আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সমর মুখার্জি: শ্রমজীবী মানুষের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ, একটি নিখাদ কমিউনিস্ট জীবন

১৯১৩ সালের ৭ই নভেম্বর হাওড়া জেলার পুরাসে মামার বাড়িতে সমর মুখার্জির জন্ম হয়। বাবা শচীন্দ্রলাল মুখার্জি এবং মা গোলাপসুন্দরী দেবী। আমতা থানার নারিট গ্রামে ছিল তাঁদের পৈতৃক বাস। শৈশবকালেই তাঁদের পরিবার আমতা শহরে চলে আসে। প্রাথমিক শিক্ষার পর সমর মুখার্জি ভর্তি হন আমতা পীতাম্বর হাইস্কুলে।

১৯২৮ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি সাইমন কমিশন ভারতে এলে তার প্রতিবাদে সারা দেশ উত্তাল হয়ে উঠলে তার ঢেউ আমতাতেও এসে পড়ে। সমর মুখার্জি তখন স্কুলে সপ্তম‍‌ শ্রেণীর ছাত্র। পীতাম্বর হাইস্কুলে শিক্ষক-ছাত্রেরাও সেই প্রতিবাদ আন্দোলনে যোগ দিয়ে স্কুলে ধর্মঘট করেন। রাজনৈতিক আন্দোলনে সমর মুখার্জির হাতেখড়ি হলো সেখানেই। এরমধ্যেই যোগাযোগ হলো বাইনান স্কুলের শিক্ষক, কংগ্রেস আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী বিভূতিভূষণ ঘোষের সঙ্গে।

তিনি কিশোর সমরকে পড়তে দিলেন গ্যারিবল্ডির জীবনী, ডি ভ্যালেরার জীবনী, শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’-র মতো বই। দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ সমর মুখার্জি পীতাম্বর হাইস্কুলে গড়ে তুললেন ‘ছাত্র সমিতি’। প্রকাশ শুরু করলেন একটা হাতে লেখা পত্রিকারও। সাংগঠনিক নেতৃত্ব দেওয়া তখন থেকেই শুরু। ১৯৩০ সালের মার্চ মাসে গান্ধীজীর নেতৃত্বে শুরু হলো আইন অমান্য আন্দোলন।

একজন কংগ্রেস কর্মী হিসাবে সমর মুখার্জি ঝাঁপিয়ে পড়লেন সেই আন্দোলনে। তাঁর নেতৃত্বে আমতার ছাত্ররা মদের দোকানে পিকেটিং করে, বিদেশী কাপড় পুড়িয়ে আইন অমান্য করলো। ঐ বছরই ৭ই জুলাই সর্বভারতীয় ছাত্র ধর্মঘটের সঙ্গে স্কুল-কলেজ বয়কটের ডাক দেওয়া হয়েছিল। সমর মুখার্জির নেতৃত্বে পীতাম্বর হাইস্কুলে ধর্মঘট এবং গেটে পিকেটিং শুরু হয়। শাস্তি হিসাবে সমর মুখার্জি স্কুল থেকে বিতাড়িত হলেন।

তিনি তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। সমর মুখার্জি আইন অমান্য আন্দোলনে আরও সক্রিয়ভাবে নেমে পড়লেন। ব্রিটিশ পুলিস সমর মুখার্জি এবং তাঁর তুতো ভাই বারীন মুখার্জির বিরুদ্ধে ১০৭ ধারায় মিথ্যা মামলা দায়ের করে। তাঁদের এক বছর কারাদণ্ড হয়। তাঁদের প্রেসিডেন্সি জেলে আটক করা হয়েছিল।

এটাই ছিল সমর মুখার্জির প্রথম কারাবাস। মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে সমর মুখার্জি এবং বারীন মুখার্জি আদালতে পালটা অভিযোগ করেন। ফলে ছয়দিন কারাবাসের পরই তাঁরা জামিনে মুক্তি পান। ১৯৩১ সালে গান্ধী-আরউইন চুক্তির পর তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। জেল থেকে মুক্ত হয়ে তিনি লেখাপড়া চালিয়ে যাবার ইচ্ছায় আবার স্কুলে ভর্তি হবার চেষ্টা করেন।

কিন্তু খুব ভালো ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক কারণে বহিষ্কৃত ছাত্রকে কোনো স্কুলই ভর্তি করার সাহস পায়নি। এই সময়ে ১৯৩২ সালে হাওড়ার পানপুরে কৃষকদের এক সমাবেশে বিপ্লবী বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি, সমর মুখার্জিকে বলেন, ‘তুমি তো আমতার ডি ভ্যালেরা’। তিনিই তখন লেখাপড়ায় আগ্রহ দেখে বউবাজার হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক গিরীন্দ্রনাথ ব্যানার্জির কাছে তাঁকে পাঠান। গিরীনবাবু সমর মুখার্জিকে তাঁর স্কুলে দশম শ্রেণীতে ভর্তি করে নেন। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে সমর মুখার্জি সিটি কলেজ থেকে বি এ পাশ করেন এবং ইউনিভার্সিটির ল’ কলেজে ভর্তি হন।

১৯৩৩ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পরেই সমর মুখার্জি প্রথমে আমতা কংগ্রেস কমিটির সম্পাদক এবং পরে উলুবেড়িয়া মহকুমা কংগ্রেস কমিটির সম্পাদক হন। পদাধিকার বলেই তিনি হাওড়া জেলা কংগ্রেসের কার্যনির্বাহী কমিটিরও সদস্য ছিলেন। কিন্তু তিরিশের দশকের মধ্যভাগ থেকেই গান্ধীজীর আন্দোলন সম্পর্কে আরও অনেকের মতো সমর মুখার্জিরও মোহভঙ্গ হতে থাকে। ১৯৩৬ সালে রঙপুরের কমিউনিস্ট নেতা বিমল রায় হাওড়ার আমতায় অন্তরীণ ছিলেন। তাঁর সাথে সমর মুখার্জির পরিচয় হয়।

বিমল রায়ের কাছেই সমর মুখার্জি মার্কসবাদী চিন্তায় প্রভাবিত হন। ১৯৩৬ সালেই সমর মুখার্জি ছাত্র ফেডারেশনের হাওড়া শাখার সাথে যুক্ত হলেন। ১৯৩৮ সালে তিনি ছাত্র ফেডারেশনের হাওড়া শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। হাওড়ায় কয়েকজন কমিউনিস্ট ট্রেড ইউনিয়ন নেতার সাথেও সমর মুখার্জির পরিচয় হয়। হাওড়া কংগ্রেস কমিটির মধ্যে থেকে যে সব কমিউনিস্ট নেতা কাজ করতেন তাদের সাথেও তাঁর মত বিনিময় হয়।

এভাবে তিনি হাওড়ার তৎকালীন কমিউনিস্ট শৈলেন মজুমদার, অরুণ চ্যাটার্জি, নিরঞ্জন চ্যাটার্জি, বিভূতি মুখার্জি, কালী মুখার্জি প্রমুখের সাথে পরিচিত হয়ে ওঠেন। সমর মুখার্জিও শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের নতুন ধারায় যোগ দেন। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ অধ্যয়ন শুরু করেন। ট্রেড ইউনিয়ন এবং কৃষক সংগঠনের কাজে যুক্ত হন। কংগ্রেস কমিটির মধ্যে থেকেও তিনি সক্রিয় কমিউনিস্ট কর্মী হয়ে ওঠেন।

১৯৪০ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ অর্জন করেন। তখন থেকেই তিনি পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হয়ে ঘর ছেড়ে এসে পার্টির কমিউনেই আজীবন অতিবাহিত করেন। কমিউনিস্ট পার্টি-ই হয়ে ওঠে তাঁর পরিবার। ১৯৪০ সালেই কৃষকদের স্বার্থে পাটের দর বেঁধে দেবার দাবিতে আমতায় বিরাট কৃষক সমাবেশ হয়। কেশব সরকার ঐ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন।

সমর মুখার্জি এবং কালী মুখার্জি ছিলেন সমাবেশের মূল উদ্যোক্তা। ব্রিটিশ সরকার ঐ সমাবেশকে বেআইনী ঘোষণা করে ঐ তিন নেতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। কলকাতার এক সমাবেশ থেকে ফেরার পথে হাওড়া ব্রিজের উপর সমর মুখার্জি ধরা পড়ে যান। কেশব সরকার এবং কালী মুখার্জিও ধরা পড়েন। তাঁদের তিনজনকেই প্রথমে হুগলী জেলে আটক করা হয়।

ধরা পড়ার সময় সমর মুখার্জির হাতে ছিল স্তালিনের লেখা বই ‘দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’। পুলিস ঐ বই-এর বিষয়বস্তু বুঝতে না পেরে বাজেয়াপ্ত করেনি। সমর মুখার্জি ঐ বই নিয়েই হুগলী জেলে স্টাডি ক্লাস শুরু করে দেন। অন্যান্য রাজবন্দীর অনুরোধে সমর মুখার্জি স্তালিনের ঐ বইটি বাংলায় অনুবাদ করে দেন। বইটি তিনি হুগলী জেলেই রেখে যান।

হুগলী জেল থেকে সমর মুখার্জিকে দমদম জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। দমদমে সমর মুখার্জি কমিউনিস্ট কনসলিডেশন গ্রুপের মধ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠেন এবং শীঘ্রই গ্রুপের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। জেলের মধ্যে তিনি এঙ্গেলসের ‘অ্যান্টি-ডুরিং’ পড়ে ফেলেন এবং মার্কসীয় দর্শনের উপর ক্লাস পরিচালনা করেন। অত্যন্ত গোপনেই জেলের মধ্যে ঐ সব পাঠচক্রের ব্যবস্থা করতে হতো। ১৪ মাস কারাবাসের পর ১৯৪১ সালে সমর মুখার্জি মুক্তি পান।

কিন্তু তার পরেও তিনমাস তাঁকে আমতায় অন্তরীণ হয়ে থাকতে হয়। সেই সময় দিনে দু’বার থানায় গিয়ে তাঁকে হাজিরা দিয়ে আসতে হতো। অন্তরীণকাল শেষ হতেই সমর মুখার্জি হাওড়া শহরে এসে আত্মগোপন করে পার্টি সংগঠনের কাজে লেগে পড়েন। সালকিয়ায় হোসিয়ারি শ্রমিক ইউনিয়নের একটি গোপন আস্তানায় থেকে সমর মুখার্জি পার্টি গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ঐ সময় পার্টিতে তাঁর নাম ছিল ‘মণি’।

১৯৪২ সালের জুলাই মাসে পার্টির রাজ্য নেতৃত্ব হাওড়ায় পার্টির অর্গানাইজিং কমিটি গঠন করে সমর মুখার্জিকে আহ্বায়কের দায়িত্ব দেয়। পরে ঐ বছরেই পার্টির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হলে প্রকাশ্যে কাজ শুরু হলে জেলা কমিটি গঠিত হয় এবং সমর মুখার্জি জেলা কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৩ সাল থেকেই পার্টির সংগঠন এবং আন্দোলনের দ্রুত প্রসার হতে থাকে। গোটা হাওড়া জেলায় সমর মুখার্জি কমিউনিস্ট পার্টির জনপ্রিয় নেতা হয়ে ‍‌ওঠেন। ১৯৪৩ সালে বোম্বাইতে অনুষ্ঠিত পার্টির প্রথম কংগ্রেসে সমর মুখার্জি যোগ দেন।

স্বাধীনতা আন্দোলনকে দ্বিধাবিভক্ত করতে ব্রিটিশ শাসকদের প্ররোচনায় মুসলিম লিগ পাকিস্তানের দাবিতে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দিলে সারা দেশে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। হাওড়ায় সমর মুখার্জি দাঙ্গা প্রতিরোধে রাস্তায় নেমে তিনি হিন্দু, মুসলিম উভয় দাঙ্গাবাজদের দ্বারাই আক্রান্ত হন। তখন ঈশ্বর দত্ত লেনের পার্টি অফিসে সমর মুখার্জিসহ অন্য নেতারা থাকতেন। সেখানে মুসলিমদের আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে এই অভিযোগ তুলে হিন্দু মহাসভার দাঙ্গাবাজরা পার্টি অফিস আক্রমণ করে। তাদের আক্রমণে সমর মুখার্জির মাথা ফেটে যায়।

আবার মুসলিম লিগের দাঙ্গাবাজরাও তাঁকে ছুরি মারার চেষ্টা করে। কিন্তু কাঁধে রাখা ওয়াটারপ্রুফে ছুরি গেঁথে যাওয়ায় তিনি রক্ষা পান। স্বাধীনতার পর ১৯৪৮ সালের ২৬শে মার্চ কমিউনিস্ট পার্টি আবার নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। এবার কংগ্রেস সরকার দ্বারা সমর মুখার্জি কারারুদ্ধ হলেন। হাওড়ার জি টি রোডে তৎকালীন পার্টি কমিউন থেকে ভারতরক্ষা আইনে সমর মুখার্জিকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তিন মাস পর মুক্তি পেয়ে তিনি পার্টি সংগঠন গড়ার জন্য আত্মগোপন করেন। ঐ সময়ে পুলিসের চোখে ফাঁকি দিয়ে নানা বিপদ ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি সমগ্র জেলায় পার্টি সংগঠন গড়ে তোলেন। গ্রেপ্তার এড়াতে একবার সাঁতরাগাছি স্টেশনে চলন্ত ট্রেন থেকে পড়ে গিয়ে বিস্ময়করভাবে বেঁচে যান। ১৯৫৩ সালে সমর মুখার্জি কমিউনিস্ট পার্টির রাজ্য পরিষদের সদস্য হন এবং রাজ্য কেন্দ্রে পার্টির কাজে যুক্ত হন। উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের দাবিতে আন্দোলনেও তিনি তখন থেকেই যুক্ত হন।

১৯৫৬ সালে কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্তের আহ্বানে সমর মুখার্জি ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকার প্রচার বৃদ্ধির দায়িত্ব নেন। বিভিন্ন জেলায় পত্রিকার প্রচার বৃদ্ধির জন্য তিনি উদ্যোগ নেন। ১৯৫৭ সালে সম্মিলত কেন্দ্রীয় বাস্তুহারা পরিষদের (ইউ সি আর সি)-র ডাকে উদ্বাস্তু আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি কারারুদ্ধ হন। সমর মুখার্জি ১৯৬০ সালে ইউ সি আর সি-র সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। আজীবন তিনি সেই দায়িত্বে থেকে রাজ্য এবং রাজ্যের বাইরে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন।

সংসদের মধ্যেও তিনি উদ্বাস্তু সমস্যাকে জোরালোভাবে তুলে ধরেন। ১৯৫৭সালে বিধানসভা নির্বাচনে উত্তর হাওড়া কেন্দ্র থেকে তৎকালীন বিধানসভার অধ্যক্ষ এবং কংগ্রেস নেতা শৈল মুখার্জিকে পরাজিত করে সমর মুখার্জি বিজয়ী হন। তিনি ১৯৬২ সাল পর্যন্ত বিধানসভার সদস্য ছিলেন। ১৯৬১ সালে বর্ধমানে অনুষ্ঠিত অবিভক্ত পার্টির শেষ রাজ্য সম্মেলনের পর তিনি পার্টির রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই সময়ে যে আন্তঃপার্টি এবং মতাদর্শগত সংগ্রাম চলছিলো সেই সংগ্রামে সমর মুখার্জি মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বিশুদ্ধতা রক্ষায় অবিচল থেকে সংশোধনবাদ ও সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।

১৯৬২ সালে ভারত-চীন সীমান্ত সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে কংগ্রেস সরকার কমিউনিস্টদের উপর নির্যাতন নামিয়ে আনে। পার্টির মধ্যেকার মার্কসবাদী বিপ্লবী অংশের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। সমর মুখার্জির বিরুদ্ধেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। পার্টি নেতৃত্বের বিপ্লবী অংশের নির্দেশে সমর মুখার্জি গ্রেপ্তারি এড়িয়ে গোপনে পার্টি সংগঠনের কাজে ব্রতী হন। ১৯৬২ সালের ২২শে নভেম্বর পুলিস আমতার পুলিসকে ফাঁকি দিয়ে বাড়ির পাঁচিল টপকে গ্রেপ্তার এড়িয়ে যান এবং আত্মগোপন করেন।

পার্টির তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত, মুজফ্‌ফর আহ্‌মদসহ পার্টি নেতৃত্বের বিপ্লবী অংশের বেশিরভাগ অংশ গ্রেপ্তার হয়ে যাওয়ার ফলে সংশোধনবাদী নেতৃত্ব ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকা এবং পার্টির রাজ্য পরিষদের দখল নিয়ে নেয়। সেই সময় পার্টির মার্কসবাদী-লেনিনবাদী অংশের নির্দেশে সমর মুখার্জির নেতৃত্বে পার্টির গোপন রাজ্য কমিটি গঠিত হয়। সমর মুখার্জি হন পার্টির গোপন রাজ্য কমিটির সম্পাদক। আটক পার্টি নেতৃত্বের সাথে গোপন যোগাযোগের মাধ্যমে সমর মুখার্জি তখন রাজ্যব্যাপী বন্দীমুক্তি আন্দোলন এবং পার্টি সংগঠন গড়ে তুলতে থাকেন। পার্টির দক্ষিণপন্থী সংশোধনবাদী অংশ ‘স্বাধীনতা’র দখল নিয়ে নেওয়ায় পার্টির বিপ্লবী অংশের সেই সময় কোনো মুখপত্র ছিলো না।

সেই সময় হাওড়ার কয়েকজন কমরেডের উদ্যোগে ‘হাওড়া হিতৈষী’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ হতে থাকে। সমর মুখার্জি উদ্যোগ নিয়ে ১৯৬৩ সালের ১৫ই আগস্ট ‘হাওড়া হিতৈষী’-র নাম পালটে ‘দেশহিতৈষী’ পত্রিকায় রূপান্তরিত করেন এবং এই পত্রিকা তখন পার্টি সংগঠন গড়ে তোলা ও মতাদর্শগত প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। ১৯৬৩ সালের শেষের দিকে আটক নেতৃবৃন্দ একে একে মুক্তি পেতে থাকেন। আত্মগোপনে থাকার প্রয়োজনও তখনকার মতো শেষ হয়। সমর মুখার্জিও আত্মগোপন অবস্থা থেকে প্রকাশ্যে আসেন।

কিন্তু সেই অবস্থা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৬৪ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে কলকাতায় অনুষ্ঠিত পার্টির সপ্তম কংগ্রেসের প্রাক্কালে প্রমোদ দাশগুপ্ত, মুজফ্‌ফর আহম্‌দ, হরেকৃষ্ণ কোঙার প্রমুখ নেতৃবৃন্দের সাথে সমর মুখার্জিকেও গ্রেপ্তার করে আটক করা হয়। দীর্ঘ কারাবাসের পর ১৯৬৬ সালে অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে সমর মুখার্জিও মুক্তি পান। ১৯৬৬ সালে সমর মুখার্জি সি পি আই (এম)-র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। ১৯৭৮ সালে জলন্ধরে অনুষ্ঠিত পার্টির দশম কংগ্রেসে তিনি পলিট ব্যুরোয় নির্বাচিত হন এবং ১৯৯২ সালে মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত পার্টির চতুর্দশ কংগ্রেস পর্যন্ত তিনি পলিট ব্যুরোর সদস্য ছিলেন।

চতুর্দশ কংগ্রেসে তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল ক‍‌মিশনের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। অত্যন্ত কঠোরভাবে সমর মুখার্জি ঐ দায়িত্ব পালন করেন। সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সাথে সাথে পার্টিতে সঙ্কীর্ণতাবাদের বিরুদ্ধেও মতাদর্শগত সংগ্রাম ১৯৬৬ সালেই শুরু হয়। সেই সংগ্রামে সমর মুখার্জি অংশগ্রহণ করেন। সংশোধনবাদ যে প্রধান বিপদ সে কথা মনে রেখেই সঙ্কীর্ণতাবাদী ঝোঁকের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম শুরু হয়।

‘দেশ‍‌হিতৈষী’ পত্রিকায় ১৯৬৬ সালের শেষের দিকেই ‘অশোক মুখার্জি’ ছদ্মনামে তাঁর লেখা ‘সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও সঙ্কীর্ণতাবাদী ‘ঝোঁক’ ধারাবাহিক তাত্ত্বিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ১৯৭০ সালে ‘সেন্টার অব ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়নস’ (সি আই টি ইউ) গঠিত হলে সমর মুখার্জি সংগঠনের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে তিনি সি আই টি ইউ-র কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হন। ১৯৭৯ সালে তিনি সংগঠনের কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৮৩ সালে কানপুরে অনুষ্ঠিত সম্মেলন থেকে সমর মুখার্জি সি আই টি ইউ-র সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৯১ সাল পর্যন্ত তিনি ঐ দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৭৪ সালে সারা ভারত জুড়ে ২০ লক্ষ রেল-শ্রমিক-কর্মচারী ঐতিহাসিক, অভূতপূর্ব রেল ধর্মঘট পালন করেন। এমন ঐক্যবদ্ধ, শক্তিশালী রেল ধর্মঘট ভারতের ইতিহাসে আর কখনও হয়নি। সে‍‌ই ঐতিহাসিক রেল ধর্মঘটের অন্যতম প্রধান সংগঠক এবং নেতা ছিলেন সমর মুখার্জি। ধর্মঘট ভাঙার জন্য ইন্দিরা গান্ধীর স্বৈরাচারী সরকার চরম দমন-পীড়নের পথ নিয়েছিল।

হাজার হাজার রেল শ্রমিককে ছাঁটাই করা, গ্রেপ্তার করা, রেল কোয়ার্টার থেকে উচ্ছেদ করা, এমন কি রেল কলোনি জুড়ে মহিলাদের উপর সি আর পি দিয়ে অত্যাচার চালানো কোনো কিছুই বাদ থাকেনি। চরম অত্যাচারের মুখে ৮দিন ধর্মঘট চলার পর তা প্রত্যাহৃত হলেও এই আন্দোলন গোটা দেশের শ্রমিকশ্রেণীকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। রেল ধর্মঘট চলাকালীন ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের উপর আলোচনায় সমর মুখার্জি রেল শ্রমিকদের আন্দোলনের দাবি-দাওয়া তুলে ধরে সরকারের দমন-পীড়নের প্রতিবাদ করে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। সংসদীয় রাজনীতিওে সমর মুখার্জি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন। একজন কমিউনিস্ট হিসা‍‌বে বুর্জোয়া সংসদকে কিভাবে ব্যবহার করতে হয় সমর মুখার্জি সেই শিক্ষা রেখে গেছেন।

জনগণের দাবি-দাওয়া এবং সংগ্রামকে সংসদীয় লড়াইয়ের সাথে যুক্ত করে তিনি বারে বারে বুর্জোয়া শাসনের মুখোশ খুলে দিয়েছেন। সমর মুখার্জি প্রথম হাওড়া কেন্দ্র থেকে লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে। তারপর ১৯৭৭ ও ১৯৮০ সালে তিনি একই কেন্দ্র থেকে পুনর্নির্বাচিত হন। পরে ১৯৮৬-১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন। দীর্ঘদিন তিনি সংসদে সি পি আই (এম) দলের নেতা ছিলেন।

সমর মুখার্জি সরকার এবং বিরোধী উভয় পক্ষের সাংসদদেরই বিশেষ শ্রদ্ধা ও মর্যাদা অর্জন করেছিলেন। শুধু সংসদের বাইরে শ্রমিক-কৃষক-কর্মচারী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া নয়, সংসদের মধ্যেও সমর মুখার্জি সেই সংগ্রামের বার্তা সোচ্চারে সাফল্যের সাথে তুলে ধরতেন। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের প্রতি কেন্দ্রের বঞ্চনা, তাদের পুনর্বাসনের সমস্যা এবং দাবি তথ্যসমৃদ্ধ বক্তৃতায় তিনি তুলে ধরেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর স্বৈরতান্ত্রিক জরুরী অবস্থার শাসনের বিরুদ্ধে, তাঁর ‘গরিবী হঠাও’ স্লোগানের অসারত্ব সমর মুখার্জি তথ্যের সাহায্যে তীক্ষ্ণভাবে আক্রমণ করেছিলেন, কংগ্রেসী সমাজতন্ত্রের প্রকৃত রূপ বারে বারে তাঁর যুক্তিনিষ্ঠ ভাষণের মাধ্যমে তিনি উন্মোচিত করেছেন। সমর মুখার্জি সংসদীয় দলের প্রতিনিধি অথবা পার্টি প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, উত্তর‍‌ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, জাপান, আফগানিস্তান, ফ্রান্স, ইতালি, কিউবা, পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সফর করেছেন।

সেই সব দেশের পার্টি নেতা, রাষ্ট্রনেতাদের সাথে মতবিনিময় করেছেন, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি হিসাবে যোগ দিয়ে ভাষণ দিয়েছেন। ১৯৭৭ সালে কেন্দ্রে জনতা পার্টির সরকার গঠিত হবার পর সংসদীয় দলের প্রতিনিধি হয়ে সমর মুখার্জি প্যারিসে অনুষ্ঠিত শান্তি সম্মেলনে যোগ দেন এবং সম্মেলনে প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে ভাষণ দেন। সম্মেলনে প্যালেস্তাইন সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য যে কমিশন গঠিত হয়েছিল তিনি সেই কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৮২ সালের হাভানায় অনুষ্ঠিত দশম বিশ্ব ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসে তিনি সি আই টি ইউ’র পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৮৫ সালে ‘পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব আফগানিস্তান’-এর (পি ডি পি এ) আমন্ত্রণে পার্টি প্রতিনিধিদলের নেতা হিসাবে সমর মুখার্জি নয়দিনের সফরে আফগানিস্তান যান।

সেখানে আফগানিস্তানের পার্টি নেতা এবং রাষ্ট্রনেতাদের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ আলোচনা হয়। ‘পি ডি পি এ’-র সাধারণ সম্পাদক এবং তৎকালীন আফগানিস্তানের বিপ্লবী কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট বাবরাক কারমাল-এর সাথেও তিনি মতবিনিময় করেন। নয়ের দশ‍‌কের শেষের দিক ‍‌থেকেই সমর মুখার্জি মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। তাঁর শরীর ভাল যাচ্ছিল না। অসুস্থতা ‍‌নিয়েই তিনি ২০০০ সালে ত্রিবান্দ্রমে পার্টির বিশেষ প্লেনামে যোগ দেন।

২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি গুরুতর হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তাঁর বুকে ‘পেস মেকার’ বসাতে হয়। অসুস্থ হলেও তাঁর মন ছিল অত্যন্ত দৃঢ়। সেবছর মার্চ মাসে হায়দরাবাদে অনুষ্ঠিত পার্টির সপ্তদশ কংগ্রেসে তিনি অসুস্থতাকে তুচ্ছ করেই যোগ দেন। পরে আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন।

২০০৫ সালে পার্টির অষ্টাদশ কংগ্রেসের শুরুতে রক্তপতাকা উত্তোলন করেন সমর মুখার্জি। ২০১২ সালের ৭ই নভেম্বর ১০০তম জন্মদিনে পার্টির পক্ষ থেকে তাঁকে সংবর্ধিত করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভূগছিলেন। বুধবার রাতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে একটি বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

শেষ হলো শ্রমজীবী মানুষের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ, নিখাদ কমিউনিস্ট একটি সংগ্রামী জীবনের। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।