আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইন্দ্রজাল,শিল্পকলা এবং মানবসভ্যতা

প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যেই তার মনের অজান্তে হোক অথবা সচেতনভাবে হোক, একটি শিল্পসত্ত্বা বসবাস করে। বহু হাজার বছর আগের যে গুহাচিত্র আজ আমরা দেখি,তাতেই বোঝা যায় মানুষ তার অস্তিত্বের শুরু থেকেই নিজের ভাব প্রকাশে শিল্পের ব্যবহার করছে। তবে শিল্পকলা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় সম্ভবত ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী আলেকজান্দ্রিয়া ও গ্রীক সভ্যতায়। আজ আমরা শিল্পের যে বহুমূখী ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখি তা সম্পূর্ন আমদের মনের ক্ষূধা মেটানোর একটি উপাদান মাত্র। কিন্তু আমদের পূর্বপুরুষেরা যখন নিজের অজান্তেই শিল্পের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করলো তা কিন্তু মোটেই তাদের আমোদ-প্রমোদের বিষয় ছিলনা, এর সাথে সম্পর্কিত ছিল তার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।

মানুষ তাকে বাঁচাবার জন্য আশ্রয় নিত শিল্পের কাছে, যার মূলে ছিল আসলে ‘ইন্দ্রজাল’। যা না হলে হয়ত আজকের মানবসভ্যতা এতদূর এসে পৌছাত না। অনেক আগেই মানুষ প্রকৃতি কাছে হার মেনে বিলূপ্ত হয়ে যেত। গত শতক হতে মানুষ যখন একের পর এক আদিম সমাজের আঁকা গুহাচিত্রগুলো আবিষ্কার করতে লাগল,আধুনিক মানুষ ধারনা করলো আমাদের পূর্বপুরুষেরা হয়ত নেহায়েত অবসর সময় কাটানো অথবা নিজের মনের আবেগ প্রকাশের জন্যেই এই চিত্রগুলো আঁকতো। কিন্তু পরবর্তীতে খুঁজে পাওয়া কিছু ছবি এই গুহাচিত্র গুলো সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।

কারণ দেখা গেলো এমন কিছু যায়গায় চিত্রগুলো আঁকা সেখানে মানুষের পক্ষে যাওয়া দুষ্কর তো বটেই,এমনকি সেখানে মানুষের সোজা হয়ে দাড়ানোর বা বসারও সুযোগ নেই। অর্থ্যাৎ,আজকের মত অন্যদের কাছ হতে বাহ্বা পাওয়ার জন্য যে ছবিগুলো আঁকা নয় একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তাছাড়া মানুষ যখন তার বাঁচার জন্য প্রতি মূহুর্তে প্রকৃতির সাথে লড়াই করছে সেখানে সমাজের কেউ নিজের কাজ ফেলে শিল্পের পেছনে সময় ব্যয় করবে,আর তার সঙ্গীরা শিল্পমূল্য হিসেবে নিজের প্রান বাজি রেখে তার খাবার যোগাড় করে দেবে,এটিও যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ সেই সমাজটা ছিল সাম্যের সমাজ,কোনো রাজা-প্রজা ছিল না। সবাইকে নিজের অংশটুকু পরিশ্রম করেই আদায় করে নিতে হত।

তাহলে কেন মানুষ শিল্পের পেছনে ছুটতো? আজো পৃথিবীতে এরকম অনেক আদিবাসীদের দেখা পাওয়া যায় যারা আদিম সমাজের কায়দা-কানূন অনেকটাই নিজেদের মধ্যে ধরে রেখেছে। এদের অনেক আদিবাসীর বাস মধ্য/দক্ষিন আমেরিকা এবং আফ্রিকায়। মেক্সিকোর এমন এক আদিবাসী গোষ্ঠির নাম হলো ‘তারাহুমারে’। তাদের ভাষায় একটি শব্দ হচ্ছে ‘নোলাভোয়া’। এর দুটি প্রতিশব্দ আছে তার একটি হছে ‘মেহনত করা’ এবং অন্যটি হচ্ছে ‘নাচ’।

ওদের সমাজে ‘বয়স-বাড়বার’ আরেক নাম হলো কার নাচে অংশগ্রহন করার সংখ্যা কত বেশী। যে যত বেশী বার নাচে অংশ নিয়েছে তার কদরও সমাজে বেশী। বেশ অদ্ভুত লাগছে না?কিন্তু তাদের কাছে নাচ আমোদ-প্রমোদের কোনো বিষয় ছিলনা। এটি ছিল প্রকৃতিকে জয় করার কৌশল। প্রকৃতিকে জয় করা মানে প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাওয়া নয়, তার নিয়মগুলো রপ্ত করা।

আদিম যুগের মানুষ তাই করত। তাদের বেচে থাকা সম্পূর্ন নির্ভর করত প্রকৃতির খেয়াল-খুশীর উপর। তাদের উন্নত হাতিয়ার বা যান ছিলোনা যে প্রকৃতির আক্রোশ থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করবে! তারা আশ্রয় নিত ‘ইন্দ্রজাল’ এর। তারা নিজের ইন্দ্রিয় কে বশে আনার মাধ্যমে বাচঁতে শিখেছিল। যখন তারা দীর্ঘ খরার মুখোমুখি হত, তারা গোষ্ঠির সবাই একত্রে নেচে-গেয়ে আকাশের দিকে জল ছুড়ে দিত এবং কৃত্রিম বৃষ্টির পরিবেশ সৃষ্টি করত।

তাতে তারা ভাবতো,এবার আর ভয় নেই। প্রকৃতিকে জয় করা গেছে। এবার বৃষ্টি নামবেই!এরপর তারা নবউদ্যমে বাঁচার জন্য কাজ করত। এটিই ছিল ইন্দ্রজাল। অসহায় মানুষ তখনো কৃষিকাজ শেখেনি,নিজের এবং সন্তানের বেঁচে থাকার একমাত্র রসদ ছিল শিকার করা।

কিন্তু প্রস্তর যুগে মানুষের হাতিয়ার ও এতটা উন্নত হয়নি যে সে চাইলেই শিকার পেয়ে যাবে। বিরূপ আবহাওয়ায় শিকার না পেয়ে অনেকদিন না খেয়ে থাকতে হত,তখন সে নির্ভর করত ইন্দ্রজাল এর। সে ছবি আঁকতো গুহার দেয়ালে। তার বিশ্বাস ছিলো, কোন এক নির্ধারিত স্থানে ছবি আঁকতে পারলেই শিকার অবশ্যম্ভাবী রুপে ধরা দেবে। উৎসাহে বুক বাঁধতো সে,নতুন প্রেরনা নিয়ে শিকারে যেত।

তারা যদি ব্যর্থ,অসহায় মন নিয়ে বসে থাকতো এবং শিকারের খোঁজে বের না হতো,তাহলে আজ কোথায় থাকতাম আমরা? এখানে ইন্দ্রজাল তাকে বেঁচে থাকার প্রেরনা দিয়েছে। সে নিজের মনকে বশে এনে সফল হয়েছে। ধীরে ধীরে একের পর এক জয় করতে শিখেছে। আর তারই ধারাবাহিকতায় মানবসমাজে শিল্পের উৎপত্তি,সভ্যতার বিকাশ! আমরা আধুনিক সমাজে কোনো কাজে সফল হলে নেচে-গেয়ে আনন্দ প্রকাশ করি। নাচ এবং গান আমাদের আবেগ প্রকাশের অনুসঙ্গ।

আমাদের পূর্বপূরুষেরাও আমাদের মতন একি সুরে নাচত,গাইত। কিন্তু কারন ছিল ভিন্ন। তাদের কাছে নাচ-গান এসব ছিল পরিশ্রমেরই আরেক নাম। তারা বেচে থাকার তাগিদে শিল্পচর্চা করত,বিনোদন নয়। আজকের দিনে যারা মেহনত করে নিজের খাদ্য যোগাড় করে তাদের মাঝে পূর্বপুরুষের স্বভাবের প্রতিবিম্ব দেখা যায়।

তারা ভারী জিনিস টানার সময় ‘জোরসে টানো,হেইয়ো’ বলে যে ছন্দ ও সুর তুলে কাজ করে এটি তাদের সৌখিনতা নয়। নিজেকে উজ্জীবিত রাখার প্রেরনা। এরকম আমাদের গ্রামীন সমাজে আজো দেখা যায় ফসল কাটার গান, ধান ভানার গান। এভাবে সভ্যতা টিকে গেছে তার প্রয়োজনীর অনুসঙ্গকে সাথে নিয়ে। শ্রম হতে সৃষ্টি হয়েছে শিল্পের এবং বিজ্ঞানের।

শিল্প ও বিজ্ঞানের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় নবগঠিত সমাজে আবার সৃষ্টি হয়েছে নানা শ্রেনীর। সেই ‘উন্নত’ সমাজে বুদ্ধিজীবি শ্রেনী পরম যত্নে লালিত,আর শ্রমিক শ্রেণী নিগৃহীত। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।