আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিট রপ্তানির বিরাট উল্লম্ফনে নতুন চ্যালেঞ্জ

রফিকুল ইসলাম ঃঃঃ তারিখ: ১৬-০৭-২০১১ দেশের রপ্তানিমুখী পণ্য তালিকার শীর্ষে বেশ কয়েক বছর ধরেই রয়েছে নিট পোশাক। সদ্য সমাপ্ত ২০১০-১১ অর্থবছরে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৯৪৮ কোটি ২০ লাখ ডলার। এটি তার আগের অর্থাৎ ২০০৯-১০ অর্থবছরের তুলনায় ৪৬ শতাংশ বেশি। যেখানে সামগ্রিক রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ৪১ শতাংশ, সেখানে নিট পোশাকের রপ্তানির প্রবৃদ্ধির হার একটু বেশি হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই এই খাত সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা জোরদার হয়েছে। এ ছাড়া নিট রপ্তানির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেশের শিল্প খাতের সক্ষমতার একটি বড় প্রতিফলন হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

তবে স্বাভাবিক প্রবণতার বাইরে অনেকটা হঠাৎ করে এত উচ্চহারের প্রবৃদ্ধি একই সঙ্গে কিছু প্রশ্নেরও জন্ম দিয়েছে। প্রথমেই প্রশ্ন আসে, কী কারণে এত বড় ধরনের উল্লম্ফন। এটা শুধু নিট পোশাকের ক্ষেত্রেই নয়, অন্য খাতগুলোসহ সামগ্রিক রপ্তানি খাতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, এই উচ্চহারের প্রবৃদ্ধির হার কি ধরে রাখা সম্ভব? দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তর আগে দেওয়া যেতে পারে। এই উচ্চহারে প্রবৃদ্ধির হার আসলে ধরে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

কেননা, এটা স্বাভাবিক প্রবণতার বাইরে। সে কারণেই সরকার যখন ২০১১-১২ অর্থবছরের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে, তখন মোট রপ্তানির প্রবৃদ্ধির হার ধার্য করেছে ১৫ শতাংশ। একইভাবে নিট পোশাকের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে সাড়ে ১৫ শতাংশ। গতবারের ৪০ শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধির হারের বিপরীতে এই হার আপাতদৃষ্টিতে কম মনে হলেও বাস্তবে তা মোটেও ঠিক নয়। কেননা, ১৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলে মোট পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে।

যেমন, মোট রপ্তানি দুই হাজার ৬০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এটা বেশ বড় অঙ্ক। কাজেই অর্জন করা কঠিন। প্রথম প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা করা যাক। একটা প্রাথমিক কারণ হলো, ভিত্তি-প্রভাব।

২০০৮-০৯ অর্থবছরে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ৬৪২ কোটি ৭৩ লাখ ডলার। আর ২০০৯-১০ অর্থবছরে তা হয় ৬৪৮ কোটি ৩৩ লাখ ডলার। অর্থাৎ রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছিল এক শতাংশেরও কম। এটাও ছিল অত্যন্ত অস্বাভাবিক নিচু হারে প্রবৃদ্ধি। এই নিচু অবস্থা থেকে কিছুটা বাড়লেই তার প্রবৃদ্ধির হার অনেকটা বেড়ে যায়।

কাজেই রপ্তানি আয়ের পরিমাণ যত বড় হবে, প্রবৃদ্ধির হারও তত উঁচু হবে। উল্লেখযোগ্য আরেকটি কারণ হলো, বিশ্ববাজারে বিশেষত, ইউরোপ ও আমেরিকায় চাহিদা বৃদ্ধি। মন্দার প্রভাবে যেখানে চাহিদা কমে গিয়েছিল, মন্দা কেটে যাওয়ায় এই চাহিদা আবার জোরালো হয়। এতে করে কার্যাদেশ বাড়তে থাকে। নিম্নমুখী হয়ে পড়া একক প্রতি দর খানিকটা ঘুরে দাঁড়ায়।

ফলে, রপ্তানি আয়ও বাড়ে। এর পাশাপাশি যে বিষয়টি বড় ভূমিকা রেখেছে, সেটি হলো কাঁচামাল ও উপাদানের দাম বৃদ্ধি। বিশেষত, তুলার দাম বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে সুতা ও বস্ত্রের দাম বৃদ্ধি। বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সাবেক সভাপতি ফজলুল হক এ বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববাজারে তুলার দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছিল।

তুলার দাম বাড়ায় সুতার দামও বেড়ে গিয়ে নিট পোশাকের উৎপাদনব্যয় অনেক বাড়িয়ে দেয়। এর প্রভাবে সংগত কারণেই নিট পোশাকের একক প্রতি দর বেড়ে যায়। এখানে কোনো রপ্তানিকারক বা বিক্রেতা চাইলেই কম দরে বিক্রি করতে পারেনি। এভাবে সামগ্রিকভাবেই নিট পোশাকের দাম বেড়ে যায়। ফলে রপ্তানিমূল্যও অনেক বেড়ে যায়।

কাজেই মোট রপ্তানি আয়ে আমরা যে বিরাট অঙ্ক দেখছি, তার একটি বড় অংশই মূলত এই দরবৃদ্ধিজনিত। ’ ফজলুল হকের মতে, যদি তুলা-সুতাসহ কাঁচামালের দর বৃদ্ধির বিষয়টি সঠিকভাবে বিবেচনায় নেওয়া না হয়, তাহলে নিট রপ্তানির উচ্চহারের প্রবৃদ্ধি এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি করবে। আর এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, সুতার দর কমে গেলে তা স্বাভাবিকভাবেই নিট পোশাকের বাজারদরকে নিম্নমুখী করবে। ইতিমধ্যে সেই লক্ষণও ফুটে উঠেছে। মূলত গত বছর জুলাই মাস থেকেই বিশ্ববাজারে তুলার দাম বাড়তে থাকে, যা এ বছরের মার্চ মাসে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়।

এরপর থেকে আবার তা কমতে শুরু করেছে। এ বছর জুন মাসে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বাজারে তুলার দাম ১৮ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। ফজলুল হক আরও বলেন, যদি আগামী দিনগুলোয় তুলা-সুতার দাম আরও কমে যায়, তাহলে নিট পোশাকের উৎপাদনব্যয়ও কমবে, যা আবার বাজারদর কমিয়ে দেবে। সুতরাং, টাকার অঙ্কে তখন বিরাট রপ্তানি কঠিন হয়ে যাবে। আবার নিট পণ্যের প্রধান বাজার ইউরোপেও আগামী দিনে চাহিদা কিছুটা শ্লথ হওয়ার আভাস দেখা যাচ্ছে।

ইউরোপের গ্রিস, স্পেনসহ বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক সংকট জোরদার হওয়াই এর মূল কারণ। আবার গত অর্থবছরের মাঝামাঝিতে যেভাবে কার্যাদেশ এসেছিল, এই মুহূর্তে সেই একই হারে কার্যাদেশ দেখা যাচ্ছে না। একাধিক নিট পোশাক রপ্তানিকারক জানিয়েছেন, রপ্তানি কার্যাদেশ এখন কিছুটা শ্লথ। তাদের মতে, এ ধারা আরও কিছুদিন বজায় থাকতে পারে। বাংলাদেশ এখন বিশ্ববাজারে নিট রপ্তানিতে দ্বিতীয় স্থানে আছে।

প্রথম স্থানে চীন আর তৃতীয় স্থানে তুরস্ক। আগামী দিনগুলোয় এই স্থান ধরে রাখা সম্ভব হলেও কিছু ক্ষেত্রে কঠিন প্রতিযোগিতা দেখা দিতে পারে। নিট পণ্য উৎপাদনের জন্য ব্যবহূত যন্ত্রপাতি বিক্রির প্রবণতা থেকেও এ রকম ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ইন্টারন্যাশনাল টেক্সটাইল ম্যানুফ্যাকচারার্স ফেডারেশনের (আইটিএমএফ) উপাত্ত থেকে জানা যায়, ২০০৯ সালে বিশ্বজুড়ে ইলেকট্রনিক ফ্ল্যাট নিটিং মেশিনারি বা যন্ত্রপাতির প্রায় ৯০ শতাংশ আমদানি করেছে এশিয়ার দেশগুলো। মাত্র নয় শতাংশ গেছে ইউরোপে, যেখানে আবার তুরস্কও অন্তর্ভুক্ত আছে।

এশিয়ার মধ্যে নিট যন্ত্র সবচেয়ে বেশি এনেছে চীন। আইটিএমএফের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০০৯ সালে বিশ্বজুড়ে সার্কুলার নিটিং যন্ত্রপাতির জাহাজীকরণ আগের বছরের চেয়ে ২০ শতাংশ বেড়েছে। মোট ২৫ হাজার ৪৫০টি যন্ত্র বিভিন্ন দেশ আমদানি করেছে, যার মধ্যে ৬৯ শতাংশই এসেছে এশিয়ায় এবং এশিয়ার মধ্যে তো বটেই, সারা বিশ্বেই সবচেয়ে বেশি এসেছে যথারীতি চীনে (১৭,৬০০)। এরপর আছে মরিশাস (২,৩০০টি), বাংলাদেশ (৮৪০), ভারত (৫৭০), ব্রাজিল (৫৪০) ও কোরিয়া (৩৬০)। এখন এসব যন্ত্রপাতি তো কয়েক বছরের উৎপাদনকাজে ব্যবহার করা হবে।

তার মানে, আগামী দিনগুলোর চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়েও উৎপাদন-সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশের নিট পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকেরা। তা ছাড়া বিশ্ববাজারে নিট পোশাকের চাহিদা সামগ্রিকভাবে বেশ বাড়বে বলেও পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে। গ্লোবাল ইন্ডাস্ট্রি অ্যানালাইসিসের (জিআইএ) পূর্বানুমান হলো, ২০১৫ সাল নাগাদ সারা বিশ্বে নিট পণ্যের বাজার হবে দুই হাজার ১০০ কোটি ডলার। সুতরাং বাংলাদেশের সামনে যেমন সুযোগ আছে, তেমনি আছে চ্যালেঞ্জ। প্রতিষ্ঠিত বাজারগুলোর বাইরে বাংলাদেশ জাপানের বাজার ধরার চেষ্টা করছিল।

এই চেষ্টায় কিছুটা সুফল আসতে শুরুও করেছিল। কিন্তু ভয়াবহ সুনামি ও ভূমিকম্পের ফলে দেশটির অর্থনীতিতে যে বিরাট আঘাত এসেছে, তা স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় এই বাজারে ভালোভাবে প্রবেশ করার ক্ষেত্রে বিরাট প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এর বাইরে দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল ও রাশিয়ার মতো বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি করা সম্ভব হয়নি। সর্বোপরি দেশের ভেতরে অবকাঠামো-সংকটের বিষয়টি তো রয়েছেই। গ্যাস-বিদ্যুৎ তথা জ্বালানি সমস্যা এবং বন্দর ও যোগাযোগ অবকাঠামোর সংকট দ্রুত কাটিয়ে উঠতে না পারলে শুধু নিট পোশাকই নয়, রপ্তানিমুখী অন্য খাতগুলোর জন্যও আগামী দিনগুলো কঠিন হয়ে যাবে।

এ ছাড়া দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে শুরু করেছে। হরতালের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচি সামনে আরও আসবে। ফলে এক ধরনের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দেবে। এটা আর যাই হোক, ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য কোনো সুখবর বয়ে আনতে পারবে না। সুতরাং, গত অর্থবছর নিট পোশাকের রপ্তানিতে যে বিরাট উল্লম্ফন তা এই খাতের ভবিষ্যৎ অর্জনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জই ছুড়ে দিয়েছে।

দেশের এই নিট শিল্প খাতের উদ্যোক্তারা কীভাবে তা মোকাবিলা করতে সক্ষম হবেন, সেটাই দেখার বিষয়। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।