আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বড় আপার বিয়ে

্ এই বৃষ্টিস্নাত সন্ধায় অলসভাবে শুয়ে-বসে না থেকে আমার বড় আপার বিয়ের গল্পটাই পড়ুন না। গল্পটি যদি কারো জীবনের সাথে মিলে যায় তাহলে দয়া করে আদালত মুখী হবেন না, কারণ আমাদের বিচারকদের ইনহেরিটেন্ট পাওয়ারের বাহার দেখে এমনিতেই ভয়ে ভয়ে থাকি কখন রাস্তা-ঘাটে ধরে জেলে পুরে দেয়! আরেকটি কথা বলে রাখি আমার কিন্তু কোনো বোন নেই! সবাই ভালো থাকবেন। যাদের সাইনাসের সমস্যা আছে তারা ভুলেও বৃষ্টিটে ভিজবেন না (সুযোগ বুঝে একটু কবিরাজি করলাম আর কি!) ্ বড় আপার নাম 'কাজলি' হলেই মানানসই হতো কিন্তু কেন যে হীরা হলো তা আমার বুঝে আসে না। তবে যিনি নামটি রেখেছিলেন তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, এই কালো মেয়েটি একদিন হীরার মতই দামী হয়ে উঠবে! কিন্তু কালো হীরার মূল্যায়ন এ সমাজে হবে কি না তা কী তিনি ভেবে ছিলেন? আপার মতো দীর্ঘকায়-সৌম্য গড়নের মেয়ে সাধারণত চোখে পড়ে না। কুকড়ানো ঘন দীঘল কালো চুল, উন্নত নাসিকা, ডাগর ডাগর চোখ আর মায়াবি চেহারার সৌন্দর্য বর্ণনা দেয়া জীবনানন্দ দাসের পক্ষেই সম্ভব আমার পক্ষে নয়।

আর আপার মতো মেধাবী মেয়ে কয়েক জেলায় খুঁেজ পাওয়া ভার। আপার গায়ের রং কালো হলেও যে কেউ সহজে চোখ ফেরাতে পারে না। তার আদব-কায়দা এবং আতিথেয়তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ পাড়া প্রতিবেশী মা-চাচীরা। আপার বায়োডাটা দেখে অনেক ভালো ভালো সম্বন্ধ আসে কিন্তু 'বউ' দেখার পর আর 'জামাই' রাজি হয় না। দেখাদেখিতেই আপার জীবন থেকে মূল্যবান চারটি বসন্ত গত হয়ে যায়।

ইংরেজী সাহিত্যে এম.এ করে আপা একটি হাইস্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। অবসরে লেখা-লেখি আর আমাদের ছয় ভাইয়ের উপর খবরদারি করে সময় পার করেন। যে আপার কোলে-কাঁধে চড়ে বড় হয়েছি সেই আমি এখন পড়ছি কলেজে। আপার বিয়ে নিয়ে শুধু আমরাই নই পাড়া-প্রতিবেশী এবং আত্মীয়-স্বজনরাও অস্বস্তিতে আছেন। এদিকে আপার ইমিডিয়েট ছোট রোহান ভাইয়া সরকারী কলেজে ক্যামিষ্ট্রির লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছে প্রায় দু'বছর হতে চললো।

তার বিয়ের চিন্তা ভাবনাও ঘুরপাক খাচ্ছে মা-বাবার মনে। অবশ্য আপার বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে রোহান ভাইয়া। আপার জীবনটা এমন হতশ্রী হতো না যদি মিঠুন ভাইয়া হারিয়ে না যেতেন। খুব ভালো এবং মজার লোক ছিলেন তিনি। নেত্রকোনার এক প্রান্তিক কৃষকের ছেলে মিঠুন ভাইয়া।

আমি যখন ক্লাশ ফাইভে তখন তিনি লজিং মাস্টার হিসেবে আমাদের বাড়ীতে আসেন। আমাদের বাড়ী থেকে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরত্ব মাত্র চার কিলোমিটার। অর্থনীতিতে অনার্স পড়ছিলেন তিনি। সুযোগ পেলেই গ্রামের 'মুর্খ' ছেলেদের সাথে আমতলায় ক্যারম খেলতেন। এ জন্য বাবার বকুনি খেয়েছেন অনেক দিন।

মিঠুন ভাইয়া স্টাডি করতেন প্রচুর। তার কক্ষটি ছিল বিভিন্ন বই-পত্রে ঠাসা। প্রচুর পত্র-পত্রিকা পড়তেন। যে কোনো অঙ্ক ছিল তার কাছে পান্থাভাত। ছাত্র রাজনীতি করতেন।

কখনো কারো সাথে তর্কে হারতে দেখিনি। তার সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল বিস্ময়কর। নেত্রকোনার কর্ণেল তাহেরের মতই তার মাঝে দ্রোহ এবং মেধার সমন্বয় ঘটেছিল। তিনি তাহেরের মতই ব্যালান্সড সোসাইটির স্বপ্ন দেখতেন। মিঠুন ভাইয়া লজিং মাস্টার হিসেবে আমাদের বাড়ীতে আসার প্রায় দু'বছর পর বাড়ীর সবাই আঁচ করতে পারে হীরা আপা এবং মিঠুন ভাইয়া মন দেয়া নেয়া করছেন।

মিঠুন ভাইয়া 'হীরার' মূল্য অনুধাবন করতে পেরেছিলেন নয়তো তাকে দেখতে দেখতে প্রেমে পড়েছিলেন। তারা পরষ্পরের জন্য কতটা ব্যাকুল, কতটা দেওয়ানা এ বিষয়ে সবার চেয়ে বেশী জানতাম আমি। আপার অতি প্রিয়ভাজন হওয়ার কারণে খুব কাছ থেকে দেখেছি, তাদের মিলন আকাঙ্খার অস্থিরতা। তাদের এই সম্পর্ক ছিল ওপেন সিক্রেটের মতো, সবাই জানতো আবার কেউ জানতো না। ওদের দু'জনের প্রতি সবার ছিল অগাধ আস্থা এবং বিশ্বাস।

মীর বাড়ীর সবাই যেন এই মহিমান্বিত সম্পর্কের চূড়ান্ত রূপ দেখার অপেক্ষায় ছিল। মিঠুন ভাইয়ার মাস্টার্স ক্লাস শুরু হয়েছে বেশ কয়েক মাস হলো। সবার মনেই সুপ্ত কামনা মাস্টার্স শেষ হলেই হীরা-মিঠুনের 'কবুল' উপলক্ষে খানাদানা এবং আনন্দ উৎসবের আয়োজন হবে মীর বাড়ীতে। অনেক দিন হলো আমাদের পরিবারে এরকম আনন্দ-উৎসবের আয়োজন নেই। এ বিয়েকে ঘিরে আমার রয়েছে মহাপরিকল্পনা।

দিনটি মনে নেই তবে মাসটি ছিল এপ্রিল। সন্ধ্যার আগে মিঠুন ভাইয়া বাড়ী থেকে বের হচ্ছেন আমি বাড়ীতে ঢুকছি। তিনি বাম হাতে আমার কান ধরে ডান হাতে গালে আলতো একটা থাপ্পড় মেরে বললেন, মাকে বলিস আমি বাজারে যাচ্ছি। সেই যে গেলেন আর ফিরে এলেন না মিঠুন ভাইয়া। সে সময়ে আপার কষ্টের দিনগুলি বর্ণনা করার মতো ভাষা আমার জানা নেই।

আপার দুমড়ানো-মুচড়ানো-বিবর্ণ চেহারা না দেখলে কেউ বুঝবে না ভালোবাসার মানুষকে হারানোর যাতনা যে কত তীব্র! বিরহ যাতনায় বিধ্বস্ত আপাকে দেখে তখন মন বলতো এখনি সারা দুনিয়া খুজে মিঠুন ভাইয়াকে ধরে নিয়ে আসি। স্বাভাবিক হতে অনেক দিন লেগেছিলো আপার। পড়া-শুনার জন্য বিয়ের কথা ভাবেন নি। আর এখন তো 'বউ' সাজতে সাজতেই চারটি বছর চলে গেলো! একদিন আপাকে 'বউ' দেখতে এলেন আমাদের পাশের জেলার আরাফাত নামের এক ছেলে। মিঠুন ভাইয়ার ইয়ারমেট।

ল'তে মাস্টার্স। বছর দু'য়েক আগে সহকারী জজ হিসাবে কর্ম জীবন শুরু করেছেন। ছেলের পজিশনের কথা ভেবে আমাদের মুরুবি্বগণ 'বউ' দেখাতে অমত ছিলেন এমনকি আপা নিজেও। সম্ভবত অপছন্দের ভয় থেকেই। তবে ছেলের পীড়া-পীড়িতে বলতে গেলে 'বউ' দেখার আয়োজন করতে বাধ্য হলো মীর বাড়ীর মুরুবি্বগণ! ফাল্গুনের এক পড়ন্ত বিকেলে মীর বাড়ীতে সূর্যরশ্মি ঝলকিয়ে উঠে ছেলের মুখের একটি কথায় 'বউ' পছন্দ হয়েছে! মা-চাচীদের মনোভাব দেখে মনে হলো আরাফাত যেন রহমতের ফেরেশতা! আল্লার শুকরিয়া আদায় করতে লাগলেন মুরুবি্বগণ।

বিধাতার অপার দয়ায় হীরা আপা বসলেন বিয়ের পিড়িতে। বিয়ের দিন আমরা অনেক আনন্দ করেছি কিন্তু আপাকে তেমন পুলকিত মনে হয়নি। দায়ে পড়ে বিয়ের করছেন, অনেকটা এমন ভাব। শ্বশুড় বাড়ীতে 'নতুন বউয়ের পরীক্ষা' দিয়ে আপা এলেন বাপের বাড়ী। তবে সাথে 'জজ' সাহেব নেই! দেউড়ির কাছে বড় চাচী কষে ধরলেন, কীরে তুই একা কেন? জামাই বাবাজি কই? মেজো ফুফু জড়িয়ে ধরে বললেন, কীরে তুই কেমন শুকিয়ে গেছিস।

তোর শ্বাশুড়ী কি কিপটে নাকি? তোকে খেতে দেয় নি? ফুফুর মুখের প্রশ্ন কেড়ে নিয়ে আপা চটজলদি বললেন, না না আমার শ্বাশুড়ী সোনার মানুষ! উনার মতো ভালো মানুষ আজকাল দেখাই যায় না। ওমা দু'দিনেই শ্বাশুড়ীর গুণগানে পঞ্চমুখ! বললেন ছোট চাচী। বড় চাচী আপার মুখে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, মেয়ে আমার হীরা, শ্বাশুড়ী তো সোনার মতোই হবে! আমাদের বাড়ীর সবচেয়ে প্রবীণ কাজের ঝি কান্তির মা কলপাড় থেকে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে আধা দৌড়ে জটলায় এসে বললেন, আমাদের জজ সাহেব কোন ধাতুর মরদ তা তো কেউ জানলে না গো? কান্তির মার কথা শুনে সবাই হু হু করে হেসে উঠেন। বাংলা ঘরের পূর্ব পাশটায় জাম গাছের নীচে চৌকিতে বসে বড় চাচী হীরা আপার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছেন। মাঝে মাঝে দু'একটা উকুন আনার ভান করছেন এবং গল্পচ্ছলে অভিজ্ঞ চাচী বৈবাহিক জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়ে খোজ খবর নিচ্ছেন।

এক পর্যায়ে আপা আবেগময় হয়ে উঠেন। তার কন্ঠ ভারী হয়ে আসে। চোখ ভিজে যায় কষ্টের নোনা পানিতে। মাথায় হাত বুলিয়ে চাচী যেই মাত্র বললেন, মা হীরা আমরা বেঁচে থাকতে তোর এতো কষ্ট কিসের? এবার কষ্টের বাঁধ ভেঙ্গে প্রবল বেগে উপচে পড়ে আপার তপ্ত অশ্রুমালা! ডুকরে কেঁদে উঠেন। কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, চাচী, 'জজ' সাহেব তো আমাকে বিয়ে করে নি, আমার উপর করুণা করেছেন।

তাও নাকি তার দায়িত্ববোধ থেকে করেছেন! কিছুটা উত্তেজিত হয়ে আপা স্বগোক্তি করেন একটা খুনির আবার দায়িত্ববোধ! তোমরা তো এতো দিন বলতে, মিঠুন একটা বেঈমান, নিমক হারাম। কিন্তু আসল ঘটনা আমরা কেউই জানতাম না। তার সম্পর্কে আমরা কত বাজে ধারণা পোষণ করেছি। কাঁদতে কাঁদতে আপা বললেন চাচী, সে হারিয়ে যায় নি, তাকে শেষ করে দেওয়া হয়েছে। নোংড়া রাজনীতির নির্মম শিকার তোমাদের মিঠুন।

বিস্ময়াভিভূত চাচী কাতর হয়ে বললেন, হীরা তুই এসব কী বলছিস? আমি তো এর আগা-মাথা কিছুই বুঝছি না। আপা বিক্ষুব্দ চাপা কন্ঠে বললেন, এপ্রিলের যে সন্ধ্যায় মিঠুন বাজারে গিয়ে আর ফিরে আসে নি সে দিনটি ছিল ওর শেষ দিন। ঐ বছর মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ে মিঠুনের দলের সাথে অপর একটি ছাত্র সংগঠনের সংঘর্ষে ওদের এক কর্মী নিহত হয়। এই হত্যার বদলা এবং তার দলকে দুর্বল করে দেয়ার মানসে প্রতিপক্ষরা তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে সর্বহারা পার্টির সন্ত্রাসীদের ভাড়া করে। সেদিন ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীরা তাকে পদ্মার চরে নিয়ে নির্মমভাবে খুন করে।

এই ঘৃণ্য প্রক্রিয়ার সাথে তোমাদের জামাই জড়িত ছিল। ভিন্নমতের রাজনীতি করলেও তার সাথে মিঠুনের ছিল ভালো সম্পর্ক। আর এই সম্পর্কের কারণেই সেদিন 'জজ' সাহেব মিঠুনকে সর্বহারা সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে দিতে পেরেছিল। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত আপা চাচীর কোলে মাথা রেখে বললেন চাচী, ওর মুখে এসব শুনে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে। ধরা গলায় বললাম, আপনার ঘনিষ্ঠ ইয়ারমেটকে সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে দিতে পারলেন? জজ সাহেব সহজ-সরল-নিরাবেগ কন্ঠে জবাব দিলেন, আমাকে বাধ্য করা হয়েছিল! ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।