"প্রত্যেক সত্ত্বাকে মৃত্যু আস্বাদন করতে হবে। আর তোমরা কিয়ামতের দিন পরিপূর্ণ বদলা প্রাপ্ত হবে। তারপর যাকে দোযখ থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, নিঃসন্দেহে সে হল সফল। আর পার্থিব জীবন ধোঁকা ছাড়া অন্য কোন সম্পদ নয়। " আল ইমরান,আয়াত ১৮৫ ইরানে এসেছি গত ২১ জুন, একটা চুক্তিভিত্তিক চাকরি নিয়ে।
এক মাসের ভিসা দিয়েছিল বাংলাদেশ থেকে। ভিসার মেয়াদ শেষ, তাই এখন ওয়ার্ক পারমিট ভিসা নিতে হবে। মজার ব্যাপার হল, এই ওয়ার্ক পারমিট ভিসা সরাসরি তেহরান থেকে নেয়া যাবে না। আমাকে ইরানের বাইরে যেতে হবে, হতে পারে সেটা ঢাকা থেকেও।
কিন্তু, ইরান এজন্য একটা মজার ব্যবস্থা করে রেখেছে যাতে বেশী দূর যেতে না হয়।
বলতে পারেন, টাকা কামাই করার একটা ব্যবস্থা। ইরানের দক্ষিণ উপকূল থেকে একটু দূরে পারস্য উপ সাগরে কিশ নামে একটা দ্বীপ আছে, ইরানের অনর্ভূক্ত। এই দ্বীপটিকে ওরা ফ্রি ট্রেড যোন হিসেবে ঘোষনা করে রেখেছে। এখানে আপনি বিশ্বের যে কোন জায়গা থেকে বিনা ভিসায় চলে আসতে পারবেন।
ইন্টারনেট ঘেটে দেখলাম, এটাকে ওরা দুবাই বা দোহা’র সমকক্ষ হিসেবে তৈরী করতে চাচ্ছে।
প্রচুর শপিং মল আছে, আরো তৈরী হচ্ছে। অনেক বড় বড় বিল্ডিং তৈরী হচ্ছে, সড়ক দ্বীপগুলোতে গাছ লাগানো হয়েছে। শপিং মলগুলোতে ছোট ছোট কাউন্টারে রিয়েল এসটেট এর তথ্য কেন্দ্র, সামনে কোন টুইন টাওয়ারের মডেল। যেমনটা দেখা যায় দুবাই এয়ারপোর্টে। আপনিও চাইলে এখানে বিনিয়োগ করতে পারবেন।
দামী দামী গাড়ী চলছে। তেহরানে যেমন প্রচুর সাধারণ গাড়ী দেখা যায়, এখানে তা না। ব্যক্তিগত গাড়ীগুলোও বেশ দামী। টয়োটা ক্যামরী আর করোল্লা গাড়ী দিয়ে ট্যাক্সি সার্ভিস চলছে।
দ্বীপে ডলফিনের খেলা, সমুদ্রে স্কুবা ডাইভিং থেকে শুরু করে সব ধরণের ওয়াটার রাইডসের ব্যবস্থা আছে।
আমি অবশ্য ঐদিকটায় যাইনি। কারণ, বাইরে বেরুনো আর চুলার মধ্যে গিয়ে পড়া, একই ব্যাপার। প্রচন্ড রৌদ্রের তাপ সাথে আর্দ্রতা। Feel temperature টাকে বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক গুন। রোজা রেখে বুঝতেই পারছেন কি অবস্থা ! শরীর ঘেমে নেয়ে একাকার, একটু রাস্তায় হাটলেই।
তেহরানে ৩৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রাও থাকে বিকেলে। কিন্তু, আর্দ্রতা না থাকায় তেমন কষ্ট হয় না, তেষ্টাও পায় না।
অফিস থেকে কিশ এয়ারে টিকেট কেটে দিয়েছিল। বহু পুরনো বিমান, যদিও চলল ভালই। দেড় ঘন্টায় কিশ পৌছে গেলাম।
উঠেছিলাম পারমিশ হোটেলে। ইন্টারনেটে লিখে রেখেছে ৫ স্টার হোটেল, আসলে ৩ স্টারের বেশী মনে হয় নি। নেটে দেখলাম লোকজন ব্যাপক ক্ষ্যাপা, ভাল কোন মন্তব্য নেই। যাহোক, এসিটা ভাল ছিল, এই দিক দিয়ে শান্তিতে ছিলাম।
পারমিশ হোটেল...
রিসেপশন
লবি
হোটেল থেকে সমুদ্রের ভিউ
২০ জুলাই সকালে দ্বীপে নেমে হোটেলে চেক ইন করেই চলে যাই সাদাফ টাওয়ারে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের অফিসে। সেখান থেকে ইমিগ্রেশন পুলিশের সাথে সাক্ষাৎ করে ব্যাংকে ৯০ ইউরো জমা দিয়ে সেই কাগজ আবার পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে জমা দিয়ে দুপুর বারটার আগেই কাজ শেষ। বাকী হল, পরদিন সকালে গিয়ে ভিসা লাগিয়ে আসা, আর ইমিগ্রেশন পুলিশের সিল নেয়া।
কিশ দ্বীপের পথে পথে
হোটেলে বসে কিছুক্ষণ এসির বাতাস খেয়ে ভাবলাম, যাই সামনের প্যারাডাইস মল এ ঘুরে আসি। আমি আবার বিকেলে ৪ টা থেকে একটা সিটি ট্যুর নিয়েছি।
দুইটা থেকে চারটা পর্যন্ত দুই ঘন্টা শপিং মল এ ঘোরা যায়। গিয়ে দেখি, মার্কেটের প্রবেশ পথ বন্ধ। অন্য পথে যাই, সেখানেও বন্ধ। ঘটনা হল দুপুর ২ ~ ৫ টা পর্যন্ত সব শপিং মল বন্ধ থাকে ! আজব, এমন আর কোথাও দেখিনি!
বিকেলে ঘুরতে বেরুলাম, বাসে করে আরো অনেক ইরানী লোকজনের সাথে। আমিই একমাত্র বিদেশী।
ব্যাটা যা বলে ফারসিতে বলে, আমি কিছুই বুঝি না। এক ইরানি মেয়ে, ভার্সিটিতে পড়ে, পাওয়া গেল একমাত্র সে ই ইংরেজি জানে ওখানে। প্রত্যেক স্টপেজে গেলে আমাকে সে বলে দেয় কয়টার মধ্যে ফিরে আসতে হবে !
প্রথমে নিয়ে গেল কিশ আন্ডারগ্রাউন্ড সিটি। মাটির নীচে খুড়ে বেচারারা সুড়ংগমত বানিয়েছে, কিছু কারুকার্য করেছে। ঢোকার মুখে ট্র্যাডিশনাল গান বাজনা চলছে।
সব মিলিয়ে প্রাচীন কোন শহরের আবহ। কিছু ছবি তুলেছি, দেখুন।
পরের গন্তব্য, গ্রিণ ট্রি পার্ক ! পার্কে ঢোকার মুখে এক বিশাল বটবৃক্ষ জাতীয় কিছু, সবাই ওটার গোড়ায় গিয়ে ছবি তুলছে।
পার্কের অন্যান্য গাছ দেখে আর খুব বেশী দূর এগুতে ইচ্ছে করল না। চুলা টাইপের গরম, বুঝতেই পারছেন, বাসের এসিতে বসে থাকা উত্তম।
এরপর নিয়ে গেল সাগর পারে। আমাদের দেশের মত সুন্দর সৈকত না, ভাংগা চুরা সৈকত। হয়ত অন্য দিকে slope ওয়ালা সৈকত আছে। সেদিকটায় যাই নি। বিকেল সোয়া ছয়টা।
রোদ এবার তীর্যক। সাগর পাড়ে এসি করা হোটেল, ঢুকে দেখি লোকজন সমানে সীসা আর পানীয় পানে ব্যস্ত।
রমযান মাস তাতে কি হয়েছে, কারো পরোয়া নেই। বাইরে সমুদ্রের ধার ধরে বেশ কিছু খাটিয়া বিছানো। এগুলোতে বসে এরা খাওয়া দাওয়া করে।
সময় নষ্টা না করে ঐ খাটিয়ার উপরেই আসরের নামাযটা পড়ে নিলাম।
একটু এগিয়েই আরেক দর্শনীয় স্থান, গ্রিক জাহাজ। বহু বছর আগে এখানকার অধিবাসীরা আবিষ্কার করল, তীরে এক জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। জানতে পারল, এটা একটা গ্রিক জাহাজ। সেই থেকে এই জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে।
ছবিতেই দেখুন।
আমাদের ঘোরাঘুরি শেষ প্রায়। একটা শপিং মল এ এসে থামল গাড়ী। আমি ভেতরে গিয়ে কয়েক বোতল পানি কিনে নিলাম। বাজে সন্ধ্যা ৭ টা।
৮ টায় ইফতার এর সময় হবে। সারা দিন রোদে যে পরিমাণ ঘাম ঝরেছে, কয়েক লিটার পানি মনে হচ্ছে খেয়ে ফেলতে পারব। হোটেলে পৌছে গেলাম পোনে আটটা নাগাদ। আগেই বলা ছিল, লাঞ্চের পরিবর্তে আমাকে তোমরা ইফতার দিও। আটটার কিছু আগে ইফতার পাঠিয়ে দিল।
ইফতারের আইটেম হল একপিস জুলবিয়া (জিলাপী), আরো একটা মিষ্টি আইটেম, কিছু ঘাস পাতা, পুদিনা পাতা, পনির, রুটি, পায়েস জাতীয় কিছু একটা, চা এবং আগে থেকেই রুমে থাকা আপেল, মালটা। সকালে প্লেনের খাবারগুলো রেখে দিয়েছিলাম, সেখানে জুস ছিল। সব মিলিয়ে ইফতারটা খারাপ হল না।
আজ যখন এই পোস্ট লিখছি, ২১ জুলাই, এয়ারপোর্টে বসে আছি। ২ ঘন্টা পর ফিরতি ফ্লাইট।
সকালে আবার চলে গিয়েছিলাম সাদাফ টাওয়ারে, পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের অফিসে। পাসপোর্টে ভিসা লাগিয়ে দিল। সেটা নিয়ে ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছ থেকে সিল লাগিয়ে আবার হোটেলে চলে এলাম। অবশ্য সকালেই চেক আউট করে বের হয়েছিলাম। তাই সরারসি হোটেলের উলটো দিকের প্যারাডাইজ শপিং মলএ ঢুকে পড়লাম।
দামী দামী ব্র্যান্ডের দোকান। কেনার খুব একটা প্রয়োজন ছিল না, তাই ঘুরে ঘুরেই দেখলাম।
বড় ছেলের জন্য একটা স্কুটি কিনে ফেললাম। ক’দিন ধরেই ওর মা বলছিল, দেশে কিনবে কি না। আমিই কিনে ফেলালাম এখানে, দামেও দেশের চেয়ে অনেক কম।
উঠছি, জোহর নামাজটা পড়ে নেব এখন। তারপর ইনশাল্লাহ তেহরানের পথে উড়াল... পোস্ট কিন্তু এখন দেব না, তেহরানে গিয়ে, কারণ, এয়ারপোর্টে ফ্রি ইন্টারনেট নেই, আর মোবাইলের ইন্টারনেট স্পিড ভাল না, ছবি দিতে খুব সমস্যা হয়। সে পর্যন্ত ভাল থাকুন, আল্লাহ হাফিয।
কিশ আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট, ইরান, ২১ জুলাই ২০১৩ দুপুর ২:২৫ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।