শারদশশীর অনন্ত অপেক্ষায় তোর চোখের সবুজ রঙ আকাশনীল হয়ে গেলে ঠিক ধরে নিস আমি হারিয়ে গেছি ঘাসেদের দলে...
অনিক। অনিক এলাহী। আমার বন্ধু। খুব কাছের না, কিন্তু খুব প্রিয় একজন বন্ধু। যে বন্ধুটি আজ আর আমাদের মাঝে নেই।
গত বছর ঠিক এই দিনে সে আমাদের ফেলে চলে গিয়েছে ওই ওপারে আরেকটা জগৎ আছে সেখানে!
অনিক ছিল দারুণ সদালাপী একজন মানুষ। আমি বরাবরই উল্টোটা। সহজে কারো সাথে মিশতে পারতাম না। আমি আর অনিক অবশ্য একই স্কুলে পড়তাম না। আলাদা স্কুলে পড়লেও প্রাইভেটে দেখা হত আমাদের।
প্রাইভেট শেষ করে ওদের বাসার সামনের ছোট্ট মাঠটায় ক্রিকেট খেলা হত ( যাতে প্রায়ই আমার দায়ীত্ব থাকত আম্পায়ারের। ক্রিকেট খেলাটা বেশি এনজয় করতাম না। ) ওভাবেই আমাদের পরিচয়। ওর সাথে দারুণ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। এমন সাবলীল একটা ভঙ্গি ছিল ওর ভেতর, আকৃষ্ট না হয়ে উপায় ছিল না।
নানান বিষয়ে কথা হত ওর সাথে। একদিন ও কথায় কথায় জানল আমি বাংলা ব্যান্ডের গান শুনি না। শুনিনা বলতে আসলে মেইন্সট্রিম ব্যান্ড গুলোর বাজারী গান শুনতে শুনতে আমি খুবই বিরক্ত! তখন পড়ি ক্লাস এইটে। ওর অবস্থা তখন দেখে কে! "তুই কি মানুষ!" ও যেন আকাশ থেকে পড়ল। আমি বাইরের ব্যান্ডের গান শুনি, অথচ দেশে এত দারুণ দারুণ আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ড থাকতেও আমি তাদের গান কেন শুনিনা এইটাই ওর প্রধান চিন্তা হয়ে গেল! অবশেষে যে আমার ভেতর একটা আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ড কে ইনজেক্ট করে দিতে সক্ষম হল, যে ব্যান্ডটাকে আমরা ব্ল্যাক বলে জানি।
ব্ল্যাকের গানের অদ্ভুত একটা প্রভাব আছে আমার জীবনে, এটা আমি কখনোই অস্বীকার করতে পারব না। ব্ল্যাকের সাথে আমার পরিচয় পুরোটাই অনিকের হাত ধরে। এর আগে আন্ডারগ্রাউন্ড সম্পর্কে তেমন একটা ভাল ধারণা ছিল না। কিন্তু অনিক যখন দরজাটা খুলে ধরল, সবকিছু অনেক সহজ মনে হয়েছিল।
এস, এস, সি'র পর অনিকেরা সপরিবারে ঢাকা চলে যায়।
ওখানে গিয়ে ভর্তি হয় বি এ এফ শাহীনে। আস্তে আস্তে আমাদের যোগাযোগ কমে যায়। মাঝে কোন যোগাযোগই ছিল না। এরপর হঠাৎ করেই ওকে ফেসবুকে খুজে পেলাম। অনেক দিন পর চ্যাটে অনেক কথা হল।
মোবাইল নাম্বার নিলাম। অনেক দিন পর ওকে খুজে পেয়ে ভাল লাগছিল।
অনিক অনলাইন সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত ছিল। চিটাগং নিউজ ডট অর্গ নামে একটা প্রতিষ্ঠানে যুক্তও ছিল। আর পড়ালেখা করছিল ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি তে।
কবিতা লিখত অনিক। ওর লেখা পড়ে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। দারুণ একটা শক্তি ছিল ওর লেখনীতে। আর পড়ালেখার পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেও ওর সাবলীল অংশগ্রহন ছিল চোখে পড়ার মত।
কিন্তু সৃষ্টিকর্তার মনে বোধহয় অন্য কিছুই ছিল! তিনি বোধহয় চেয়েছিলেন এই পঙ্কিলতায় ভরা পৃথিবীতে অনিক কে রাখবেন না! তাই অনিক কে তিনি নিয়ে নিলেন নিজের কাছে!
২৯ জুলাই, ২০১০।
অনিক ও তার এক বন্ধু টঙ্গী গিয়েছিল অন্য এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে। রিকশায় যাচ্ছিল তারা। একটা বেপরোয়া বাস এসে ছোট্ট রিকশাটায় ধাক্কা দেয়। অনিক ও তার বন্ধুটি ছিকটে পড়ে। রাস্তায় বিভৎস ভাবে থেতলে যায় অনিকের মাথা।
ঘটনাস্থলেই মারা যায় সে। অন্য বন্ধুটির সামান্য কাটাছেড়া ছাড়া আর কিছু হয়নি।
এর কিছুদিন আগেই অনিক রাজশাহী এসেছিল। বন্ধুদের সাথে দেখা করতে। আমার তখন পরীক্ষা চলছিল।
আমি রাজশাহী যেতে পারিনি। ওর সাথে তাই দেখাও হয়নি। ২৮ তারিখেই ওর সাথে চ্যাটে কথা হয়েছিল, অথচ ২৯ তারিখে এসে সব কিছুই একটা বিশাল প্রহসন হয়ে গেল!
ভাবছিলাম ওর শেষকৃত্যে যাব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাইনি। ওর বুদ্ধিদিপ্ত উজ্জ্বল চোখ আর হাস্যোজ্জ্বল মুখের চেহারাটাই থাকুক আমার কাছে।
"জানি হারিয়ে যাবো...জানি হারাতেই হবে...তবুও মুখ লুকাই শুভ্র মেঘে...মেঘ,আমায় উড়িয়ে নিয়ে যাও...আমি তো হারাতে চাইনা...কখনই চাইনি...আমায় লুকিয়ে রাখো তোমার শুভ্রতায়...কালো মেঘে আমার অনেক ভয়...আমার দু'চোখ বড় ক্লান্ত...আর ঝড় নয়...আর নয় দু'চোখে মুষলধারে বৃষ্টি..."
ওর কথাগুলোর মতই ও হারিয়ে গেছে আমাদের ছেড়ে। বহুদুরে। কিন্তু যখনই এটা মনে পড়ে তখনই মনে হয় আমরাই ওকে কেড়ে নিয়েছি! ওর মার বুক খালি করেছি! ওই বেপরোয়া বাসটার ড্রাইভার তো আমিও হতে পারতাম!
প্রতিভাবান মানুষরা নাকি বেশিদিন বাঁচে না! কথাটা কি খুব সত্যি???
অনিক, অনেক ভাল আছিস জানি দোস্ত! আরো অনেক ভাল থাক। অনেক ভাল। অনেক অনেক ভাল...
আপনারা সবাই অনিকের জন্য দোয়া করবেন।
আর প্রার্থনা করবেন যেন আর কাউকে এরকম অসময়ে চলে যেতে না হয়! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।