আমার সাড়ে তিন বছরের ছোট্ট মেয়েটা,আমার নুহা,সব কিছুতে ছিলো ওর অসীম আগ্রহ,ওকে নিয়ে আমরা ঘুরেছি সুন্দরবন,বান্দরবন,কক্সবাজার,লক্ষ্মী মেয়ের মত ও স্কুলে করত,নাচের স্কুলে যেত,আমার সাথে হরর মুভি দেখত আর কত শত প্রশ্ন করত,শুধু একটা জিনিসে ছিলো ওর বিরক্তি-ঘুম। কোনভাবেই ঘুমাতে চাইত না,আমি ওকে ভুলাতাম, ‘আচ্ছা,তোমাকে ঘুমাতে হবেনা,তুমি রেস্ট নাও’’ না,ও রেস্টও নিবে না, ‘আচ্ছা,তুমি একটু শুয়ে থাকো’’ এতটুকু মেয়ে বাবাকে বুঝে ফেলেছিলো,এইত কদিন আগে আমাকে বলল কি, ‘বাবা,আমি ঘুমাবোও না,রেস্ট ও নিব না,শুয়েও থাকব না’’ আমি বললাম ‘আচ্ছা,আসো আমরা গল্প করি’’গল্প করতে করতে মা আমার ঘুমিয়ে গেল।
শেষবার যখন কক্সবাজার যাচ্ছিলাম,যাবার আগের রাতে আমি বললাম ‘মা,তোমার ঘুম পাচ্ছেনা?’’ ও আমাকে বলল ‘পাচ্ছে বাবা,কিন্তু আমার এত আনন্দ হচ্ছে যে আমার ঘুমাতে ইচ্ছা করছে না’’ কক্সবাজার যাবার পথে আমারই কোলে ঘুমিয়ে পড়েছিলো আমার মেয়েটা,ভোরের মিষ্টি আলোয় ঘুম ভাঙা চোখে আমার মেয়ে সমুদ্র দেখবে আর আমি দেখব আমার মেয়েকে,এই অদ্ভুত সুন্দর স্বপ্ন নিয়ে আমাদের গাড়ি ধেয়ে চলেছিলো সমুদ্র সৈকতের পানে,কিন্তু সেই রাত কিভাবে ভোর হল সে কথা আমি কিভাবে বলি,কিভাবে বলি,আমার মেয়েটাকে রাস্তায় একদল ডাকাত এসে গুলি করে মেরেই ফেলল,এত বড় একটা কথা কেন একটা বাক্যে শেষ হয়ে গেল,পৃথিবীর সমস্ত শব্দ ব্যবহার করে,বুকের ভেতরের সমস্ত কষ্ট উগড়ে দিয়েও তো এ ঘটনার বর্ননা সম্ভব নয়,হাজারবার বলেও পুরোটা বলা হবে না,আমার ভেতরে রয়েই যাবে,অথচ কতটা আকস্মিক আর কত অল্প সময়েরই ঘটনা,এত তাড়াতাড়ি আর এত সহজে আমার মেয়েটা আজীবনের জন্য ঘুমিয়ে গেল! আমি চিৎকার করে কাঁদছিলাম,আর ওর মা নির্বোধের মত মেয়েকে জাগানোর জন্য তখনও দোয়া পড়ে যাচ্ছিলো…………………..কেমন বাবা আমি,ঘুমাতে চাইত না যে মেয়েটা আমার,তাকেই আমি আজীবনের জন্য ঘুম পাড়িয়ে দিলাম,মাটির নিচে ঘুমন্ত মেয়েটাকে রেখে আসলাম আমি,একটা বালিশ পর্যন্ত দিতে পারলাম না….. এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে,এই মাটির উপর,এই দস্যুদের মাঝে আজও আমাকে বেঁচে থাকতে হয়,চলতে হয়,ফিরতে হয়,ভাত চিবিয়ে গিলতে হয়….
কত স্বপ্ন ছিলো মেয়ে কে নিয়ে,জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হবে বলে আমার বন্ধু নির্জন ওর নাম রেখেছিলো ‘নুহা’,ভেবেছিলাম মেয়েকে বাস্তববাদী করে গড়ে তুলব,মেয়ের সামনের আস্তে আস্তে এই ভয়াল পৃথিবীর পরিচয় তুলে ধরব,তাকে এ পৃথিবীতে বসবাসের উপযোগী করে তুলব,কিন্তু এ পৃথিবী দেখলাম আমার ধারনার চেয়েও ভয়াল ছিলো,আমার ছোট্ট মেয়েটাকে কিছু বুঝানোর সময় পর্যন্ত দিল না…
ভাবতে অবাক লাগে আমার নিষ্পাপ মেয়েটাকে যারা মেরে ফেলল,আমারই দেশের মাটিতে এখনও তারা বেঁচে আছে,হয়তো আরও এক নুহাকে মারার অপেক্ষায়,আচ্ছা ‘হয়তো’ কেন বলছি,খোদা না করুক,অবশ্যই তো মারবে, তাইনা??
প্রিয় পাঠক,সাবরিনা রাইসা নুহা,আমাদের জহিরুল হক তরুন ভাই ও ভাবীর একমাত্র মেয়ে। বেঁচে থাকলে আগামী ৭ আগস্ট যার বয়স হত চার। গত ১ জুলাই, ২০১১ দিবাগত রাত তিনটার দিকে ঢাকা থেকে সপরিবারে কক্সবাজার যাওয়ার পথে চকোরিয়া উপজেলার খুটাখালী মেধাকচ্ছপিয়া ঢালা এলাকায় একদল সশস্ত্র ডাকাত গাছের গুড়ি ফেলে তাদের গাড়ি থামানোর চেষ্টা করে।
ডাকাতরা সবাইকে মেরে ফেলতে পারে ভেবে ভাইয়ার নির্দেশে ড্রাইভার গাড়ি না থামিয়ে কক্সবাজারের দিকে গাড়ি টান দেয়। ডাকাতরা পেছন থেকে গুলি ছুঁড়লে তা তরুন ভাই এর বাহুতে লাগে। গুলিটা তার বাহু ভেদ করে বুকে ঘুমিয়ে থাকা মেয়ে নুহার মাথায় বীদ্ধ হয়। বাবার হৃদপিন্ড বাঁচিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে আমাদের মেয়ে নুহা। তরুন ভাই তার ফেসবুক পাতায় লিখেছে, ‘নুহা বলত- আমার আব্বু বেস্ট আব্বু, আমার আম্মু বেস্ট আম্মু; আর আমি আমার আব্বু আম্মুর বেস্ট নুহা।
নিজের জীবন দিয়ে তার বাবাকে বাঁচিয়ে, সে যে আমার বেস্ট নুহা তা প্রমাণ করে গেল। মামুনি, তুমি আমার বেস্ট নুহা, তুমি ঘুমিয়ে ছিলে আমার বুকের মঝে, এবং সারাজীবন ওখানেই থাকবে’।
প্রিয় পাঠক,তরুন ভাই ও ভাবীর মনের অবস্থার কিয়দংশও যদি আমি উপলব্ধি করে থাকি,তবে সেই উপলব্ধি আমি আপনাদের সবার সাথে ভাগাভাগি করতে চেয়েছি,না পাঠক,ভাই ভাবীর জন্য শোক প্রকাশ কিংবা নুহা মামুনির আত্মার শান্তি জন্য এ ঘটনার প্রতিশোধ নিতে আপনাদেরকে আহবান করা আমার উদ্দেশ্য নয়,আমাদের নুহা কোনদিনও ফিরে আসবেনা,আল্লাহ নিশ্চয় তাকে জান্নাতবাসী করবেন,কিন্তু বাবা মায়ের বুক খালি করে অকালে,অগোচরে নুহাদের চলে যাওয়া এদেশে কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়,আগেও এমনটা ঘটেছে,বলা বাহুল্য ভবিষৎএও ঘটবে যদি আমরা সামগ্রিক সচেতনতা না আনতে পারি। আপনি ব্যক্তিগত ভাবে অনেক সচেতন হতে পারেন,প্রতিদিন হয়ত আপনি আপনার সন্তানকে নিজে স্কুলে দিয়ে আসেন,নিয়ে আসেন,কিন্তু নুহা আপনাদের স্মরন করিয়ে দিতে চায়,এদেশে আপনার কোলেও আপনার সন্তান নিরাপদ নয়,তাই বলে দেশ ছেড়ে চলে যাবার কথা ভাববেন না যেন,এ দেশ আপানার,আসুন সবাই মিলে এ দেশটাকে মেরামত করি,আমাদের সন্তানদের উপযোগী করি।
মুক্তিযুদ্ধের উপর বই পড়লে,সিনেমা দেখলে,গর্বে চোখে পানি চলে আসে,কত মমতায়,কত আশায়,কত স্বপ্ন,কত ভালোবাসায় নিজেদের জীবন দিয়ে আমাদের পূর্বপুরুষরা এদেশকে আমাদের জন্য স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন,স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকার জন্য স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন,এ দেশে আজ বাইরের কেউ নেই,বর্গী নেই,হানাদার নেই,আমাদের কাছেই আজ আমরা অনিরাপদ,এ লজ্জা কোথায় রাখবেন?
আসুন আজ এক হই,সারাজীবনের জন্য এক হই,জাতি হিসেবে সচেতন হই,ঐক্যবদ্ধ হই,গৌরবময় অতীতকে স্বার্থক করি,ভবিষ্যৎএর জন্য গৌরবময় বর্তমান গড়ি।
প্রাকৃতিক সপ্তাশর্য নির্বাচিত হবার জন্য মনোনীত আমার দেশের সুন্দরবন আর কক্সবাজার,সেখানে যদি আমার সন্তানই যদি নিরাপদ না হয়,আমিই তো ভোট দেব না,দেশের বাইরের মানুষের কাছে কি চাইব?
নুহার মিলাদের দিন ভাবী বলছিলো, ‘আমার মেয়েটা থাকলে আজ এত মানুষ দেখে কি যে খুশি হত,খাবারের প্যাকেট গুলা দেখে বলত,মা,আমরা এত্তগুলা প্যাকেট বানাবো!”
আসুন,আমরা এতগুলো মানুষ এক হয়ে আমাদের স্বন্তানদের খুশি নিশ্চিত করি’
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।