বই প্রকাশিত হয়েছে। সিরিজের প্রথম দুইটি বই বাদে বাকিগুলো ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষার বইয়ের ভাবানুবাদ বা ছায়া অবলম্বনে রচিত।
'মাসুদ রানা'র চরিত্রটিকে মূলত ইয়ান ফ্লেমিংয়ের (Ian Fleming) সৃষ্ট জেমস বন্ড (James Bond) চরিত্রটির বাঙালি সংস্করণ হিসেবে গণ্য করা হয়।
১৯৬৯-৭০ সালের দিকে তিনি বন্ধু সাংবাদিক রাহাত খানের অনুপ্রেরণায় রহস্যপত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা নেন। রহস্য পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৭০ সালের নভেম্বরে। চারটি সংখ্যা বের হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের সময় পত্রিকাটির প্রকাশনা স্থগিত রাখা হয়েছিলো। স্বাধীনতার পর সবাই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে পত্রিকাটি প্রকাশ সম্ভব হচ্ছিলো না।
এরপর ১৯৮৪ সালে 'রহস্যপত্রিকা' আবার প্রকাশিত হয়। আজ পর্যন্ত তা অব্যাহত রয়েছে।
১৯৭৪ সালে 'মাসুদ রানা'র কাহিনী নিয়ে বাংলাদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয় (মূল ভুমিকায় ছিলেন সোহেল রানা (মাসুদ পারভেজ)। বাংলাদেশের টিভি নাটকের ইতিহাসে প্রথম প্যাকেজ নাটক 'প্রাচীর পেরিয়ে'র কাহিনী রচনা করা হয় কাজী আনোয়ার হোসেন রচিত 'মাসুদ রানা' সিরিজের 'পিশাচ দ্বীপ' নামক বই থেকে। ১৯৯৪ সালে প্রচারিত নাটক 'প্রাচীর পেরিয়ে'র নির্দেশক আতিকুল হক চৌধুরী।
ঐ নাটকের প্রধান দুটি চরিত্রে ছিলেন বিপাশা হায়াত ও নোবেল।
কাজী আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে প্রথম সমালোচনা ছিলো তিনি 'মাসুদ রানা' সিরিজে যৌনতার বেসাতি পেতেছেন। এই হাওয়ায় পাল এতোটাই উঠেছিলো যে, 'প্রজাপতি' মার্কাওয়ালা বই পড়াই এক সময় নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো বাঙালি ঘরে। যারা এসব বই পড়তো তাদেরকে দেখা হতো অন্য নজরে। এছাড়া তিনি সমালোচিত হয়েছেন, প্রায় ঢালাওভাবে বিদেশী কাহিনী ধার করে 'মাসুদ রানা'কে সচল রাখার জন্য।
১৯৭৪ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার ও সংলাপ রচয়িতা হিসেবে 'বাচসাস' পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও তিনি পেয়েছেন 'সিনেমা পত্রিকা' ও 'জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার'।
কাজী আনোয়ার হোসেন প্রতিদিন সকাল ৮ টায় ঘুম থেকে ওঠেন। আর সকাল ১০ টায় লিখতে বসেন। বর্তমানে লেখার চেয়ে সম্পাদনার কাজই বেশি করছেন।
এছাড়া রয়েছে তাঁর পড়ার নেশা। আর দিনে অন্তঃত ২ ঘণ্টা তিনি গান শোনেন। যন্ত্র সঙ্গীত তাঁর খুব প্রিয়। ছুরি আর বন্দুক সংগ্রহে তাঁর ভারী সখ। ছুরি সংগ্রহ করতে পারলেও বন্দুক সংগ্রহ করা হয়নি।
স্কুলে পড়ার সময় কাজীদা শিকাড় করতেন। বুনোহাঁস ও অন্যান্য পাখি শিকাড়ে তিনি ছিলেন খুব দক্ষ। এছাড়া কাজীদা পছন্দ করতেন কিউবার হাভানা চুরুট। মাসুদ রানা'র যমেন পছন্দ ছিল হাভানা সিগার।
কাজী দা সাক্ষাৎকার দেওয়া পছন্দ করেন না।
তাঁর বাড়িতে টেলিভিশনের ক্যামেরা নিষিদ্ধ। তবে কেউ ই-মেইল করে কোনো প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে তিনি দেরিতে হলেও সাড়া দেন। কাজীদা ব্যক্তি জীবনে ভারী নিভৃতচারী। আর তাঁর বাবা কাজী মোতাহের হোসেন ছিলেন ঠিক এর উল্টো, আড্ডাবাজ। কাজীদা'র প্রিয় বই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পদ্মা নদীর মাঝি' ও 'পুতুল নাচের ইতিকথা' এবং হুমায়ূন আহমেদের 'নন্দিত নরকে'।
কাজীদা তাঁর স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিনের সঙ্গে পরামর্শ করে বন্ধু মাসুদ করিমের নামের 'মাসুদ' আর তাঁর শৈশবের নায়ক মেবারের রাজপুত রানা প্রতাপ সিংহের নাম থেকে 'রানা' বাছাই করে তাঁর কাল্পনিক চরিত্র 'মাসুদ রানা'র নাম ঠিক করেন। আর মাসুদ রানার জন্ম দিন ঠিক করেন ৯ এপ্রিল। এই বিশেষ দিনে জন্ম নেওয়া মানুষেরা নাকি অন্যায় মেনে নেয় না, প্রতিবাদী ও বিপ্লবী হয়। হাজারো প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে তারা টিকে থাকতে পারে। আর কাজীদা নিজের মায়ের কাছে শোনা হুগলী'র কথ্য ভাষাকে বেছে নিয়েছেন লেখনি'র ভাষা হিসেবে।
কাজীদা আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ। আমি মোট তিনবার কাজীদা'র সেগুনবাগিচার বাড়িতে গিয়েছি। একবার কাজীদা'র সঙ্গে নিচতলা থেকে ইন্টারকমে কুশল বিনিময় করতে পেরেছিলাম। আমি রহস্যপত্রিকা বা বই কিনতে গিয়েছিলাম। আজ কাজীদা'র ৭৭ তম জন্মদিনে কাজীদাকে একজন অনুরাগী পাঠক হিসেবে লাখো ছালাম।
আমাদের প্রজন্মের অনেকের মধ্যে বই পড়ায় আগ্রহ সৃষ্টি করাতে কাজীদা চিরদিন হৃদয়ে থাকবেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।