আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পড়ে থাকা রক্তাক্ত কিছু দেহ আর সন্ত্রাসবাদের সেই বৃদ্ধ শকুন (ছোট গল্প)

Set sail, ye hearts~ into the sea of hope.. মধ্যপ্রাচ্যের একটি দুর্গম এলাকায় কড়া প্রহরাবেষ্ঠিত একটি দুর্গ। সেই দূর্গের অভ্যন্তরে অধিবাসীদের সভা বসেছে। খোলা চত্বরের ভেতর চাদর পেতে প্রায় শখানেক বিশ্বস্ত অনুচরদের সামনে বসে আছেন হাসান সাবাহ। এইসব অনুচরদের সংগ্রহের জন্য মুসলিম সম্রাজ্যের এপার থেকে ওপারে এতোদিন ফকিরের মতো ঘুরে বেড়াতে হয়েছে তাকে, দিনের পর দিন বিভিন্ন লাঞ্ছনা সহ্য করার পর আজ তার সামনে সুযোগ এসেছে নিজের স্বপ্ন পূরনের। “এই অভেদ্য দূর্গের ভেতর এমন এক গুপ্ত ঘাতক বাহিনী তৈরী করবো আমি, যার সামনে তামাম মুসলিম জাহানকে নতজানু হয়ে প্রানভিক্ষা চাইতে হবে…” ভাবছিলেন সাবাহ।

হঠাৎ অনুচরদের একজন দাঁড়িয়ে অন্যদেরকে নিরব হয়ে যাওয়ার ইশারা দিলো, “এখন আমাদের সকলের উদ্দেশ্যে ইমাম খুতবা পেশ করবেন…” ভৃত্যের সহায়তায় আর লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাড়ালেন সাবাহ। “হে আল্লাহর মুমিন বান্দাগন! আজকের এই দিনটার জন্যে আমি বহুদিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম। অনেক বছরের অপেক্ষার পর আজ আমাদের সামনে এখন একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি দেখতে পাচ্ছি আমি। তোমরা জানো আমাদের এই আন্দোলনের চুড়ান্ত ও সর্বশেষ লক্ষ্য হচ্ছে মুসলিম জনপদগুলোর উপর ফাসিক বাদশাহদের নেতৃত্ব সম্পুর্নরূপে নির্মূল করে তদস্থলে আমাদের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। আর এই পবিত্র লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য সকল প্রকার রন প্রস্তুতি নেয়ার আমি মনে করি এখনই উপযুক্ত সময়।

কারন যে বিপ্লবের উদ্দেশ্যে আমরা একত্র হয়েছি, তার বিরুদ্ধাচারীদের নিকেশ করতে হলে তাদের প্রতি আমাদের এমন একটা বাহিনী প্রেরন করতে হবে যার নাম শুনলে সকল বাদশাহের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। তোমরা কি তৈরী আছো সেই মহান বাহিনীতে যোগদানের জন্য?” সাবাহ চারপাশে তাকালেন। সকল অনুসারী দুই হাত তুলে সমর্থন দিলো, তা দেখে তিনি আবার কথা শুরু করলেন, “আমরা কোনো যুদ্ধে লিপ্ত হবো না, ঢাল তলোয়ার নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে শহর দখল করেও বেড়াবো না। আমরা শুধু অত্যাচারী বাদশাহ আর কাফিরদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করবো, তাদের হত্যার মাধ্যমে দুনিয়ায় ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করবো…কে আছ যে এদের হত্যা করে শহীদী মর্যাদা পেতে চাও?” উপস্থিত জনতা এবার উত্তেজিত হয়ে সকলে দাঁড়িয়ে গেলো, “আমি চাই!” “ইমাম, আমি আছি আপনার সাথে” সাবাহ এবার দুই হাত তুলে সকলকে থামিয়ে বসে পড়তে ইশারা করলেন। তারপর বললেন, “আমাদের পয়গাম পৃথিবীর সমগ্র কোনেই পৌছে যাবে, তবে সবার আগে কে প্রান উৎসর্গ করবে অত্যাচারী উজির নিজাম-উল-মূলকের রাহুগ্রাস থেকে এই দেশকে মুক্ত করতে?” অল্প বয়সী এক যুবক দাঁড়িয়ে সম্মতির চিনহ হিসেবে বুকে হাত রাখলো।

সাবাহ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “যুবক, তোমার নাম কি?” হাটু মুড়ে বসে সে উত্তর করলো “আরানি, সম্মানিত ইমাম…” “মনে রাখবে এই লোকের মৃত্যু হলো সুখের দরজা, তোমাকে নিজামের মৃত্যুদন্ড কার্যকরের দায়িত্ব দেয়া হলো। ” সাথে সাথে কুর্নিশ করে সভাস্থল ত্যাগ করলো আরানি। তার সেই যাত্রাপথের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সাবাহ, যেন রক্তের অপেক্ষায় বসে থাকা কোনো বৃদ্ধ শকুন। । 2 ।

“নাহ ইদানিং রাতের ঘুমটা একটু বেশী-ই দেরীতে হচ্ছে…” আরেক মগ কফির অর্ডার দিতে দিতে ভাবছিলো এগলেন। রাতের পর রাত এভাবে ঘুম বাদ দিয়ে ঢুলু ঢুলু চোখে সকালে অফিসে আসার কোনো মানে হয় না। চোখের নিচেও কালি পড়েছে নিশ্চই, ডেস্ক থেকে উঠে আয়নার সামনে গিয়ে দাড়ালো সে। আয়নার পেছনে জানালা দিয়ে নরওয়ের সরকারী ভবনগুলো দেখা যাচ্ছে। বিশাল আয়তনের সেই অফিসের প্রতিটি ফ্লোরে কর্মচাঞ্চল্য চোখে পড়ার মতো।

আয়নার সামনে থেকে ঘুরে জানালার পাশে এসে দাড়ালো এগলেন, খুবই ছিমছাম একটা শহর এই অসলো। এসময় অবশ্য রাস্তায় কিছুটা ভীড় থাকে, তবে অন্য সময় একেবারেই শান্ত। মোড়ের কফিশপগুলো থেকে মানুষজন বের হচ্ছে। অফিস আওয়ারে কফিশপে বসে থাকার ভাগ্য সবার হয় না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার নিজের ডেস্কে ফিরে এলো সে।

পাশে জমা করে রাখা ফাইলের স্তুপ টেনে কাছে নিয়ে আসার জন্য কেবল টান দিয়েছে, সেই মুহুর্তে বিকট শব্দে কেঁপে উঠলো পুরো ভবন। “কি! ভূমিকম্প? না এরকম তো হওয়ার কথা না…” অজানা আশঙ্কা ছেয়ে গেলো মনের ভেতর। “নিশ্চই আশেপাশের কোনো গ্যাস স্টেশনে…” ভাবতে ভাবতে জানালার দিকে চোখ পড়তেই আতকে উঠলো সে, “হায় খোদা…!” অবিশ্বাস আর ভয় মিশ্রিত অবস্থায় দেখলো সদ্য বিষ্ফোরনের ধাক্কায় সরকারী ভবনটি প্রায় ভেঙ্গে পড়ার দশা হয়েছে। যে কোনো মুহুর্তে তা আছড়ে পড়তে পারে এই ভবনের উপর। “সন্ত্রাসী হামলা…!!” আচমকা এই পরিস্থিতিতে কি করা উচিত মাথায় কিছুই আসছে না, তবে এটা সে ঠিকই বুঝতে পারছে যে প্রান বাচাতে হলে এই মুহুর্তে নিরাপদ দুরত্বে সরে যেতে হবে।

আশেপাশের রুম থেকে চিৎকার আর হুড়মুড় আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। রুম থেকে বের হয়ে দৌড় শুরু করলো এগলেন, তার অফিসের সমস্ত কলিগ আশেপাশে তারই মতো চেষ্টা করছে সেখান থেকে বের হয়ে আসার। বিষ্ফোরনের শব্দে কাচ ভেঙ্গে পড়ে আছে সারা করিডোর জুড়ে। কোনো মতে নিচে আসার পর রক্তাক্ত মানুষের দেহ চোখে পড়লো। এম্বুলেন্স আর পুলিশের গাড়ী অবিরাম সাইরেন দিয়ে যাচ্ছে।

অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে অনেক মানুষ আটকা পড়ে আছে ভেতরে। কেউ-ই কিছু বুঝতে পারছে না। প্রধানমন্ত্রীও কি মারা গেছেন? কে জানে! মধ্যপ্রাচ্যে বছরখানেক কাটিয়ে আসার পর দেশে এসে এমন ঘটনার সাক্ষী হবে তা কষ্মিন কালেও চিন্তা করেনি এগলেন। কারা করেছে এই কাজ? রাজনীতি বোঝে না সে, এসব কিছু জানে ও না। তবে সরকার-ই যে টার্গেট ছিলো তা হামলার ধরন দেখে বোঝা যাচ্ছে।

তারমানে আল কায়েদা অথবা কট্টর পন্থী খৃষ্টান কোনো জঙ্গী গোষ্ঠীর হামলা এটা? তার ভাই গানার লেবার পার্টির সক্রিয় সদস্য, তার কাছে জিজ্ঞেস করতে হবে। হঠাৎ মনে পড়লো “আরে! গানার তো পার্টির ইউথ ক্যাম্পের কাজে শহরেই আছে! ওর সাথে কথা বললেই সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে…” মোবাইল বের করে গানারের নাম্বারে কল দিতে লাগলো এগলেন। । 3 । গানার বুঝতে পারছে না তাদের কি কারনে লাইনে দাড় করানো হয়েছে, সে অন্যদের সাথে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে।

কিছুক্ষন আগে সম্ভবত বোমা হামলা বা এরকম কিছু একটা হয়েছে শহরে। তাই এই সতর্ক অবস্থা, কেউ হতাহত হয়েছে কি? কে জানে! পার্টির ভেতর থেকে সে জানতে পেরেছে কট্টরপন্থী খৃষ্টান কিছু সংগঠন এই সরকারের উদার পররাষ্ট্রনীতিকে মেনে নিতে পারছে না। তাদের ধারনা মুসলিমরা ইমিগ্রান্টের লেবাসে দেশে ঢুকছে এই দেশকে আরবদের উপনিবেশে পরিনত করার গোপন এজেন্ডা নিয়ে, আর লেবার পার্টি টাকার বিনিময়ে এই কাজে তাদের সহায়তা করছে। একজন প্রগতিশীল তরুন হিসেবে গানার জানে এই ধরনের অভিযোগ কতটা অবাস্তব আর ভিত্তিহীন। “যতসব ফ্যানটিক মানসিকতা…” বিড়বিড় করলো গানার।

“এই কারনে কেউ কিছু করে থাকলে তারাই বিপদে পড়বে, কারন নরওয়ের বেশীরভাগ মানুষই উদার মনসিকতা সম্পন্ন, কোনো প্রকার কট্টরপন্থাকে তারা সমর্থন করে না। ” ভলান্টিয়ারদের চিৎকারের শব্দে সম্বিত ফিরে পেয়ে পাশে তাকালো সে, “কিন্তু এখানে এসব কি হচ্ছে?” একজন পুলিশ অফিসার তাদের সকলকে এই লাইনে এনে দাড় করিয়েছে। “হয়তো আমাদের নিরাপত্তার জন্যে…” নিজেকে প্রবোধ দিলো গানার। কিন্তু একজন কেন? বাকীরা সব গেছে কোথায়? অফিসারের দিকে সরু চোখে তাকালো সে। চাহনীটা কেমন যেন উন্মাদের মতো, অস্বাভাবিক একটা দৃষ্টি।

কর্কশ ভঙ্গিতে কথা বলছে, যেন কোনো কারনে ভায়ানক রেগে আছে। যারা লাইনে দাড়িয়েছে তারা প্রায় সকলেই টিনএজার। ভেতরে ক্ষুব্ধ হলেও প্রকাশ করছে না। মাথা নাড়লো গানার, তার ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় বলছে দৌড়ে পালিয়ে যেতে। কোথায় যেন একটা ঘাপলা আছে এই লোকের ভেতর।

সবাইকে লাইনে এনে সেই অফিসার সামনে এসে দাড়ালো। সে কারো সাথে কথা বলছে না, কারো কোনো প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে না। আচমকা হাতের অস্ত্রের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষন করে চিৎকার করে বলে উঠলো, “সব জাহান্নামে যা, হারামির বাচ্চারা…ইশ্বরের পবিত্র ভূমিতে তোদের মতো দালালের কোনো জায়গা নেই…”। সঙ্গে সঙ্গে রাইফেলের কানফাটানো আওয়াজ, আর তীব্র যন্ত্রনায় পেট চেপে ধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে পড়তে গানার শেষবারের মতো অনুভব করলো তার মোবাইল বাজছে। কিন্তু রক্তাক্ত হাতে পকেটে হাত দিয়ে মোবাইলটা বের করার আগেই নিথর হয়ে গেলো তার দেহ।

(বাস্তবতার সাথে মিল রাখার উদ্দেশ্যে এই গল্পের চরিত্রগুলোর নাম বিভিন্ন সূত্র থেকে ধার করা হয়েছে। প্রথম অংশে হাসান সাবাহ নামে যে নেতার কথা প্রথমে বলা হয়েছে, তিনি আসলে ছিলেন ইসমাঈলীয়া গোত্রের ধর্মীয় নেতা এবং আসাসিউন নামের এক আত্বঘাতী গুপ্তসংঘের প্রতিষ্ঠাতা। তার পরিচালিত গুপ্ত হামলা গুলো এতই ভয়ংকর ছিলো যে সেসময় আসাসিউন নাম শুনলে সত্যি সত্যিই রাজা বাদশাহদের ঘুম হারাম হয়ে যেতো। আরেক চরিত্র ক্রিস্টিয়ান এগলেন অসলো হামলার একজন প্রত্যক্ষদর্শী, এবং গানার লিনাকের লেবার পার্টির তরুন নেতা যিনি ঐদিন হামলার শিকার হয়ে মৃত্যুবরন করেছেন। যখন গুলি শুরু হয় গানার তখন তার বাবার সাথে ফোনে কথা বলছিলেন, কিন্তু ঘাতকের থেকে নিরাপদ দুরত্বে সরে যাওয়ার আগেই তিনি গুলিবিদ্ধ হন।

সবশেষে সকল প্রকার সন্ত্রাসবাদের প্রতি আমার পক্ষ থেকে ঘৃনা এবং বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়ে মৃত্যুবরন করা প্রতিটি মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা রইলো। ) উইনডচাইম ব্লগ থেকে ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।