[ যারা বন্ধু নয়, তাদের জন্য, এবং যারা বন্ধু, তাদের জন্যও]
অনিশ্চয়তার সঙ্গীতময় উদ্ভাসন যা এক ছদ্ম-নিশ্চিতির সংবেদ-সজীবতাকে ছড়িয়ে দেয় আমাদের পাঠক চেতনায়, সেই সংবেদ-প্রজ্ঞার রূপঋদ্ধ ভাষিক জ্যামিতিই মাঝে মাঝে মনে হয় কবিতা। তো অনিশ্চিয়তার সঙ্গীতময় উদ্ভাসন আসলে সেই প্রকীর্ণ বাস্তবতা যা আমার সত্তার চেয়ে অধিক এবং অহংয়ের সক্রিয় ও বিধ্বস্ত হওয়ার কারণ। আর সঙ্গীত আসলে বাসনার ক্ষণ-তৃপ্তি। আহা বাস+না, যেখানে বাস করা যায় না, বা কেবলই যেদিকে আমরা ছুটে যেতে চাই, যাই, যেতে থাকি, ক্ষণ-ত্রাণের আশ্বাসে। বা অহংয়ের তীর্থ যা কেবল সরে সরে গেলেও এক পরিবর্তনশীল আরশি, যাকে চাই সহন-সীমার মাঝে অস্তিমানতা হিসেবে।
ফলে অনিশ্চয়তা এবং সঙ্গীত যথাক্রমে আমাদের অসহ সঙ্গী এবং বাসনার সুখ! তারা যেখানে মিলিত হয়, সেখানেই রূপসাচ্ছন্দ্য, সেখানে সমস্ত লেখার সজীবতা। আর পাঠক সত্তার তৃপ্তি মানে তো এই অহং এবং বাসনার দিকেই নিরবধি গমন করতে থাকা। তাই লেখকের মাঝে জাগরুক পাঠক সত্তাকে মগ্ন-মুগ্ধ করে যখন লেখা প্রকাশ পায়, অন্যকেও তা উদ্বোধিত করবে মনে হয় এবং সংকটের সমাধান না হোক, অন্তত আশ্রয় হবে, ক্ষণ-আশ্রয়, সত্যের আভা-লাগা, ক্ষণ-অনিবার্যতা-মোড়ানো। যেখানে পাঠক ফিরে ফিরে আসে। এমন এক অধিবিদ্যার দাস যেন আমরা, মানে লেখক সমপ্রদায়।
তাই অন্য অর্থে, একটি কবিতা হয়তো বা চিন্তারও শেষ মানবিক সীমা ছুঁয়ে অস্তিমান থাকে পৃথিবীতে। না-হলে, তা নিজেই নিজেকে ক্ষয় করে ফেলে দ্রুত। তবে তা কি কবিতা নয়, যা ক্ষয়ে যায় দ্রত, কবিতাই নিশ্চয়। তবু আমরা একটি কবিতার দীর্ঘায়ুও কামনা করি, যা আসলে নিশ্চয়তার পিপাসারই এক রূপ, যাকে এই অনিশ্চয়তা ঘেরা পৃথিবীতে আমরা ভাল না-বেসে হয়তো বা পারি না। মনে হয় যেনো নিশ্চয়তার বোধই মানুষের কল্পনার সেরা সৃষ্টি, বাস্তবতার শ্রেষ্ঠ পিপাসা।
আর অনিশ্চয়তাই চিরপ্রাকৃতিক, অসহ-চরাচর, যেখানে পদচারণা অবিচ্ছেদ্য! অবচেতনে সাদৃশ্য-তৃষ্ণার ক্ষণ নিবৃত্তির তথা প্রশান্তিপ্রদ সেই সব ভাষিক চিহ্নাবলি যাদের হারিয়ে ফের ফিরে পাওয়ার বাসনা অনিশ্চয়তার উপর প্রলেপ ফেলে, এবং আমাদের ভেতর জাগে আনন্দ ঝিলিক। এক্ষেত্রে, অনাকাঙ্খিতকে বাসনার সাথে অভিযোজিত করা হয়, নয়তোবা ছেটে ফেলা হয়। এ অর্থে আমরা সবাই যেনো নস্টালজিক। ভবিষ্যতের গর্বে নির্মাণ করতে চাই এক সরল অতীত- এক প্রশান্তি-উদ্ভাসী সাদৃশ্য-অনুরাগ! সে অর্থে, নির্ভুলতাই মানব জীবনের শ্রেষ্ট নস্টালজিয়া!
আবার, সরলতা, নির্ভারতার পিপাসা আমাদের কাঙাল করে রাখে, অভিজ্ঞতার লাথি খেয়ে সব বেঁকেচুরে গেলেও- কী অদ্ভুত, যেনো সরলতা সন্ধানের মহাসড়কই হলো যুক্তিশোধিত সূত্র, সমীকরণ, আর নির্ভারতা আবাহনের মন্ত্রই যেন ছন্দ, স্পন্দন, তাল-লয়, আর সুরের বুনট!
এদের সম্মিলন যেনো আমাদের মাতৃগর্ভের দিকে ফিরিয়ে নিতে চায়- যা আমরা জন্মমাত্র হারিয়েছি- এ তো এক পেছন যাত্রাও, এতো এক মেডিটেশনও যার তেমন একটা যুক্তি নেই পশ্চাতগামীতা ছাড়া- আর ‘বাস্তবতা’কে হ্রাস করা ছাড়া- কিংবা ভবিষ্যতের ভেতর ফের মাতৃগর্ভের রূপক খোঁজা ছাড়া- কবিতা যেনো তেমন দশায় উত্তীর্ণ হওয়ার তুরীয় এক ঘূর্ণী- কিংবা তার অভাবে তুরীয় কান্না! একটা তৃপ্তির বানে উচ্ছল তো আরেকটি অতৃপ্তির আগুনে ঝলসানো- একটি খুব রঙিন তো অপরটি যেনো নিরেট অন্ধকার, একটি খুব সজীব তো অপরটি যেনো ট্র্যাজিক! দুটিই কোন না কোনভাবে মাতৃগর্ভকে আংশিকভাবে রূপায়ন করে চলে কবিতায়!
মনে পড়ছে, জীবনান্দে যদির সম্ভাবনায় কী মদির উচ্ছ্বাস, আর তবুর কী অপরাজেয় গোয়ার্তুমি, সমস্ত সম্ভাবনা ছাই হয়ে গেলেও, এবং যুক্তি যেখানে মায়ের কাছে আব্দার করে ব্যর্থ হওয়া করুণ শিশুটি, সেখানে, পরাযুক্তির দিকে তার অসহায় হাত কী আশ্চর্যবেগে ছুটে যায়। আর কেউ কেউ অবশ্য এই ‘যদি, হয়তো, কিন্তু, তবু’কে নানাভাবে ঢেকে রাখতেও চায়, চেতনে বা অবচেতনে, এদের বিধ্বস্ত করতে চায়- সেও নিশ্চয়তার প্রতি এক তীব্র দুর্বলতাই! আর এই নিশ্চয়তাই যেনো প্লেটোর আদর্শ বেড়াল- যা নিখুঁত নামে না এই পৃথিবীতে কোনদিন- নশ্বর করে রাখে আমাদের সমস্ত অর্জন ও প্রশান্তিকে!
হয়তো বা, এই ‘হয়তো বা’ই আমাদের নিস্ক্রিয় হতে দেয় না কোনদিন, কিংবা, অনিশ্চয়তা ক্লান্ত আর ক্লান্ত করে ফেললেও।
কোনদিন আবদ্ধ হতে দেয় না কোন অন্ধ-আয়তনে, কোন প্রাতিষ্ঠানিক-সীমায়।
এই হয়তোবা এই তবুর কারণেই চূড়ান্পৃত ভেঙে পড়ার পরও, পৃথিবীর প্রতিটি ধূলিকণা মনে হয় আলো-নিঃশেষ নক্ষত্রেরই হয়তোবা বোবা-সহদোর, চিরদোসর- যাদের দিকে কান পেতে ভাবতে পারি তারা একদিন শ্রুত হবে, হয়তো এখনো মৃতপ্রায়-ধুলোর কণায় আলোককণা রয়ে গেছে- বরং চোখই অক্ষম অবলোকনে- তাই নানান কৌশল চা-ই- দৃষ্টিযোগ্যতায় উত্তীর্ণ হতে! মনে হয় সমস্ত কবিই এই ‘হয়তো, তবু, যদি’র নানান রঙ!
এই বিস্ময়, এই স্ববিরোধ, এই অসুখ- আমার অহংকার- কবে আমি এসব সপ্তম স্বরে বলতে পারবো!
২০.১২.২০১০
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।