অফিসে যাওয়ার পথে ইদানিং ফাল্গুন বাসটার সাথে প্রায় দেখা হয়ে যায়। আমি মগবাজার থেকে রেল লাইন দিয়ে হেটে কাওরান বাজারে যাই সকাল সাড়ে ৯ টার দিকে। যাওয়ার পথে এফডিসি রেল গেইট থেকে সোনারগাঁ হোটেল পর্যন্ত পথটুকুতে কখনো কখনো জ্যামে আটকে থাকে লাল গাড়িটা। আমি অপলক তাকিয়ে থাকি। আমার তাকিয়ে থাকা দেখে জানিনা ছেলেমেয়েগুলো কি ভাবে? মাঝে মাঝে মনে হয় উঠে যাই ওদের সাথে।
কিন্তু পা দুটো চলতে থাকে করমস্থলের দিকে। বাসটাও একসময় পাস কাটিয়ে চলে যায় ক্যাম্পাসের দিকে। দৃষ্টির সামনে থেকে লাল গাড়িটা চলে যায়, আর আমি চলে যাই ফেলে আসা দিন গুলোতে।
আমার এখনো মনে আছে প্রথম যেদিন লাল গাড়ি দেখেছিলাম সেদিনের কথা। টিকাটুলির মোড়ে একটা লাল গাড়ি দেখে কি যে ইচ্ছা হচ্ছিল লাল গাড়ির যাত্রী হওয়ার!! আমি সে সময় ইন্টারে পড়ি।
তার কিছুদিন পরেই লাল গাড়ির যাত্রী হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। টানা ৮ বছর লাল গাড়ির যাত্রী ছিলাম। কত স্মৃতি এই লাল গাড়িকে ঘিরে।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে প্রায় দেখতাম আমার বাসের সময় যায় যায় অবস্থা। কিছু না খেয়েই দৌড় দিতাম বাস স্টপেজের দিকে।
ক্যাম্পাসে গিয়ে সেলিমের দোকান (এখানে এখন সামাজিক বিজ্ঞান অনুষধের মরা বিল্ডিংটা) অথবা ওমর মামার দোকানে ডেনিশ মিশানো ব্রেড দিয়ে নাস্তা করতাম। কোন কোন দিন বাস মিস হয়ে যেত। সাথে আর কেউ থাকলে রিক্সা নিতাম। একা হলে লোকাল বাসে যেতাম। কোন কোন দিন লাল গাড়িটা আমাদেরকে ফাকি দিত।
আমরা অপেক্ষায় থেকে থেকে ২০-২৫ মিনিট পর রিক্সা বা বাসে ক্যাম্পাসে যেতাম। রিক্সায় যেতে কেউ একা জেতাম না। সাথে আরেকজনকে নিয়ে নিতাম। ভাড়া শেয়ার করে বা কেউ একজন দিয়ে দিতাম। একদিন বাস না আসায় এক সিনিয়র আপু রিক্সা নিয়ে চলে যাচ্ছে।
অথচ ওনার সাথে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় থাকা লাল গাড়ির এক নবাগত যাত্রী (১ম বর্ষের ছাত্রী) কে একবারের জন্য না বলে রিক্সার হুড উঠিয়ে হন হন করে চলে গেলেন ক্যাম্পাসের দিকে। খুবই অবমাননাকর লাগল বেপারটা। আমি আরেকজনকে নিয়ে রিক্সায় উঠতে যাব। পিচ্চি মেয়েটিকে বললাম আমাদের সাথে (৩ জন) যাবে কিনা? মেয়েটি কোন বাক্য ব্যয় না করেই আমাদের সাথে উঠে পড়ল। যাচ্ছিলাম তো ভালই।
ওমা... কাক্রাইল মোড়ে এসে মেয়েটি কান্না কাটি শুরু করে দিল। আমার রিক্সায় উঠা ঠিক হয়নি... আমার আব্বুর অফিস এখানে...। মেজাজটা বিগড়ে যাচ্ছিল কথাগুলো শূনে। মনে মনে বলছিলাম সিনিয়র আপুটার আচরনের কারনে তোমাকে আমরা অফার করেছি রিক্সায় উঠার না হয় করতাম না। পিচ্চি মেয়েটাকে ছোট্ট করে বললাম, আপু তোমার সমস্যা থাকলে না আসলেই পারতে।
কখনো কখনো এমন হত অপেক্ষার পালা শেষ করে রিক্সায় উঠে কিছু দূর আসলাম, আর দেখছি আমাদের লাল গাড়িটা হেলে দুলে আসছে।
লাল গাড়ির সবচেয়ে ভাললাগা যে স্মৃতিটা আমাকে এখনো নাড়া দেয় সেটা হোল গাদাগাদি করে সবাই ক্যাম্পাসে যাওয়া। শ্রাবণ বাস টা টিভি সেন্টার থেকে ছেড়ে এসে রামপুরা বাজার স্টপেজে আসতেই সবগুলো আসন বুকড। কখনো কখনো টিভি সেন্টার থেকেই অনেকে দাড়িয়ে আসত। আমার স্টপেজ হাজীপাড়ায় কদাচিৎ সিট খালি পেতাম।
এরপর কমুনিটি সেন্টার আর পুলিশ ফাঁড়ির কথা আর কি বলব। ভাইয়া চাপেন... আরেকটু প্লিজ ... আরেকটু। এত গাদা গাদি করেই একজনের সাথে আরেকজন মিশে লাল গাড়ির যাত্রীদেরকে ক্যাম্পাসে যেতে হত। তবুও আমার ৮ বছরের যাত্রী জীবনে কারো সাথে টু শব্দ হতে দেখিনি। কেউ এটা কখনো বলেনি ... ‘একটু ফাঁকে দাঁড়ান... গায়ের সাথে লাগছেন কেন?’ বেক্তিগত জীবনে সবাই এতটা সহনশীল নাও হতে পারে কিন্তু বাসে আমরা সবাই চরম সহনশীলতার এক শিক্ষা পেয়েছিলাম।
জানালার পাশে, বিশেষ করে গেটের কাছে জানালার পাশে যে বেচারা বসত তার অবস্থা খারাপ। গেটে বাদুরজোলাদের ব্যাগ নিতে নিতে ব্যাগের নীচে ডুবে যেত বেচারা। বাদুরজোলারা সবসময় রিস্কে থাকতো। একবার খিলগাঁও রেলগেটে এক বাদুরজোলা পরে গেল রাস্তায়। বুকের হাড় ভেঙ্গে গিয়েছিল।
আমরা পুরো বাস সহ ইসলামি ব্যাংক হাস্পাতালে গেলাম। এমারজেন্সির ডাক্তার এম্বুলেঞ্চে করে বক্ষ ব্যাধিতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। আরেকবার মগবাজার মোড়ে একটা মেয়ে পড়ে গিয়েছিল। মেয়েদের গেটে হেল্পার মামার জন্য কঠিন কাজ ছিল দু হাত দিয়ে গেট আটকে রাখা। একটু অসতর্ক হলেই যেকোনো মেয়ে পড়ে যেতে পারত।
যারা হলে থাকতো তাদের ক্লাসের ফ্রেন্ড সার্কেল ছাড়াও হলের একটা সার্কেল থাকতো। আমরা যারা লাল গাড়িতে চড়ে ক্যাম্পাসে যেতাম আমাদের বাস কেন্দ্রিক একটা সার্কেল ছিল। বাস স্টপেজে অপেক্ষমান যাত্রীদের মধ্যে আলাপচারিতা, বাস গন্তব্বে পৌঁছা পর্যন্ত পরস্পরের সাথে কথা বার্তার মাধ্যমে জমে উঠত বন্দুত্ব। রোমান্টিক উপাখ্যানও তৈরি হত কারো জীবনে। একবার এক বড় ভাইয়ের জন্য অফার নিয়ে গিয়েছিলাম একই স্টপেজ থেকে বাসে উঠা আমার এক ক্লাসমেট মেয়ের কাছে।
মেয়েটার সাথে আমার ততটা বন্দুত্ব ছিলনা। তবুও একদিন লাইব্রেরি তে নিয়ে কথা বলছিলাম। খোঁজ খবর নিতে নিতে যখন জানলাম ও বিবাহিতা আমি মুখ ফসকে বলে ফেললাম দুঃখিত। তখনো ওকে সেই বড় ভাইয়ের পছন্দের কথা বলায় হইনি। আমি আসলে বিব্রতকর এক পরিস্থিতিতে পড়ে গিয়েছিলাম।
আমার দুঃখিত বলাটা উচিত হয়নি। যার জন্য ওর পরের প্রশ্নটার (দুঃখিত কেন) উত্তর দিতে পারিনি। ও হয়ত ভেবেছে আমিই প্রস্তাব দিতে চেয়েছি। এই ভাবনাটা আমাকে সব সময় আমাকে পীড়া দিতো। কিন্তু মেয়েটার সাথে আমার বন্দুত্বও খুব একটা হয়নি, পড়ে যে আমি ব্যাখ্যা করব।
লাল গাড়িটা রাস্তায় রাজার মতই চলত। আমাদের মধ্যে একটু ভাবও কাজ করত; হে আমরা লাল গাড়ির যাত্রী। যাত্রীদের চেয়ে ড্রাইভার হেল্পার মামাদের মধ্যে ভাব কাজ করত বেশি। একবার সেরাটন হোটেলের মোড়ে সরকারী এক পাজেরো গাড়ি লাল গাড়ি কে সাইড দিচ্ছেনা। ড্রাইভার মামা কোন মতে গাড়িটাকে সামনে এনে পাজেরোকে একটা ছাপ দিয়ে ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলো ‘কিরে সাইড দেস্না কেন?’ পাজেরোর ড্রাইভার উত্তর দিল, ‘দেখ আমার গাড়িতে মন্ত্রানালয়ের সেক্রেটারী বসে আছে।
উনার তারাতারি অফিস এ যাওয়া দরকার’। লাল গাড়ির ড্রাইভার উত্তর দিল ‘তোর গাড়িতে একজন সেক্রেটারী আছে, আর আমার গাড়িতে অনেক সেক্রেটারী বসে আছে’।
লাল গাড়িদের ডিপোটার কথা হয়ত আর কারো মনেই নেই। ডাউন ট্রিপে আমরা ডিপো থেকে গাড়িতে উঠতাম। ডিপোর জায়গায় এখন ইউনির সিনেট ভবন হয়েছে।
লাল গাড়ি নিয়ে এমন কতইনা স্মৃতি রয়েছে। ঠিক টক টকে লাল স্মৃতি।
আমি খুবই স্মৃতি কাতর মানুষ। লাল গাড়িটা আমাকে খুবই স্মৃতি কাতরতায় ভুগাচ্চে। আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম আমার স্মৃতি কাতরতা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।