আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মা'হীন নরকে

আজ আমার অনেক খুশির দিন, ধবধবে সাদা সুগন্ধীযুক্ত কাপড়ে ঘুমিয়ে। জীবনে এই প্রথম বারের মত নতুন কাপড় পড়তে পেরে আমার আনন্দের শেষ নাই। আমি নেচে চলেছি নতুন কাপড় আর সুগন্ধির আনন্দে। চারিদিকে নিরবতার মাঝে অচেনা এই লোকগুলো আমার দিকে ব্যথা ভারা হৃদয়ে কেন তাকাচ্ছে? আমার তো অনেক অনন্দের দিন আজ, আমি উড়তে পারব বিহঙ্গের মত, ছুটে যেতে পারব আমার মায়ের কোলে যেখানে রয়েছে অফুরন্ত নির্ভেজাল ভালবাসা যার কোন শেষ নাই। মাকে আমার জন্য আর এ বাড়ীতে এসে বাবার হাতে ধরা পড়ে গরু পেটানো লাঠির পিটুনি খেতে হবে না।

আমিই যাব যখন ইচ্ছে তার কাছে তার হয়ে। আমার বাবাকেও বেশ খুশি দেখাচ্ছে আজ, ওহ কি আনন্দ, আমি আজই আমার বাবাকে খুশি দেখলাম আমাকে দেখে, আমার সৎ মায়েরও আজ থেকে অনেক কষ্ট লাঘব হল, তার ৮টি সন্তানের মাঝে আমি বড্ড বেমানান হয়ে খাবারের জন্য কান্নাকাটি করতাম, প্রসাব করে তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম যদি দয়া হয় সেই আশায়। মাতৃত্বের আবর্তে তিনি কখন আমার প্রতি একটু সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিলে আনন্দিতই হতাম ক্ষনিকের জন্য হলেও, যখন মাটির মধ্যে ছোট্ট মাদুরে বসাতে গিয়ে একটু জোরেই ফেলে দিতেন তখন ক্ষনিকের তরে কান্না পেলেও আহলাদিত হয়ে হেসে দাঁত বের করে দেখাতাম কিছু সময় পরই ভেজা জায়গা থেকে তুলে একটু শুকনা জায়গায় বসিয়েছে বলে। মনে মনে আল্লাহকে অনেক ধন্যবাদ দিতাম এইটুকু সহানুভূতি পেয়ে। গত কাল যখন ঘুমায় তখন পিঠে বেশ ব্যথা ছিল, বাবা ছুড়ে মেরেছিল বিছানার এক কোনায় তাই বুঝি আজ উঠতে পারছি না, সৎ মা আমার সামনে ভাত দিয়েছিল আমি নিজে খেতে পারিনি বলে হাত মুচড়ে দিয়েছে গতকাল দুপুরেই তাই হাতটা কেমন অবশ হয়ে আছে, আমি তো হাঁটতে পারতাম গুটিগুটি পায়ে, কখনও কখনও দৌড়েছি বটে কিন্তু কিজানি কিজানি এক কারণে আর হাঁটতে পারতাম না অন্যের সাহায্য ছাড়া।

তাই নিরব শুয়ে আছি সাদা কাপড় মুরে, চেয়ে আমি আগতদের প্রাণে। আগত বলতে অবশ্য আশে পাশের কিছু লোক। মা এসেছে, আছে বাড়ীর বাইরে, তাকে ঢুকতে দেয়া হয় নাই। ঢুকতে দেবেই বা কেন? সে যে আমার বাবার তালাক প্রাপ্ত বউ। আমার মা ক্ষুধার যন্ত্রনায় এ বাড়ীতে কাজ করত দুমুঠো খাবারের আশায়, আর তার মা আর বোনদের জন্য কিছু ভাঙ্গা চালের আশায়।

কিন্তু আমার বাবা অনেক হিসেবি মানুষ, তার বাড়ীতে একজন কাজের লোক দরকার হয় যখন নতুন ধান ওঠে, ওঠে কলায় মসুরি গম। সেসময়ই আমার মায়ের মত কোন মেয়ে বা মহিলাকে কাজে নিতে হয় তার বাড়ীর সদস্যদের সাহায্যার্থে। আর এই সময়গুলোতে সব কৃষকের কাজ একসাথে চাপে তাই আমার মায়েদের মত লোক পাওয়া মুশকিল। আর চাহিদা থাকে একটু বেশী বলে কাজ শুরুর আগেই ঠিক করে নিতে হয় কত কাঠা ধান দিবে বা চৈতালী ফসল দিবে। আমার মা'ও ঠিক করে নিয়েছিল।

প্রথম মাস কাজ করার পর আমার বাবা খুদে গমও দিয়েছিল আমার নানীকে ১ কাঠা মায়ের সাথে এসে কাজে হাত লাগিয়েছে বলে। আমার মায় এই বাড়ীতে অবিবাহিত কোন মেয়ে কাজে যোগদান করেছে। দেখতে শুনতে একেবারে খারাপ না কিন্তু মা। গায়ের রং কালো হলেও উঠতি যৌবন, বাঘের শক্তির দেহ দিয়ে কাজ করে চলে সকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি। মায়ের যৌবনে বাবার আবদার ছিল বেশ, বলেছিলও অনেক করে, মা রাজি হয় নাই কোনদিন।

বাবা অনেক চাপাচাপি করেছে মাকে রাতে থাকতে, মা গরীব ঘরে হলেও বাবার আবদার রাখতে পারবে না বলে চলে যেত সন্ধ্যে হলেই মায়ের খরের কুটিরে। জোর করবে? মায়ের তেজী দেহ দেখে কখনও সে সাহস করে ওঠে নাই। চৈতালী তোলা শেষে আমার বাবা দেখলেন তাকে বেশ পরিমাণ গম আর দিতে হবে। আমার বাবা চিন্তায় পড়ে গেলেন কি ভাবে আটকানো যায়। কু-বুদ্ধিতে আমার বাবা গ্রাম সেরা, তিনি আমার মাকে বিভিন্ন ভাবে বিয়ের প্রলোভন দেখাতে লাগলেন, চৈতালীর সময় পার হলেও কাজ থেকে বিদেয় না করে তাকে আরো কিছুদিন কাজ করতে বললেন।

ধমকের বদলে মিষ্টি সুরে কথা বলতে লাগলেন, সুযোগ পেলেই স্বপ্ন দেখাতে লাগলেন, বিয়ের পর জমিও লিখে দিবেন বললেন। আমার মা এত বেশী চালাক না আর নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে রাজি হয়ে গেলেন। আমার বাবা একদিন কাজি ডেকে আমার বড় মায়ের উপস্থিতিতেই বিয়ে করলেন। স্বাক্ষী হিসেবে ছিল তারই কিছু লোকজন। আমার বাবার বেশ লাভ হল, শরিয়া মোতাবেক আমার মায়ের সাথে থাকার সুযোগ পেল আর বিনে পয়সায় একজন কাজের মহিলাও পেয়ে গেলেন।

এভাবে প্রায় ৬ মাস চলে গেলে কোন এক ফাঁকে আমি চলে এলাম আমার মায়ের গর্ভে। বাবা শুনে অগ্নি মূর্তি হয়ে গর্ভপাতের জন্য চাপাচাপি করলেন বেশ, কিন্তু ততো সময়ে অনেক দেরি হয়ে গেছে বলে আমি থেকে গেলাম মায়ের গর্ভেই। একদিন আর পাঁচটি শিশুর মত জন্ম নিলাম, কান্নাকাটি করে একাকার করে এই পৃথিবীতে। আমার মা খুশি হলেও আমি আমার মায়ের কাল হয়ে দাঁড়ালাম, আমি কন্যা বলে বাবা মারার চেষ্টা করেছে বেশ মায়ের চোখে চোখে রাখার জন্য হয়ে ওঠেনি কখনও। বাবা চাইলেন মাকে তাড়াতে তাই পান থেকে চুন খুললেই পিঠে পড়ত বাড়ী।

মা আমার বড়ই মায়বতী ক্ষুধার্ত এক নারী। সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে সহ্য করে গেলেন বেশ। যখন কোন অবস্থাতেই মা আমার স্বেচ্ছায় চলে গেল না তখন বাবা তালাক দিলেন একদিন। আমি ততো দিনে ১৩ মাসের প্রায়। মা আমাকে সাথে নিয়ে বের হলেন নানার ছোট্ট কুটিরে।

বাবাও ছেড়ে দিয়েছিল, কিন্তু কিজানি কি ভেবে, পরের দিন গিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে আসলেন মায়ের কোল থেকে। মা আমার কেঁদেকেটে বাবার পায়ে ধরিছিল বেশ, কিন্তু আমার বাবা অনেক নিষ্ঠুর বলেই পরিচিতি এই গ্রামে, তিনি আমাকে নিয়ে এলেন জোর করে। আমি কেঁদেছিলাম ভয়ে, বাবার ধমক আর থাপ্পর খেয়ে থেমে গিয়েছিলাম আরেক ভয়ে, বাবা ফেলে দিয়েছিল একদিন কোমড়ে আঘাত পেয়ে আমি অন্যের সাহায্য ছাড়া হাঁটতে পারতাম না। আমি ভাত খেতে পারতাম না ঠিক মত, তারপরও আমার বাবা আমাকে বড় হতে হবে বলে ভাত খেতে দিতেন, দুধে এলার্জি তাই দুধ খেতে দিত না কখনও। মাছ মাংস সেটি তো আমার ৮ দাঁতে খাওয়া সম্ভব ছিল না বলে পাতে জুটত না কখনও কারণ আমিই নিজে খেতে পারিনা নিজ হাতে লবণ দিয়ে মেখে দেয়া ভাত খেতে সময় চলে যায় অনেক সেখানে মাছের কাঁটা বেছে দেবে কে আবার।

আমার সাথি ছিল অনেক গুলো মশা মাছি, তারা আমার সাথে খাবার খেত, কিন্তু খেয়ে কমাতে পারত না আমার খাবার কখনও। আমি ওদের জন্য রেখে দিতাম খাবার, চেয়ে দেখতাম ওদের মুক্ত মনে উড়ে চলা। আমার বাবা বসত পাটিতে সাথে অন্যান্য ভাইবোনেরাও কিন্তু প্রকৃতি আমার ভাল লাগে তাই আমার ঠাই হত সর্বদাই মাটিতে। কখনও কখনও টিনের বাক্সের তলা ঘেটে ছেড়া ব্যবহৃত প্যান্ট খুজে পেলে আমাকে পড়িয়ে দিত আমার বড় বোন যার বিয়ে হয়েছে বেশ দূরে। উনি এ বাড়ীতে আসলেই মাঝে মাঝে ভাত খাইয়ে দিতেন হাতে, তাও যদি বাবা না থাকত বাড়ীতে, তখন মায়ের কথা বড্ড মত পড়ত বেশ, কিন্তু বলা শিখি নাই বলে বলতে পারতাম না বোনকে।

গোসলও করাতো বেশ পরিষ্কার করে, কপালে টিপ পড়াতেন কাজলের হয়ত উনার গায়ের রংয়ের মত কৃষ্ণ বর্ণ ছিল বলেই আমাকে আদর করত বেশ অথবা উনার অনাগত সন্তানের কথা ভেবে হয়ত। আস্তে আস্তে আমি নিস্তেজ হয়ে পড়লাম কেন জানি না, ঠান্ডা হল আমার একদিন আপনা আপনিই ঠিক হল, জ্বর হল সেটিও গেল। উহু কি আনন্দে ভরা ছিল আমার জীবন। উহু মুখে রোদ লাগছে বেশ। বাইরে হাউ মাউ কের কে কেঁদে চলেছে? আমার মায়ের গলা মনে হয়, হ্যাঁ মা কেঁদে চলেছে, কিন্তু কেন? উপস্থিত মাওলনা সাহেবে কোথায় গেল? একি মা আর নানী খালারা কেন এ বাড়ীতে? বাবা কোথায়? তিনি তো মারবে আমাকে ও তাদের।

একি মা তুমি আমার গায়ের উপর পড়ছ কেন? এত জোরে কাঁদছো কেন? চোখের জলেই বা কেন আমার সুন্দর সাদা পোষাক ভেজাচ্ছ? সরো, আমার ব্যথা লাগছে, তুমি বরং আমার পাশে বসো, নানী তুমি আমার মাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছ কেন? থাক কিছু সময় আমার পাশে। ওহ বাবা তুমি এলে? যাক বাঁচা গেল কান্নাকাটি গেছে। একি তুমি আমায় কোলে নিচ্ছ আজ, হুররে কি আনন্দ আমি আমার বাবার কোলে? কেন তুমি আমাকে কোলে নাওনি এতদিন। ওহ মুখটা ঢেকে দাও রোদ লাগছে বেশ। কি ব্যপার? তুমি বাঁশ বাগানের দিকে নিয়ে যাচ্ছ আমাকে তোমার কোলে নিয়ে? বাবা তুমি আমাকে কোলে নিয়ে হঁটছো? ওহ আমার জীবন আজ স্বার্থক, তুমি আমাকে কোলে নিলে।

একি রাগ করলে কেন, বাবা তুমি আমাকে দিয়ে দিলে দাড়িওয়ালা এই ভাড়া করা লোকটির কোলে? সেকি এই মাওলানা তুমি আমায় কোথায় শোয়াচ্ছ, এই বাঁশ বাগানের কোনে গর্তে কেন? বাহ গর্তটা তো সুন্দর করেছো, বেশ তেল তেলা সমান আমি কি এখানে ঘুমাবো? বাহ বেশ দারুণ বিছানা, অনেক সমান, জানো তালের পাটিতে ঘুমাতে ঘুমাতে পিঠ যে আমার গেছে, বিছানাটা বেশ আরামের মুখের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে বেশ ভালই করলে, অসস্তি লাগছিল আমার। একি তোমরা আমার ঘরের উপরি বাঁশ বিছিয়ে দিচ্ছ কেন? ও-হো মাটিও দিচ্ছ আমার আরাম করে ঘুমানোর জন্য। তোমরা অনেক ভাল, তোমাদের পৃথিবীর মানুষগুলোকে আমি আর্শীবাদ করি তোমরা সুখে থাক, এখন বরং তোমরা যাও আমি একটু আরাম করে ঘুমায়। জীবনে তো এরকম সুন্দর বিছানা কাপড় পাইনি। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.