তারপর আমরা সবাই হলুদ দেব। কিন্তু ওকি আসবেনা? কে জানে। আমি ওর মোবাইল নাম্বারটাতে এখন ফোন করিনা। ভয় লাগে। যদি কোন দিন চিনে ফেলে- খুব লজ্জা পাবো আমি।
কি আর করা ছোট বোনের ক্লাস মেট বলে কথা। কিন্তু ওকে শুনেছি রাজ ভাই বলে ডাকে শানু। ওর কাছেই শুনেছি আমাদের ই ব্যাচ মেট। প্রথম দেখায় প্রেম কথাটা আমি বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু ওকে দেখার পর আমি যেন কেমন হয়ে যাই।
ওর প্রশংসা শুনে শুনেই হয়ত আমি ওর প্রেমে পড়ে গেছি। কেন যেন রাতের পর রাত ওকে নিয়ে একেছি কত সোনালী দিনের ছবি। জানি এ প্রেম কখনোই সত্যি হবার নয়। কিন্তু আমি ওর মত একটা ছেলের প্রেমে পড়ব জানতাম? কে জানে হয়ত ভাগ্যেই ছিল লেখা।
ওকে আমি প্রথম দেখেছিলাম আমার ছোট বোন শানুর বান্ধবীর বড় ভাইয়ের হলুদে।
লাজুক একটা ছেলে। খুব অমায়িক ব্যাবহার ওর। প্রথম দিকে কথাই বলতে চাই না। ধীরে ধীরে কথা বলেছিল আমার সাথে। কিন্তু আমাকে ডাকত আপু।
কিন্তু কি আর করা। আমি অবশ্য তখন বুঝিনি আমি ওর প্রেমে পড়ে যাচ্ছি।
সেই অনুষ্টানে রাজ এমন সুন্দর ভাবে সবার সাথে নেচেছিল তা বলার মত না। নাচ থেকে ফিরে আসতেই আমি ওর অনেক প্রশংসা করেছিলাম। হয়ত সে জন্য আমাকে হেসে বলেছিল-“থ্যাংকস আপা”- আমি অবাক হয়ে দেখেছিলাম- এমনিতে বোঝা যায়না- হাসলে ওর গালে টোল পড়ে।
আমি যতক্ষন ছিলাম আড়চোখে ওর মুখের ওই মায়াবী হাসিটা দেখেছি। ও হয়ত খেয়াল করেনি- কিন্তু আমি ঠিক ই ওকে দেখেছি লুকিয়ে লুকিয়ে।
সেই প্রথম দেখা আমাদের। এবং বোধহয় শেষ বারের মতই ছিল। কিন্তু গতমাসে বড় আপার বিয়ের কথা বার্তা চলতে শুরু করতেই আবার ওর সাথে দেখা হবার সম্ভাবনা জেগে ওঠে।
আমি এতদিন যে ওর সাথে যোগাযোগ করিনি তা না। করেছি- নিজের পরিচয় গোপন করে ওর সাথে আমি তিনমাস কথা বলেছিলাম। সে সময় আমি বুঝেছি কি ভাল একটা ছেলে সে। কিন্তু আমি কেন যেন যেদিন দেখা করার কথা সেদিন যাইনি- ও যদি আমাকে চিনে ফেলে। এই ভয় সবসময় মনে কাজ করেছে।
কি করা- অবশেষে দু বছর পর আজ ওর সাথে দেখা হবে। হয়ত আজ আমি ওকে খুলে বলব আমি যে ওকে ভালবাসি- জানি ও অনেক অবাক হবে। অবাক হবে তানি ও । কিন্তু আমাকে আজকে বলতেই হবে। ওই যে ওই ও ঢুকছে মেইন গেট দিয়ে।
অনেক অনেক হ্যান্ডসাম লাগছে ওকে। কি সুন্দর করে হাসছে সে- কিন্তু সাথের মেয়েটা নিলিমা না? হ্যাঁ- নিলীমা- ওদের ক্লাসমেট- একসাথেই এসেছে। ভয় নেই নিলীমার বিয়ে হয়েছে অনেক দিন- বাচ্চা ও আছে। রাজ নীলিমাকে বোন ডেকেছে ব্যাপারটা অজানা নেই আমার। ওরা এদিক ওদিক কি খুঁজছে? ও আচ্ছা তানিকে খুঁজছে নিশ্চয়- কিন্তু তানি তো ছবি তুলছে।
আমিই এগিয়ে গিয়ে ওদেরকে বসাই চেয়ারে। এগিয়ে গেলাম। রাজকে সম্বোধন করে বলতে যাব এমন সময় কোত্থেকে যেন তানি টা উড়ে চলে আসল সাম্নে। কি আর করা- রাজ আর নিলীমাকে তানি ওয়েলকাম করল- আমাকে করতে দিলনা। আমি পেছনে দাঁড়িয়ে আছি তানির।
ওরা হাটছে- আমি ও ওদের পেছন পেছন আস্তে আস্তে হাটছি। কিন্তু- রাজ কি আমাকে দেখছেনা? এত সুন্দর করে সেজেছি আমি। ও কি বুঝতে পারছেনা-এই সাঁজ শুধু মাত্র ওর জন্যে?
ওরা গিয়ে বসল সামনের একটা সারিতে। এই ক’বছরে রাজ অনেক পরিবর্তন হয়েছে। চেহারায় অনেক সুন্দর একটা ভাব এসেছে- কিন্তু ও কেমন যেন মনমরা হয়ে বসে আছে।
আমি তো এদিকে আপাকে ছেড়ে যেতে পারছিনা। কি করা যায়- বুঝতে পারছিনা। ওর সাথে কথা বলা দরকার। ও তো আমার দিকে তাকাচ্ছেইনা। কি করি?
ওই যে আরো দুজন বান্ধবী আসল তানির।
এবার রাজ কে হাস্তে দেখছি মন খুলে- হাসলেই সেই টোল পড়া গাল দেখে কেমন যেন করে ঊঠল বুকের ভেতর। আহ- ওকে যদি সারা জীবন ধরে ভালবাসতে পারতাম?
আহ- আবার এদিকে আপা ডাকছে। আপার স্পেশাল রবীন্দ্র সংগীত চলছে সাঊন্ড বক্সে। আপা রবীন্দ্র ভক্ত। আহা এই গান টা যেন আমার জন্যই লিখেছিলেন রবিঠাকুর-
সখী, ভাবনা কাহারে বলে।
সখী, যাতনা কাহারে বলে ।
তোমরা যে বলো দিবস-রজনী ‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’—
সখী, ভালোবাসা কারে কয় ! সে কি কেবলই যাতনাময় ।
সে কি কেবলই চোখের জল ? সে কি কেবলই দুখের শ্বাস ?
আসলেই ভালবাসা কি? কে জানে? সে কি কেবলই চোখের জল? ভাবতেই কেমন যেন চোখে পানি চলে আসল- এই অনুষ্টানে মেকাপ মুছে যাবে বলে তাড়াতাড়ি করে মুছে নিলাম টিস্যু দিয়ে।
অনুষ্টানের শুরু হবে এখনই- বর পক্ষ এসেগেছে- সবাই একে একে আপাকে হলুদ মাখিয়ে দিচ্ছে। একে একে সবার দেয়া শেষ হলে আমাদের পক্ষ দিতে শুরু করবে- তানিকে বললাম রাজদের কে ডেকে নিয়ে আস্তে- সবাই আসছে- কিন্তু রাজ যে বসে আছে- ওকি হলুদ দেবেনা? না দিক –অন্তত একটা তো ছবি তুলবে আপার সাথে- আমি অন্তত একটা তো ছবি তুলতে পারব ওকে সাথে নিয়ে- কিন্তু ও আসছেনা কেন?
ওমা দেখি তানি ওকে হাত ধরে টেনে নিয়ে আসল স্টেজ এ।
তানি টা ইদানিন বড্ড বেড়েছে। ও রাজ এর হাত ধরার সাহস পেল কোথায়? ও কি জানেনা যে আমি রাজ কে ভালবাসি? ওকে আমি কত ইনিয়ে বিনিয়ে বলেছি- ঐ বেটি কোনভাবেই কিছু বুঝেনা- ন্যাকা- সব কিছু বুঝিয়ে দিতে হয় ওকে।
না থাক- আমাদের বিয়ে হলে তো তানি ওর শ্যালিকা হবে- এ দিকে চিন্তা করলে অবশ্য তানি ওর হাত ধরতেই পারে। রাজ হলুদ দিলনা- কিন্তু সবার সাথে দাঁড়িয়ে ছবি তুলল- আমি সেই সুযোগে রাজের বামে দাঁড়িয়ে ছবিটা তুলে নিলাম। আজকে ভালবাসি বলতে না পারলে হয়ত এটাই আমাদের একসাথে তোলা একমাত্র ছবি হবে।
ফেসবুকে ওকে অবশ্য আমি অ্যাড করেছি। পাগল ছেলে একটা- সারাদিন বসে বসে কবিতা লেখে-আর সুর দেয়- চমৎকার চমৎকার সব কবিতা- আমি তো ওর কবিতা সারাদিন বসে বসে পড়ি। কি চমৎকার সব কবিতা। আমাকে নিয়ে কি একটা ও লিখেছে? কে জানে? কিন্তু সারাদিন ই তো হারানোর কবিতা লেখে ও – ভালবাসার কবিতা কি একটা ও লিখেছে? ...... মনে
পড়ছে না- ও মনে পড়েছে-
আমি দূর থেকে তোমাকেই দেখেছিলাম সেই সেদিনের ভুলে
তুমি ফুল বাগানে ফুল হয়ে তাই ফুল ছড়িয়ে ছিলে-
আহ কি অদ্ভুত সব কবিতা লেখে ও – আর ও গান ও মন্দ গায় না। ওর সাথে আমার একটা গতি হলেই আমি ওকে একটা গানের সিডি বের করতে বলবো।
নিদেন পক্ষে ও তো একটা কবিতা র বই বের করতে পারে। না বেচারা কিছুই করবে না। অবশ্য করবেই বা কিভাবে? ও অনেক কষ্টে লেখা পড়া করেছে। কি জানি এখন নিশ্চয় ভাল অবস্থানে আছে। থাক- আগে কাজ করি- ওকে নিয়ে পড়ে ভাবব- এদিকে আপা কি জন্য ডাকছে দেখে আসি।
হাতের কাজটা শেষ করে এসেই যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখানে ফিরে আসলাম- কিন্তু রাজ কে দেখতে পাচ্ছিনা- ও কোথায় গেল? ও কি চলে গেল? বসার যায়গায় নেই- বাইরে মাত্র ঘুরে এসেছি- সেখানেও নেই- তবে কি চলে গেল? কে জানে- কিন্তু সে তো চলে যাবার পাত্র নয়- তবে কি/// ওই তো ঐ যে রাজ। বসে আছে খাবার টেবিলে- সবার সাথে- তানি তদারকি করছে খাবার টেবিল। আব্বু এসে ঘুরে গেছে রাজ এর টেবিলের চারপাশ- “দেখে নাও আব্বু- এই যে দেখে গেলে- ও হল রাজ- অনেক ভাল একটা ছেলে- ওকে আমি অনেক অনেক ভালবাসি। জানো?” না- মনে মনে বললে আব্বু শোনেনা আমার কথা- তাই সামান্য কুশল জেনেই চলে গেল সে রাজ এর টেবিল ছেড়ে- ঊফ-আব্বুটা যে কি না? কিচ্ছু বুঝেনা। আপার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে- এখন তো আমার পালা- এটা কি আব্বুর মাথায় নেই? আম্মু না হয় অনেক শান্ত শিষ্ট- আব্বু কে তো বোঝা ঊচিত।
ঐ যে রাজদের খাওয়া শেষ হল। ওকে তানি টেনে নিয়ে আসছে মঞ্চে- মঞ্চে সবাই নাচছে গানের তালে তালে- রাজের সাথে আজকে নাচ ও হয়ে যাবে- কিন্তু কেমন যেন লজ্জা পাচ্ছে ও। আমরা মেয়েরা সবাই গোল হয়ে নাচছি- ও এক কোনায় দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছে। এমন সময় তানি ওকে টেনে নিয়ে আসল আমাদের সাথে। সবাই হাত ধরেছে একজন আরেকজনের।
আমার পাশে তানি- আর রাজ তানির ঠিক পাশেই। তানি টা যে কি না- রাজের হাত ধরে আছে- রাজ না হয় একটু লজ্জা পাচ্ছিল- তাই বলে ওকে এভাবে হাতে ধরে নাচতে হবে? রাগে আমার গা জ্বলছে।
একটু পড়েই আরেকটা গান শুরু হল- এবার সবাই হাত ছাড়াছাড়ি করে দুইজন দুইজন করে নাচছে। আমার সামনে ছোটখালা। কিন্তু আমি কোনভাবেই রাজের দিকে আগাতে পারছিনা।
ওর সাথে এখন নীলিমা নাচছে। ঊফ- সামনে থেকে ছোট খালা সরছে না। কি যে করি। আমি ঘুরতে ঘুরতে নাচের তালে তালে রাজের প্রায় কাছে ই চলে এসেছি। এই যে ও আমার প্রায় সামনে- কিন্তু একি ও কোথায় যাচ্ছে? আমার সাথে নাচবে না?
ও -ওর একটা কল এসেছে মোবাইলে।
ও রিসিভ করতে স্টেজ থেকে নেমে নিচে গেল। আমি ও সুযোগ বুঝে দু মিনিট পর পানি খাবার ভান করে নিচে গেলাম রাজের পাশে। ওই যে রাজ কার সাথে যেন হেসে হেসে কথা বলছে। ও কি জানে ওকে হাসলে অনেক সুন্দর লাগে? কেজানে।
আমি ওর পেছনে গিয়ে চেয়ারে বসতেই একটা হোঁচট খেলাম যেন।
ও কার সাথে কথা বলছে? কাকে সোনাই বলে ডাকছে? ওর তো কোন বোন নেই। না না- এটা কোন বোনের সাথে কোন ভাই কথা না- তাহলে কে? আন্টি? না মায়ের সাথে কোন ছেলে এভাবে কথা বলতে পারেনা। তাহলে কি রাজের কোন প্রেমিকা আছে? কি সব যা তা ভাবছি? রাজের কোন প্রেমকা নেই বলেই তো তানির কাছে শুনেছি। ওই যে তানি নেমে আসছে স্টেজ থেকে। হেটে গিয়ে একটা পানির বোতল নিয়ে রাজের পাশে বসল তানি- বলল-
“ কার সাথে কথা বলছেন ভাইয়া? ভাবি নাকি?” শুনেই আমার মাথায় বাজ পড়ল যেন- রাজের প্রমিকা আছে বুঝি? কখন ওদের আফেয়ার হল? তানি তো আমাকে কখনো ই বলেনি- ছিঃ কি বজ্জাত মেয়েটা- আমাকে একবারের জন্য বলেওনি? দিব্যি তানি রাজের সাথে ওর প্রেমিকা নিয়ে কথা বলছে।
কিন্তু আমাকে একবার ও জানাবে না?
আমার চোখমুখ কেমন যেন করছে। মাথায় চারপাশটা কেমন যেন অন্ধকার হয়ে আসছে। আমি এক ঢোক পানি খেলাম। কিন্তু না কমছে না। অবশ্য যা হবার তাই হয়েছে।
আমার মনের কথা তো রাজ কে আমি কখনোই বলিনি। কিন্তু আমি যেভাবে ওকে ভালবেসেছি সেভাবে কি ওই মেয়েটা রাজকে ভালবাসতে পারবে?
জানি পারবেনা- তাই আমাকে একটা বিহিত করতেই হবে। রাজ কে যখন পাবোনা- তখন এ জীবন রেখে কি লাভ? আপার বিয়েটা হয়ে গেলেই আমি মরে যাব- ঘুমের ঔষধ খেয়ে নেব বেশ কয়েকটা। রাজের জীবন থেকে পুরোপুরি সরে যাব আমি কখনোই ওর পথে আমি থাকবোনা। আজ বাদে কাল বিয়ে।
পরদিন জামাই চলে যেতেই আমি বিষ খাব। কি হবে এ জীবন রেখে? রাজ একটা মেয়েকে ভালবেসে জীবন পার করে দেবে আর সেটা দেখে আমাকে বেঁচে থাকতে হবে?
ওরা সবাই আবার নাচতে শুরু করল। আমাকে ও টানছে- আমার যেতে ইচ্ছে করছেনা। কিন্তু আমি কি যাব? রাজ কি কোন ভাবে আমাকে আমার সেই প্রত্যাশিত চুমুটা খাবে? খেয়ে বলবে- “আমি তোমাকে ভালবাসি”-সবার সামনে কি রাজ আমাকে চুমু খেতে পারবে? জানিনা। হয়ত করবেনা আমাকে প্রথম ও শেষ চুমুটা।
হয়ত করবে- হয়ত রাতের স্বপ্নে- প্রতি রাতের মতই- আর তাই অনিশ্চিত হয়েই আমি টলতে টলতে আবার মঞ্চে ঊঠলাম। আজ একটা হবেই। হয় সে আমাকে ভালবাসবে- না হয় আমি ই সরে যাব ওর জীবন থেকে- নীরবে। একটা এসপার ওসপার দেখেই ছাড়ব আমি......
(সমাপ্ত)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।