আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লেংটি লজেন্সের খোঁজে

ভাতিজাকে লেংটি লজেন্সের কথা বলে এমন বিপদে পড়তে হবে,ঘুর্ণাক্ষরেও ভাবিনি। ফস্ করে আবদার ধরে বসল, খাওয়াতেই হবে। ভাবলাম, সস্তার ওপর দিয়েই পার পাওয়া গেল এ যাত্রায়। কিন্তু শুন্যে বসে কেউ একজন খ্যাকখেকিয়ে হেসে উঠেছিলেন, তা ঠিক খেয়াল করিনি। সত্যি বলতে কী, গত এক দেড় দশকে বস্তুটা যে ইতিহাসের খাতায় নাম লিখিয়েছে, তাও জানা ছিল না।

কিন্তু পাড়ার মুদির দোকান থেকে শুরু করে আশেপাশের পান-সিগারেটের দোকানিও যখন আকাশ থেকে পড়তে শুরু করলেন, বুঝলাম বেমক্কা চ্যালেঞ্জ নেওয়াটা বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু রুমু এত সহজে হাল ভোলার পাত্র নয়! রোজই অফিস ফেরত হয়ে তার সামনে পড়লেই জেরা চলতো দস্তুরমতো। রেহাই পেতে শেষমেষ মরিয়া হয়ে হানা দিতে হল ছাত্রজীবনে ছেড়ে আসা শালগাড়িয়া গোডাউন পাড়ায়। গত কুড়ি বছরে সাকুল্যে সাড়ে তিনবারও ও-মুখো হইনি। শহরের সর্বত্র যা হয়েছে,এ পাড়াতেও তার ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি।

ফ্ল্যাটবাড়ীর ভেতর হারিয়ে গেছে এঁদো পুকুর,পতিত মাঠ, লালবাড়ির রোয়াক,এমনকি ফেলে আসা রুয়েল গাছটাও এখন নেই। প্রায় সব গিয়ে পড়ে রয়েছে শুধু লাইব্রেরী খানি। তবে অ্যাসবেষ্টসরে ছাউনি ছেড়ে দোতলা পাকাবাড়ির ধরাচুড়ায় রীতিমতো ধোপদুরস্ত সেও। আর রয়ে গিয়েছে পাড়ার সাবেক দর্জির দোকান। আদি মালিক লালনদা মারা যাওয়ায় যার দখল নিয়েছে তার মেজো ছেলে শ্যামল।

আমার আকুল জিজ্ঞাসা নিয়ে তার কাছেই অগত্যা ধর্ণা দিলাম। প্রথমে হতভম্ব, পরে চিন্তিত এবং সব শেষে গম্ভীর হয়ে সে জানাল, ’বাজারে লেংটি লজেন্স বলে এখন কিছু পাওয়া যায় না। ’ মন খারাপ করে চলেই আসছিলাম, হঠাৎ মগজে খেলে গেল বিদ্যুৎতরঙ্গ। রিকশা ষ্ট্যান্ড ছেড়ে হাঁটা লাগালাম উল্টো দিকে রাস্তার মোড়ে দাঁড়ানো ‘শিশু নিকেতনের’ উদ্দেশ্যে। হাতেখড়ির পর এখানেই শুরু হয় আমার প্রাথমিক মগজধোলাই।

পাশে এখনও কদমগাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কাঠের খুঁটির ওপর আলকাতরা মাখা টিনের চালা। সেখানে এখনও কুঁজো হয়ে বসে পান সাজাচ্ছে মোজাহার কাকা। একমাথা টাক বেড় দিয়ে চুলগুলো সাদা হয়ে গিয়েছে, এই যা। দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। গৌরচন্দ্রিকা রেখে সটান জিজ্ঞেস করি, লেংটি লজেন্স আছে? কয়েক সেকেন্ডের অপলক চাউনি।

পরক্ষনেই অভ্যস্ত ভঙ্গিতে আধো অন্ধকার হাতড়ে বেরিয়ে এল ত্যাবড়ানো প্ল্যাষ্টিকের বোয়ম। দেড় দশক আগের স্মৃতি উসকে দিয়ে কাগজের ঠোঙায় টাপুর-টুপুর ঝরে পড়তে থাকল লাল-হলুদ-কালো-সবুজ গুলির বৃষ্টি। অভীষ্ট সিদ্ধ হতেই মাথায় কামড় শুরু করল গুবরে পোকারা। লেংটি লজেন্স পাওয়া গেলে অবশ্যই পাওয়া যাবে ‘দাঁতের লড়াই’, ‘ভুনভুনি’, ‘কালো হজমি’, ‘চিনে কুল’, ‘কালো নুন’, ‘দিল্লেল লাড়ূ’ ‘চটচটি’ আর ‘মালাই বরফ’। তাই পরের কয়েক দিন লেগে পড়লাম গুপ্তধনের সন্ধানে।

স্বীকার করতে বাধা নেই, অতি দুরূহ সে অন্বেষণ। শুরু করলাম দাঁতের লড়াই দিয়ে। স্কুলে নতুন ছেলে ভর্তি হলে এই অমোঘ চিজটি দিয়ে তাকে আপ্যায়ন করাই ছিল রেওয়াজ। সেলোফেন কাগজে মোড়া শক্ত হাল্কা বাদামি রঙের আপাত নিরীহ পিরামিড আকৃতির চিজটি যে কী মারাত্মক কাণ্ড ঘটাতে পারে তা আন্দাজই করতে পারত না বেচারা নবাগতরা। দোস্তি পাতানোর অছিলায় তাকে বাড়িয়ে দেয়া হত তেকোনা বিভীষিকাটি।

মুখে দিয়ে চুষলে 'নো চিন্তা'। কিন্তু ভুলেও যদি তাতে কামড় দেওয়া হয়েছে, তাহলেই চিত্তির! দাঁতের দু-পাটিকে আলিঙ্গনের কায়দায় জাপটে ধরবে আঠালো টফি। ওদিকে পাশে দাঁড়ানো মিচকে পটাশ অ্যাডভাইস দেবে, 'চেষ্টা কর জিভ দিয়ে ঠেলতে’। বলা বাহুল্য টোটকায় কাজ তো হবেই না, উলটে দাঁতের পাটিতে আরও লেপ্টে যাবে মিঠে দুশমন। যতক্ষন না সে গলে যাবে, ততক্ষন চুপটি করে মুখ বন্ধ করে গুডবয় হয়ে থাকো।

কিন্তু বহু চেষ্টা-চরিত্র করেও তার কোনও খোঁজ পেলাম না। শহরের এমাথা থেকে ওমাথা চষে ফেললেও চটচটেও অধরা থেকে গেল। না, চরিত্রগত খানিক মিল থাকলেও দাঁতের লড়াইয়ের তুলনায় এ বেশ ভদ্র। বিকেলে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরত চটচটেওয়ালা। তার কাঁধে গোলপানা লম্বা কাঠের লাঠি।

আর তাতে জড়ানো হরেক রঙের চিনির ফিতে। এক টাকায় মুঠোভরা পাঁচ-ছ রঙা মিষ্টি ফিতে পাওয়া যেত মনে আছে। কাঠির আগায় তা পেঁচিয়ে দিত ফেরিওয়ালা। অনেক সময় আবদারে সায় দিয়ে ঘড়ি, আংটি বানিয়ে হাতেই লেপ্টে দিত। ললিপপের কায়দায় অনন্তকাল ধরে তা চেটে যাওয়াতেই ছিল স্বর্গীয় মজা।

কালো হজমির আড়তদার ছিল স্কুলের সামনে ঘাঁটি গাড়া ফেরিওয়ালারা। বড় যত্ন করে লাল আর কালো নুনের সঙ্গে বেড়ে দিত কুটকুটে কালো হজমিগুলি। ইদানিং নামী ব্র্যান্ডের বোতল, ফাইল বা প্যাকেটজাত ‘ইনো’র সাধ্য কি তার সঙ্গে পাল্লা দেয়! হজমির গায়ে কিন্তু কোনও মশলা সেঁটে থাকতো না। হালের কায়দা অনুযায়ী পুদিনা পাতাও ঠেসে দিত না কেউ। আমড়া আর কাঁচামিঠে আমের সঙ্গেও কালো নুন মাখিয়ে দিত।

অনেক সময় ওই নুনের লোভেই দোকানে হাজিরা দিতাম। টক-মিষ্টি স্বাদের মাঝে কালো নুনের তীব্রতা আর লাল নুনের ঝাল-ঝাল অনবদ্য ব্যাপারটা সমসাময়িক অনেকেই মনে করতে পারবেন। হজমি ছাড়াও রবারের লাল-সবুজ ছিপি আঁটা কাচের ছোট শিশিতে মিলত স্পেশাল কালো নুন। সে যুগে ‘বিদ্যুৎ কালো দাতের মাজন' পাওয়া যেত, হুবহু তার মতোই চেহারা। কিন্তু ‘কিসের সাথে কি, লাইলছ্যা পাতায় ঘি ! কোনও তুলনাই চলে না।

এক খাবলা কালো নুন জিভের মধ্যিখানে রাখলেই চুড়ান্ত মজা! জিভে কাঁটা দেওয়া বেদম টক মিলিয়ে যেতে যেতে পাওয়া যেত মধুরতার আভাস। আর নুনের প্রকোপে কালচে জিভ বের করে পরষ্পরকে ভেংচি কাটা ছিল বনেদি ব্যাপার-স্যাপার। সুখের কথা,ব্লু-বার্ড কিন্ডারগার্টেনের সামনেই ফের দেখা হয়ে গেল তার সঙ্গে। বিরল হয়ে এলেও চিনে কুলের হদিশও মিললো। বারো মাস কোন মুলুক থেকে যে এদের আমদানি করেন হজমিওয়ালারা, তা ঈশ্বরই জানেন।

রসিকজন মাত্রই মানবেন, মিষ্টি কুলের গায়ে আলতো জড়ানো লঙ্কার গুঁড়া মেশানো নুন সমেত পেশ করাই রিয়াসত। স্কুলের সামনে সারি দিয়ে দাঁড়ানো ফেরিওয়ালাদের প্রায় সবার সামনেই পাটকাঠির লম্বা মোড়ার ওপর বসানো থাকত কাঠের ফ্রেমযুক্ত কাচের বাক্স। তাতে জিভে-জল-আনা রকমারি পদের সমাহার। আমসি, চুরন, হজমির সঙ্গেই ছোট বয়াম ঠাসা তিন-চার কিসিমের আচার। এদের মধ্যে সেরা তেঁতুলের আচার।

একফালি কাগজের ওপর কমলা রঙা পাতলা সেই ঝোলের ওপর ছড়িয়ে দেওয়া হত ঝাল নুন, বিটনুনের অমোঘ রেসিপি। আহা! কতদিন যে ঝোল চাটতে গিয়ে কাগজের ফালিও পেটে চালান হয়ে গিয়েছে তার হিসেব কে রেখেছে! টংটং ঘন্টির আওয়াজ পেলে আজও মনে পড়ে ‘বুড়ির চুল’ওয়ালাকে। ছোট ছোট গোলাপি আর সাদা নরম তুলোর মিষ্টি গোল্লা নিয়ে আসত সে। এক বারে একখানা সোজা মুখে পুরলেই গলে ফুস্। এরাই হচ্ছে আজকের ক্যান্ডিফসের আদি পুরুষ।

তবে হালের ওই ঢাউস বস্তুগুলির প্রতি আমি মোটেও সদয় নই। বুড়ির চুল পেলে আজও খেতে রাজি আছি, কিন্তু ক্যান্ডিফস, নৈব নৈব চ ! কাচের বাক্স ছেড়ে প্লাস্টিক প্যাকেট করা ‘বুড়ির চুল’ নিয়ে আজও মাঝেসাঝে চোখে পড়ে দু-একজন ফেরিওয়ালা। কাচের বাক্স থাকত না শুধু মালাই বরফওয়ালার কাছে। সে আসত চাকাওয়ালা হাতগাড়ি ঠেলতে ঠেলতে। অ্যালুমিনিয়ামের পাতে ঢাকা তার গাড়ির মাথায় কারুকাজ করা কাঠের কেয়ারি।

বাক্স আকৃতির গাড়ির মাথায় ফুটখানেক ব্যাসের হাতল সাঁটা ঢাকনা। মাটির একরত্তি খুরিতে স্টিলের চামচ দিয়ে ঠেসেঠুসে মাখনরঙা মালাই ভরে দিত দোকানি। আর গার্নিশিং হিসেবে ফেলত দু’ফোঁটা লাল সিরাপ। অসাধারণ সেই মালাইয়ের স্বাদে বিভোর হয়ে কখন যে পেরিয়ে আসতাম স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথটুকু, তা টেরই পেতাম না। ঝাপসা হয়ে আসা শৈশব স্মৃতিকে বুড়ো বয়সে ফের খুঁড়ে বেরা করা হয়তো বাতুলতা।

সুইস চকোলেটস, হরেক স্বাদের ওয়েফার আর ডেইরি মিল্কের দুর্দান্ত প্যাকেজিং করা নানান পণ্য সম্ভারের ধাঁধায় হারিয়ে গিয়েছে কালো হজমি, চটচটে, দাঁতের লড়াই বা মালাই বরফের সাবেক সাকিন। সাইবার কেতায় দুরস্ত শিশুদের কাছে প্রজন্ম ফারাকের পসরা সাজাতে গেলে নিজের নাক কাটা যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু কেউ কি বলতে পারেন,শৈশবের হারিয়ে ফেলা সেই নোংরা,স্বস্তা ফেরিওয়ালার ভাঁড়ার আর বর্তমানের চাকচিক্যে ভরপুর দোকানগুলোর টফির মধ্যে স্বাদের পার্থক্যটা কোথায় ? হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন-স্মৃতির। এই শব্দটিই যত নষ্টের মুল ! ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।