ডিজিটাল বিপ্লবের শুরু থেকেই ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের প্রাইভেসি বা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা নিয়ে বেশ কিছু সিকিউরিটি ফার্ম গবেষণা করে আসছে। এসব প্রতিষ্ঠান জানায়, বিভিন্ন বিজ্ঞাপনদাতা ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর গতিবিধি এমনভাবে লক্ষ করে থাকে যে তার সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য বিজ্ঞাপনদাতা পেয়ে যায়, যা দিয়ে সেই ব্যক্তিকে রীতিমতো ব্ল্যাকমেইল করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ-একজন মানুষ গুগলে কী কী সার্চ করেন তা দেখেই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, পছন্দ-অপছন্দ ইত্যাদি সম্পর্কে অনেকটা অনুমান করে নেয়া যায়।
ব্যবহারকারীর গোপনীয়তা সবচেয়ে বেশি হরণ করা হয় সোস্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ফেসবুকে। কখনও লক্ষ করেছেন ফেসবুকের বিজ্ঞাপনগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আপনার পছন্দের মধ্যেই কেনো হয়? ফেসবুকে প্রাইভেসি নিয়ে কথা বললে অনেকেই বলেন ‘আমি আমার মোবাইল নম্বর, বাসার ঠিকানা, ব্যক্তিগত ছবি ইত্যাদি ফেসবুকে দেব না, তাহলে তো হলো।
’ কথাটি মস্তবড় ভুল। কেননা, আপনি ফেসবুকে কোন কোন অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করেন, কী ধরনের পেজ পছন্দ করেন, কী ধরনের পেজে ইন্টারেক্ট করেন এসব তথ্য আপনার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে ফুটিয়ে তুলতে পারে, যা ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে উদ্ধার করা হয়তো সম্ভব নয়। তথাকথিত প্রাইভেসি সেটিংয়ের মাধ্যমে আপনার পছন্দ-অপছন্দ হয়তো অন্যদের সামনে থেকে আপনি লুকিয়ে রাখছেন, কিন্তু ফেসবুক সেই তথ্য ঠিকই জানে। আর এসব তথ্যই ফেসবুক শেয়ার করে থাকে বিজ্ঞাপনদাতাদের সঙ্গে। যার ফল আপনার পছন্দ অনুযায়ী টার্গেটেড বিজ্ঞাপন!
একজন ব্যবহারকারী চাইলেই তার ব্রাউজিং আচরণ লুকিয়ে রাখতে পারেন না।
বিভিন্ন ইন্টারেক্টিভ ওয়েবসাইটের সামনে তার পছন্দ-অপছন্দ ফাঁস হয়ে যাচ্ছেই। আর অনেকেই এমনটা চান না। তাই এমন পরিস্থিতিতে নতুন এক প্রযুক্তির আবির্ভাব ঘটাল মজিলা ফাউন্ডেশন।
ডু নট ট্র্যাক নামের এই প্রযুক্তিটি মূলত আবিষ্কার করেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা। এরপর এটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে।
পাশাপাশি ফেডারেল ট্রেড কমিশন (এফটিসি) ডু নট ট্র্যাক সুবিধা যাচাই করে দেখছে বহুদিন ধরেই। ধারণা করা হচ্ছে, শিগগিরই ডু নট ট্র্যাক সুবিধাটি আইনের অংশ হতে পারে, যাতে করে ব্যবহারকারীরা তাদের নিজস্ব তথ্য ও গতিবিধির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পেতে পারেন। এটি আইনের অন্তর্ভুক্ত হলে ওয়েবসাইট মালিকরাও ডু নট ট্র্যাক সুবিধাটি তাদের সাইটে চালু রাখতে আইনগতভাবে বাধ্য থাকবে। তবে ইতোমধ্যেই ব্যাপক জনপ্রিয় ব্রাউজার ফায়ারফক্সের নতুন সংস্করণে এবং ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার ৯-এ এই সুবিধাটি চালু করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, মজিলা ফাউন্ডেশনের দেখাদেখি অ্যাপলও তাদের ব্রাউজার সাফারির পরবর্তী সংস্করণে ডু নট ট্র্যাক সুবিধাটি যোগ করার ঘোষণা দিয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ডু নট ট্র্যাক কী এবং এটা কীভাবে কাজ করে।
ডু নট ট্র্যাক কী?
ডু নট ট্র্যাক হচ্ছে মূলত ব্যবহারকারীর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটকে পাঠানো একটি নির্দেশ। যখনই কোনো ওয়েবসাইট ভিজিট করবেন, ডু নট ট্র্যাক চালু থাকা অবস্থায় সেই সাইটটিকে জানিয়ে দিতে পারবেন যে, ব্রাউজিং বিহেভিয়র গোপন রাখতে চাচ্ছেন এবং আপনি কোন কোন সাইট দেখছেন, কী বিষয়ে পড়ছেন ইত্যাদি তথ্য যেন ট্র্যাক না করা হয় সেই নির্দেশ দিচ্ছেন। এই নির্দেশ পেলে ওয়েবসাইটগুলোও আপনার গতিবিধি আর পর্যবেক্ষণ করবে না এবং বিজ্ঞাপনদাতাও আপনাকে ‘অজ্ঞাত ব্যবহারকারী’ ধরে নিয়ে সাধারণ কিছু বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করবে।
ডু নট ট্র্যাক কীভাবে কাজ করে?
প্রতিবার কোনো ওয়েবসাইট ভিজিট করার সময় ব্রাউজারের ঠিকানার ঘরে ঠিকানা লিখে এন্টার চাপার সাথে সাথে ব্রাউজার সংশ্লিষ্ট সার্ভারে একটি এইচটিটিপি হেডার রিকোয়েস্ট পাঠায়।
এই রিকোয়েস্ট ব্রাউজার, ব্রাউজারের সংস্করণ, অপারেটিং সিস্টেম, স্ক্রিন রেজ্যুলেশন ইত্যাদিতে নানা টেকনিক্যাল তথ্য থাকে। সার্ভার ঠিক সেই তথ্য অনুযায়ীই ডাটা পাঠায়। এজন্য কোনো সফটওয়্যার ডাউনলোড করতে গেলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজ, ম্যাক না-কি লিনআক্স, তা ওয়েবসাইট নিজেই বুঝে নিতে পারে।
ডু নট ট্র্যাক সুবিধাটি মূলত এই হেডারেরই অংশবিশেষ। এইচটিটিপি হেডারে নতুন একটি ফিল্ড তৈরি করা হয়েছে ‘ডু নট ট্র্যাক’ নামে।
যার রয়েছে দুটি ভিন্ন ভ্যালু। ০ (শূন্য) ভ্যালু হলে সবসময়ের মতোই ব্যবহারকারী কোন কোন সাইট দেখছেন, কী ধরনের কনটেন্ট পড়ছেন তার ওপর ভিত্তি করে বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হবে। আর ১ (এক) ভ্যালু হলে ব্যবহারকারীর গতিবিধি লক্ষ করা হবে না। অর্থাৎ ব্যবহারকারী পূর্ণ স্বাধীনতার সাথে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ভিজিট করতে পারবেন। তার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ বা তিনি কোন সাইট ভিজিট করছেন-না করছেন এসব ট্র্যাক করবে না গুগল বা এ জাতীয় কোনো বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠান।
অর্থাৎ ডু নট ট্র্যাক এইচটিটিপি হেডার রিকোয়েস্টের মাধ্যমেই সংশ্লিষ্ট সাইটকে জানিয়ে দেবে, এই ব্যবহারকারী সব ধরনের ট্র্যাকিংয়ের বাইরে থাকতে চান। তবে এখনই ডু নট ট্র্যাক খুব একটা কার্যকর হয়ে উঠছে না। কারণ, ডু নট ট্র্যাক কাজে লাগাতে হলে সংশ্লিষ্ট সাইটেও সেই সুবিধা থাকতে হবে। শুধু ওয়েবসাইটে ডু নট ট্র্যাক সুবিধা চালু রাখলেই এটি কাজে আসবে। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে বিষয়টি পাস হলেই প্রতিটি সাইটের ডু নট ট্র্যাক সুবিধা রাখা বাধ্যতামূলক হবে।
উল্লেখ্য, ডু নট ট্র্যাক ব্যবহার করে বেআইনি কাজ করাও সম্ভব হবে না। কারণ, ডু নট ট্র্যাক শুধু ব্যবহারকারীর গতিবিধি লক্ষ রাখা থেকে বিরত থাকবে। ব্যবহারকারীর অবস্থান, আইপি ঠিকানা ইত্যাদি যাবতীয় তথ্য ঠিকই রেকর্ড রাখবে যাতে করে বেআইনি কাজের ক্ষেত্রে অপরাধীকে খুঁজে বের করা সহজ হয়।
কীভাবে চালু করবেন ডু নট ট্র্যাক অপশন?
ফায়ারফক্স ৪ এবং ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার ৯-এর ব্যবহারকারীরা চাইলেই চালু করতে পারেন ডু নট ট্র্যাক সুবিধা। এখন পর্যন্ত হাতেগোনা কয়েকটি সাইটে ডু নট ট্র্যাক সুবিধা কাজ করে।
তবে শিগগিরই ডু নট ট্র্যাক ইন্টারনেটব্যাপী ছড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই জেনে রাখুন কীভাবে চালু করবেন ডু নট ট্র্যাক ফিচারটি।
ফায়ারফক্স ৪-এর জন্য : ফায়ারফক্সের মেনু থেকে অপশনসে ক্লিক করলে যে উইন্ডোটি আসবে সেখান থেকে অ্যাডভান্সড আইকনে ক্লিক করুন। এরপর জেনারেল ট্যাবে ক্লিক করুন। এবার ব্রাউজিং সেকশনের চেকবক্সে tell websites I do not want to be tracked চেক দিয়ে ওকে করে বেরিয়ে এলেই চালু হয়ে যাবে ফায়ারফক্স ৪-এর ডু নট ট্র্যাক সুবিধা।
ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার ৯-এর জন্য : ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার ৯-এর রয়েছে ডু নট ট্র্যাক সুবিধা। ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার ৯-এর পূর্ণ সংস্করণের ব্যবহারকারীরা ডান পাশের অপশন আইকনে ক্লিক করে সেফটিতে ক্লিক করুন। ফ্লাই আউট মেনু থেকে ট্র্যাকিং প্রোটেকশন মেনুতে ক্লিক করুন। এরপর নতুন ডায়ালগ বক্সের নিচের ডান পাশে এনাবল বাটনে ক্লিক করলে নতুন আরেকটি উইন্ডো আসবে। এই উইন্ডোতে কোন কোন সাইট আপনার গতিবিধি ট্র্যাক করে থাকে তার একটি সাধারণ তালিকা দেয়া থাকবে।
আপনি চাইলে এখান থেকে পছন্দসই সাইটগুলোকে আলাদাভাবে ব্লক করতে পারবেন বা Automatically Block রেডিও বাটনে ক্লিক করে ‘ওকে’ করে বেরিয়ে আসতে পারবেন। ফলে কোনো সাইটই আপনার গতিবিধি লক্ষ রাখার অনুমতি পাবে না।
ডু নট ট্র্যাকের অন্যতম সুবিধা হচ্ছে, এই প্রযুক্তি সব ধরনের সাইটেই কার্যকর করা যাবে এবং এটি সাইটের কার্যকারিতায় কোনো প্রভাব ফেলবে না। তবে বিজ্ঞাপনদাতারা ব্যবহারকারীর ব্রাউজিং আচরণ সম্পর্কে তথ্য জানতে না পারলেও ব্যবহারকারীর কমপিউটারে বা সাইটে ম্যালিশিয়াস কোড বা প্রোগ্রাম থাকলে (যেমন- কী-লগার) তা ব্যবহারকারীর তথ্য হাতিয়েই নেবে। এক্ষেত্রে ডু নট ট্র্যাকের কিছু করার নেই বলে জানিয়েছেন ডেভেলপাররা।
ইন্টারনেটের কল্যাণে জ্ঞানের এক বিশাল ভান্ডার চলে এসেছে আমাদের হাতের মুঠোয়। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে জ্ঞান ও তথ্যের এক বিশাল রাজ্যে অবাধ প্রবেশাধিকার মিললেও নিজেদের অজান্তেই ব্যবহারকারীদের নিয়ে বাণিজ্য করে চলেছে বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। পার্থক্য একটাই, এই বাণিজ্যেও মুদ্রা হলো ইউজার ইন্টারেস্ট। ডু নট ট্র্যাক সুবিধা ব্যবহারকারীর সেই বিক্রি হয়ে যাওয়াকে পুরোপুরিই ঠেকাবে বলে বিশ্বাস প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের
সূত্র: Click This Link
Click This Link এর সৌজন্যে ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।