সেদিন, গ্রীষ্মের এক দীর্ঘ দুপুরে পাঁচ সন্তানকে স্থবির করে চলে গেলেন মা। তীব্র কান্নায় খানখান হাসপাতাল। দুরে বিমুঢ় জিজ্ঞাসা নিয়ে দাঁড়িয়ে পিতা। অর্ধশতাব্দিরও আগে তিনি এসেছিলেন। পুতুল খেলার পর্ব পেরিয়ে তখন সদ্য ছু-কিতকিত আর বউচি’তে ওস্তাদি চলছে।
বুকে বই চেপে বেনী দুলিয়ে নবম শ্রেনীতে পড়তে যান। চোখে মুখে তখনও বিষ্ময়ের অমোঘ রেখা। সন্ধ্যায় মায়ের পাশে বসে নীতিকথা পড়ায় ছিল আশ্চর্য নেশা। তখন, সেই অর্ধশতাব্দিরও আগে, তিনি এলেন। কাদাজলে ভেসে যাওয়া এক পিছল সংসারে।
ছয় সন্তানের জ্যেষ্ঠটি তাঁর স্বামী। গাঁয়ের স্কুলেই পড়ান। স্কুল মাষ্টার হলেও স্বামী ততদিনে বিশ্ব সাহিত্য মুঠোয় ধরেছেন। অন্নদা পাবলিক লাইব্রেরীতে অবিরাম তাঁর ঘোরাঘুরি। এডয়ার্ডের সামনে স্থির হয়ে যায় পা।
এইখানে তিনি পড়াবেন একদিন...। স্বপ্ন জড়ো হয় চোখে।
স্বপ্নে আঘাত আসতেও দেরি হয় না। পিতামহের অকাল প্রয়ানে অনিবার্যভাবে সব দায়িত্ব চলে আসে তাঁর কাঁধে। মা, পাঁচ পাঁচটা ভাই, আর এক বোনের সব দৃষ্টি তখন আটকে যায় তাঁর চোখে।
আর সেইসব চোখের সব ক্লান্তি তুলে নেন তিনি, যিনি অসমাপ্ত নবম শ্রেনী ফেলে সদ্য এই সংসারে জমেছেন । শাড়ীর খুঁটে শক্ত করে বেঁধে নেন চাবি...সেই এক শুরু... অকান্ত...অশেষ এক পথের জীবনযুদ্ধে তুমুল আয়োজনে নির্ভীক পদক্ষেপ ফেলার প্রথম প্রয়াস ।
সন্তানের মুখ ধরে চুমো খাওয়ার অবকাশ তখন কোথায়! চিড়ে-মুড়ি-গুড় খেয়ে তখন টালমাটাল সংসারকে এক শক্ত ভিতে দাঁড় করানোর সংগ্রাম। দিনভর পরিশ্রমের পর রাতে বিধস্ত শরীরে নিজের ঘরে ফেরা, সন্তানদের ঠিকঠাক করে শুইয়ে দেওয়ার পর চলে দম্পত্তির অপুর্ব প্রেম। রবীন্দ্রনাথ,মানিক,মিল্টন,শরৎ, শেক্সপিয়র, কিটস,হুগো আস্তে আস্তে ঢুকে পড়ে মজ্জায়।
‘প্রাগৈতিহাসিক’শুনতে শুনতে ঘুম সরে যায় চোখে। প্যারাডাইস লষ্ট শুনে তন্ময়তায় ডুবে যান তিনি। রবীন্দ্রনাথের গান তাঁকে পৌঁছে দেয় এক অদীন ভুবনে... স্বামীকে আঁকড়েই চলে সাহিত্যচর্চা, যা তাঁর জীবনচর্যাকেই বদলে দেয়,ঋদ্ধ হয়ে ওঠে মন।
পিতামহীর সমাপ্ত গদ্যে আগুনের অসংখ্য আয়োজন। সেই আগুন খেতে খেতেই পেকে যায় চুল।
বাইশ বছর বাঁধা পড়ে এক চাকাতেই। তাই চৌকাঠ পেরিয়ে শরতের স্নিগ্ধতা দেখা হয় না তাঁর। শাড়ীর আঁচলে লেখা হয় না কোনও পিঠে-পার্বনের গন্ধ। তবু হেমন্তের ধূসরতার মুখোমুখি হয়েও দিনাতিপাতকে কীভাবে দিনযাপনে বদলে ফেলা যায় তার অনুশীলনে ব্যস্ত থাকে মন। কোনও গ্লানি নয়,ক্ষোভ নয়, অন্যের প্রতি বিদ্বেষ নয়, শুধু ভালবাসার আবহে গড়ে ওঠে একটি বাড়ী,একটি সংসার।
উঞ্চতার বলয়ে সকলকে ঢেকে দেন তিনি।
এই তো সেদিন,গ্রীষ্মের দীর্ঘ দুপুরে পাঁচ সন্তানকে রেখে চলে গেলেন তিনি। কাদাজলে ভেসে থাকা পিছল সংসারে ইস্পাতকঠিন প্রত্যয় জাগিয়ে। অর্ধশতাব্দি জুড়ে জীবনের এক অপূর্ব আখ্যান লিখে তিনি বিশ্রাম নিতে গেলেন।
মায়ের কবরের পাশে দাড়িয়ে এইসব ভেবে ভিজে উঠলো সাত রাজার ধন হারানো সন্তানের মন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।