আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

র‌্যাব-পুলিশের ‘লঙ্ঘন’

ট্রাফিক আইন ও এর লঙ্ঘন—বিষয়টি আসলে কী? এ রকম কিছু ঢাকা শহরে আছে নাকি! গত রোববার প্রথম আলোয় একটি এক কলাম বক্স নিউজ দেখে এ ধরনের বেয়াড়া প্রশ্ন মনে জাগল।
ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, র‌্যাব ও পুলিশের তিনটি গাড়ি আটক করল পুলিশ—এই হচ্ছে খবরের শিরোনাম। ভেতরে লেখা আছে, ‘বিকেল পাঁচটার দিকে শাহবাগে রূপসী বাংলা হোটেল-সংলগ্ন ভিআইপি রোডের উল্টো দিকে পৃথক সময়ে র‌্যাবের সদর দপ্তরের একটি গাড়ি ও পুলিশের দুই কর্মকর্তার দুটি গাড়ি আসে। ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে উল্টো দিকে আসায় ওই তিনটি গাড়িকে আটক করা হয়। ইফতারের আগ পর্যন্ত গাড়িগুলো আটকে রাখা হয়।

আটকের সময় পুলিশ ও র‌্যাবের কর্মকর্তারা গাড়িতে ছিলেন। ’
উল্টো পথে গাড়ি চলা কি ঢাকায় নতুন কিছু? এতে যে ট্রাফিক আইন ‘লঙ্ঘন’ করা হয়, এটা তো ভুলতেই বসেছে লোকজন। শনিবার সন্ধ্যায় হঠাৎ কী এমন ঘটল যে র‌্যাব ও পুলিশের তিন-তিনটি গাড়ি কর্মকর্তাদেরসহ আটকে রাখা হলো ইফতারের আগ পর্যন্ত? তাড়াতাড়ি ইফতার করবেন বলেই না তাঁরা উল্টো পথ ধরেছিলেন! হঠাৎ তাঁদের ওপর এই খড়্গ কেন?
প্রথম আলোর প্রতিবেদন বলছে, শনিবার বিকেলে ট্রাফিক পরিস্থিতি দেখতে রাস্তায় নেমেছিলেন ট্রাফিক পুলিশ দক্ষিণের উপকমিশনার খান মোহাম্মদ রেজোয়ান। তখনই তাঁর চোখে পড়ে ট্রাফিক আইন ‘অমান্য’ করার এমন ভয়াবহ ঘটনা। সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা, আটক করা হয় র‌্যাব-পুলিশের তিন গাড়ি।

পুলিশ মহাপরিদর্শকের নির্দেশে ট্রাফিক আইন অমান্যকারীদের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে তিনি নিশ্চিতও করেছেন।
ঘটনাটি অবাক হওয়ার মতোই। ঢাকা শহরের প্রায় সব রাস্তায় এখন উল্টো পথে গাড়ি চলে। বছর দুয়েক ধরে বিষয়টি মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছি। উল্টো পথে চলার জন্য কখনো কোনো ট্রাফিক পুলিশকে কোনো গাড়িকে আটকাতে বা এমনকি ঘুরিয়ে দিতেও দেখিনি।

বরং উল্টো পথে আসা গাড়িকে অন্য যানবাহন আটকে পার করার কাজে ট্রাফিক পুলিশকে সহায়তা করতে দেখেছি।
উল্টো পথে চলা এই গাড়িগুলোর কিন্তু বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রায় সব গাড়িই দামি দামি চেহারার। বোঝাই যায় ‘বড় বড়’ লোকজন চলাচল করেন এসব গাড়িতে। আছে সরকারি ও বিভিন্ন সংস্থার বিভিন্ন গাড়ি, যেগুলোতে কারণে-অকারণে ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড লাগানো থাকে।

চালকেরা উল্টে পথে গাড়ি চালান আর গাড়িগুলোর এসব ‘বড় বড়’ আরোহী বা কখনো কখনো তাঁদের পরিবারের লোকজনকে তা উপভোগ করতেই তো দেখি।
কাক নাকি কাকের মাংস খায় না। কিন্তু না খেয়ে উপায় নেই। উল্টো পথে চলা যানবাহনের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে সম্ভবত ‘প্রেস’, ‘সংবাদপত্র’ এসব লেখা বা বিভিন্ন টিভির স্টিকার লাগানো গাড়িগুলো। এমন সাংবাদিকও আছেন যাঁদের মোটরসাইকেলের নম্বর প্লেটে কোনো নম্বর নেই, লেখা আছে ‘সাংবাদিক’।

ভাবটা এমন যে সাংবাদিকের জন্য কোনো আইন নেই।
সাংবাদিক-অসাংবাদিক সবাই এই সুযোগটি নিতে চান। একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির স্টাফদের আনা-নেওয়া করে এমন একটি গাড়িতে দেখি এক টিভি চ্যানেলের স্টিকার। কেন? ওই টিভির মালিকদের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিও রয়েছে। আইন ভাঙলেও পুলিশ সাংবাদিকদের গাড়ি ধরে না, এখন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির গাড়িও সেই সুযোগ নিতে চায়! আমাদের ট্রাফিক পুলিশ এসব সবই মেনে নিয়েছে।

উল্টো পথে চলার জন্য হঠাৎ তিনটি গাড়ি আটক, তাও আবার র‌্যাব-পুলিশের গাড়ি! ব্যাপারটি কেমন যেন আজগুবি মনে হচ্ছে।
খোঁজখবর নিয়ে জানলাম, ট্রাফিক পুলিশের (দক্ষিণ) উপকমিশনার খান মোহাম্মদ রেজোয়ান এই দায়িত্বে এসেছেন মাস চারেক আগে। এই দায়িত্ব নেওয়ার পর চোখ-কান একটু বেশি খোলা রেখেই নিশ্চয়ই তিনি ঢাকার ট্রাফিক পরিস্থিতি নজরে রেখেছেন। উল্টো পথে গাড়ি চলা নিয়ে ওপরে যে পর্যবেক্ষণের কথা বললাম, তার সঙ্গে তিনি খুব দ্বিমত করতে পারবেন বলে মনে হয় না।
শনিবার সন্ধ্যায় রূপসী বাংলার মোড়ের ঘটনা নিয়ে বিস্ময় বা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের বিষয়টি থাক।

আসুন, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের জন্য পুলিশ ও র‌্যাবের তিন গাড়ি আটককে আমরা বরং সাধুবাদ জানাই। আমরা কেন ধরে নিচ্ছি না যে নিজেদের ওপর আগে কঠোর হয়ে অন্যের ওপর আইন প্রয়োগের পথ তৈরি করা হলো এর মধ্য দিয়ে। উল্টো পথে গাড়ি চালানো একেবারে বন্ধ করতে এটাই তো হতে পারে বড় দৃষ্টান্ত। আইন ভাঙলে কারোই যে রেহাই নেই—এমন ধারণা তৈরি করাই তো জরুরি!
আমরা ধরে নিতে চাই, ট্রাফিক পুলিশের উপকমিশনার খান মোহাম্মদ রেজোয়ান সেই পরিস্থিতিটিই তৈরি করেছেন। এখন কাজটি হচ্ছে, আজ থেকেই উল্টো পথে গাড়ি চালানোর বিরুদ্ধে অভিযানে নেমে পড়া।

ট্রাফিক পুলিশ কি এখন থেকে সেই কাজটি শুরু করবে?
র‌্যাব ও পুলিশের কর্মকর্তারা গাড়িতে ছিলেন। এর পরও আইন ভাঙার কারণে ট্রাফিক পুলিশ তাঁদের গাড়ি আটক করেছে। এখন আইন ভঙ্গের দায়ে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। এটাই যখন সম্ভব হয়েছে, তখন দামি দামি চেহারার যে গাড়িগুলো ‘বড়দের’ বহন করে, সেই গাড়িগুলো আটকানো যাবে না কেন? কেন ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না উল্টো পথে চলা সংবাদপত্র বা টিভির স্টিকার লাগানো গাড়িগুলোর বিরুদ্ধে?
উল্টো পথে গাড়ি চালানো লুকিয়েচুরিয়ে আইন ভাঙার বিষয় নয়! এটা একধরনের প্রকাশ্য অসভ্যতা। এই প্রকাশ্য অসভ্যতা থেকে শহরটিকে মুক্তি দিন।


এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।