আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হাউ ডিড প্রফেসর মিরাজ ডাই

কিচ কিচ কুচ কুচ কাচ কাচ কোচ কোচ!!! ৪ টাইম মেশিন চালু হল। টাইম মেশিনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে প্রফেসর মিরাজের চোখ ভয়ে ছানাবড়া হয়ে গেল। প্রফেসর মিরাজ ভয়াবহ আতঙ্কের সাথে দেখলেন, তার ল্যাবরেটরি ভয়াবহ বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে গেছে। বাংলাদেশী পত্রিকায় কয়েকজন বিদেশী বিজ্ঞানীর শোচনীয় মৃত্যুর খবর এসেছে। তাদের মধ্যে সবার প্রথমে খুব পরিচিত একটা নাম।

খুব পরিচিত। মিরাজ আহমেদ (৭০), প্রফেসর। ১ হৃদি পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে পত্রিকা পড়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু চোখের কথা মন শুনছে না। অথবা মনের কথা চোখ।

হৃদির টানা টানা চোখ, যেটা দেখে ক্লাসের এক তৃতীয়াংশ ছেলে, পাশের বাড়ির বাড়িঅলার স্বঘোষিত সুযোগ্য পুত্র এমনকি শাহবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ট্র্যাফিক পুলিশ পর্যন্ত একদিন থমকে দাঁড়িয়েছিল সেই চোখ কেন যেন পত্রিকার বিদঘুটে নিষ্প্রাণ কালো অক্ষরে আটকে থাকতে চাইছে না। হৃদির চোখ বারবার চলে যাচ্ছে তার সামনে বসা ছেলেটার দিকে। ছেলেটা তার সামনেই বসে আছে। হৃদির মনের ভিতর অদৃশ্য কোন গণিতবিদ আঁক কষে বলল, তাদের মধ্যে দূরত্ব খুব বেশি হলে তিন হাত। তিন হাত মানে চুয়ান্ন ইঞ্চি প্রায়।

দূরত্ব হিসেবে খুব একটা বেশি নয় কোনভাবেই। হৃদির দৃশ্যপট বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে। একবার পত্রিকা আর একবার ছেলেটার দিকে তাকাতে গিয়ে এমনিই তার চোখ ও হৃদয়ের বেশ পরিশ্রম যাচ্ছে, তার উপর আবার এই অস্বাভাবিক কখনও মৃদু কখনও জোরালো কাঁপুনি তার সমস্ত মনোযোগকে যেন তীব্রভাবে ভ্রূকুটি করছে। হৃদির চোখ বারবার ফোকাস চেঞ্জ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। হৃদির সবচেয়ে মেজাজ খারাপ হচ্ছে এই কারণে যে ছেলেটা তার দিকে চেয়েও দেখছে না।

কোন মেয়ে যদি কোন ছেলের দিকে বারবার আড়চোখে তাকায় তাহলে সেই তাকানোর মধ্যে নিশ্চয়ই কোন রহস্য আছে। কিন্তু আপাতত ছেলেটার সেই রহস্যভেদের দিকে কোন আগ্রহ নেই বলেই মনে হচ্ছে। ধ্যাত ছেলেটা এমন কেন? হৃদির খুব মেজাজ খারাপ হচ্ছে। ছেলেটা আরেকটু কুৎসিত হতে পারত। আরেকটু মোটা হতে পারত।

মুখে কালো কালো দু একটা দাগ থাকতে পারত। তার জামার নিচ দিয়ে সুপ্ত ভুঁড়ি উঁকি দিতে পারত। তাহলেও নাহয় একটা সান্ত্বনা থাকত। কিন্তু হায়রে হৃদির পোড়া কপাল! ছেলেটার কোনটাই নেই। ছেলেটা হ্যান্ডসাম, স্লিম, লম্বা, সুন্দর।

আর উদাসীন। একটা কৌতূহলী মেয়ের উৎসুক আড়চোখা দৃষ্টির প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন। মনীষী বালেহ তিয়াস বলেছিলেন, মেয়েরা সব সহ্য করতে পারে, শুধু সহ্য করতে পারে না অবহেলা। বালেহ তিয়াসের অশ্লীল স্ট্যাটাসের সাথে পরিচয় না থাকলেও হৃদি এখন এই সত্যটা হাড়ে হাড়ে জয়েন্টে জয়েন্টে পেশীতে পেশীতে টের পাচ্ছে। ছেলেটার উদাসী উদাসী ভাব হৃদির হৃদয়কে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে যেন।

যেন ঐ উদাসীনতা একটা বুলেট, একটা হৃদয়ভেদী বুলেট, এফোঁড় ওফোঁড় করে বারবার ছিন্ন করছে হৃদির মেয়েলি হৃদয়কে। হৃদি অবশেষে ঠাস করে পত্রিকাটা নামিয়ে রাখল। দেখুক ছেলেটা দেখুক। দেখুক যে তার সামনে কোন পুতুল নয়, একটা মেয়ে বসে আছে। ছেলেটা একবার হলেও তাকাক এদিকে।

কিন্তু বিধি বাম। ছেলেটার চোখ এতটুকু নড়ল না। সে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে তো আছেই। যেন বাইরের সাঁ সাঁ করে পিছনে ছুটে চলা গাছ পালা মাঠ ঘাঁট গরু ছাগলই সব, সে কেউ না। ধ্যাত্তেরিকা! হৃদি একটা কাজ করতে পারে।

হাতের পত্রিকাটা ছেলেটার সামনে ফেলে দিতে পারে। ছেলেটা নিশ্চয়ই ভদ্রতা করে পত্রিকা তুলে দিবে। নিশ্চয়ই দিবে। কিন্তু ছেলেটা বুঝে ফেলবে না তো? বুঝে ফেললে সে হৃদিকে ভাববেই বা কি? নিশ্চয়ই ভাববে হৃদি একটা নির্লজ্জ, বেহায়া মেয়ে। ছি ছি, এমন ভাবলে কেমন হবে ভাবতেই গা শিউরে ওঠে হৃদির।

ওর চেয়ে থাক না। গন্তব্য তো সেই ঢাকা, অনেক দূর। নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। নিশ্চয়ই একবার হলেও ছেলেটা তার দিকে তাকাবে। নিশ্চয়ই একবার হলেও তার সাথে কথা বলবে।

সুযোগ এল না। ছেলেটা সেই একমনে বাইরেই তাকিয়ে রইল। হৃদির হুট করে মনে হল, ছেলেটা বধির বা অন্ধ নয় তো? নাহলে সে একবারও এদিকে তাকাচ্ছে না কেন? মোবাইলেও তো কথা বলতে পারে, সেটাও তো করতে দেখা যাচ্ছে না। হ্যাঁ, একটা বুদ্ধি হৃদির মাথায় এসেছে। ছেলেটার কাছ থেকে মোবাইল চাওয়া যায়।

এমন তো হতেই পারে যে হৃদির মোবাইলের চার্জ ফুরিয়ে গেছে, সে তো আম্মুকে ফোন করার জন্য ছেলেটার কাছে মোবাইল চাইতেই পারে। এতে তো তেমন অস্বাভাবিক কিছু নেই! তাহলে সংকোচটা কোথায়? হৃদি আরও মিনিট পাঁচেক ধরে প্ল্যান করে অবশেষে পত্রিকাটা ছেলেটার পায়ের কাছে ছুড়ে ফেলাটাই শ্রেয় মনে করল। এবং ঠিক যখনই সে পত্রিকাটা ছুড়ে ফেলল ঠিক তখনই ছেলেটা উঠে দাঁড়াল। তারপর আরেক বগির দিকে চলে গেল। হৃদি রাগে দুঃখে আত্মহারা হয়ে পারলে যেন চিৎকার দিয়ে ওঠে।

কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল সে। এটা চলন্ত ট্রেন, এখানে তার চিৎকার করা মানায় না। হৃদি মনের দুঃখে মোবাইল বের করে তার ফেসবুক ফ্রেন্ডদের স্ট্যাটাস পড়তে লাগল। প্রায় সবার স্ট্যাটাসই গার্লফ্রেন্ড নাহলে বয়ফ্রেন্ড বিষয়ক। এদের ভালোবাসা চুইয়ে চুইয়ে পড়ার আদর্শ জায়গা ফেসবুক।

ধ্যাত, বিরক্তিকর। ছেলেটা ফিরে এল। নিজের সিটে বসল। হৃদির মন হুট করে ভাল হয়ে গেল। যাক, ছেলেটা অন্ধ নয়।

যাক বাবা, খুব ভালো খুব ভালো। এবার আর ছেলেটা বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকল না। তার ব্যাগ থেকে কি একটা বই বের করে পড়তে শুরু করল। বাহ, ছেলেটা দেখছি বেশ পড়ুয়া, ভাবল হৃদি। ভালোই তো।

হৃদি বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছেলেটার পোশাক আশাক লক্ষ্য করতে লাগল। হালকা নীল রঙের টি শার্ট। কালো প্যান্ট। অগোছালো চুল। পায়ের কাছে রাখা একটা হাতব্যাগ।

একটা টিফিন ক্যারিয়ার। ছেলেটা কী পড়ছে? বোঝা যাচ্ছে না। মনে হয় কোন ইংরেজি বই। ইংরেজি বই! বাবা রে বাবা! ছেলেটা কি হৃদির সামনে নিজেকে জ্ঞানীগুণী প্রমাণ করার জন্য ইংরেজি পড়ছে? কি জানি! এমন সময় অপ্রত্যাশিতভাবেই হৃদি যে সুযোগটা চাচ্ছিল, সেই সুযোগটা এসে গেল। হৃদি আড়চোখে দেখল, ছেলেটা পকেট থেকে মোবাইল বের করে হতাশ হয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে।

তার মোবাইল অন হচ্ছে না। তার মোবাইলের চার্জ শেষ। ছেলেটা প্রথমে আশেপাশে তাকাল। যেন কি করবে বুঝতে পারছে না। হৃদিই শেষমেশ সাহস করে বলে উঠল, “মোবাইল লাগবে?” ছেলেটা প্রথমে যেন তার কথা শুনতে পেল না।

হৃদি আবার বলল, “এই যে মিস্টার, মোবাইল লাগবে?” ছেলেটা এবার হৃদির দিকে তাকাল। হৃদি লক্ষ্য করল ছেলেটার চোখ কেমন ভাসা ভাসা। ছেলেটার স্বভাবসুলভ উদাসীনতা শুধু এই ধরণের চোখেই মানায়। হৃদি নিজের মোবাইল এগিয়ে দিয়ে বলল, “এটা নিন। কথা বলুন, টাকা নেব না”।

ছেলেটা বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মোবাইলটা হৃদির হাত থেকে নিল। কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে বলল, “থাক লাগবে না। থ্যাঙ্ক ইউ”। হৃদি ঈষৎ অপমানিত বোধ করল। সে ছেলেটাকে জোর করল, “নিন না, লজ্জা করবেন না।

বিপদে তো আমিও পড়তে পারতাম”। ছেলেটা তবু মোবাইলটা ফিরিয়ে দিল। বলল, “থাক, দরকার নেই। ধন্যবাদ”। হৃদি মোবাইলটা ফিরিয়ে নিল।

ছেলেটা ইতস্তত করে একবার বাইরে একবার ভিতরে তাকাতে লাগল। ঠিক সেই মুহূর্তে হৃদির পাশের সিটে বসা ভদ্রলোক উঠে কই যেন চলে গেলেন। হৃদি সুযোগের সদ্ব্যবহার করল। সে বলল, “আপনি যাচ্ছেন কোথায়?” ছেলেটা অবাক হয়ে হৃদির দিকে তাকাল। হৃদি বলল, “কি হল? আপনি যাচ্ছেন কোথায়?” ছেলেটা বলল, “ঢাকা”।

হৃদি হেসে ফেলল। “সে তো আমরা সবাই ঢাকা যাচ্ছি। ঢাকার কোথায়?” ছেলেটা বলল, “কমলাপুর রেলস্টেশন”। হৃদি এবার হো হো করে হেসে ফেলল। “আরে সেটা বলছি না, বলছি আপনার বাসা কোথায়? রাতটা কাটাবেন কোথায়?” ছেলেটা এবার তীক্ষ্ণ চোখে বলল, “আপনি এত কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন? আপনি কে?” এ কি ধরণের ছেলে রে বাবা! হৃদি অবাক হয়ে গেল।

ছেলেটাকে দেখে তো অনেক বড় মনে হয়, কিন্তু সে তো বাচ্চা! জীবনেও মনে হয় মেয়েদের সাথে কথা বলে নি। হৃদি বলল, “আমি হৃদি। অমুক ভার্সিটিতে বিবিএ পড়ি। থার্ড ইয়ার। আপনি?” ছেলেটা বলল, “আপনার কাছে কে এসব শুনতে চেয়েছে?” হৃদি অপমানে নীল হয়ে গেল।

এমন অপমান তাকে জীবনেও কেউ করে নি। হৃদি স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। তার সাধ মিটে গেছে। তার সামনের সিটে একটা ছাগল বসে আছে। ছাগলটা ভ্যা ভ্যা করে ডাকে।

কাঁঠালপাতা খায়। এভাবে কেটে গেল প্রায় আধঘণ্টা। তারপর হুট করে ছেলেটা বলল, “আপু...” হৃদির মেজাজ আবার খারাপ হয়ে গেল। ছেলেটা তাকে আপু ডাকছে কেন? সে কি ছেলেটাকে ভাই ডেকেছে? ছাগলটা দেখি কিছুই বোঝে না। পুরাই ছাগল।

এর টিফিন ক্যারিয়ারের ভিতর কি? কাঁঠালপাতার সাগু? পেয়ারাপাতা ভর্তা? ছেলেটা বলল, “মোবাইলটা একটু লাগত”। হৃদি গোঁজ হয়ে বসে রইল। ছেলেটা বলল, “আম্মাকে ফোন করতাম। আম্মা খুব টেনশন করছে”। আম্মাকে ফোন করতাম? আচ্ছা, ছেলেটা কি আমার চেয়ে ছোট? নাহলে এরকম ইম্ম্যাচিউওরের মত কথা বলে কেন? ছেলেটা আবার বলল, “দিন না।

দিলে খুব উপকার হত”। হৃদি গরম চোখে তার মোবাইলটা ছেলেটার দিকে আগিয়ে দিল। ছেলেটা মোবাইল খানিকক্ষণ টিপেটুপে সেটা আবার হৃদির হাতে ফিরিয়ে দিল। হৃদি অবাক হয়ে বলল, “কি হল? কথা বললেন না?” ছেলেটা বলল, “নাহ। আম্মা মনে হয় আমার সাথে কথা বলবে না”।

হৃদি কৌতূহলী হয়ে বলল, “কেন? কথা বলবে না কেন?” ছেলেটা বলল, “মৃত মানুষের সাথে কথা বলা যায় না”। হৃদি ভয়াবহভাবে চমকে উঠল। এ কি বলছে ছেলেটা! কে মৃত! হৃদি জড়িয়ে জড়িয়ে অনেক কষ্টে বলল, “আপনার মাথা ঠিক আছে?” ছেলেটা বলল, “দেখবেন?” হৃদি বলল, “কি?” ছেলেটা বলল, “আমার মাথা?” হৃদি নিদারুণ আতঙ্ক নিয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইল। ছেলেটা উল্টো ঘুরল। হৃদি স্পষ্ট দেখল ছেলেটার মাথার পিছনটা একদম ভাঙ্গা।

স্কাল বোনস ভেঙ্গে গেছে। মগজ চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। হৃদি ভয়াবহ আতঙ্কে চিৎকার দিয়ে উঠল। ছেলেটা বলল, “এইটুকুতে তো আতঙ্কিত হলে হবে না। শুধু তো আমি না, আপনিও মৃত”।

হৃদি অবিশ্বাসী দৃষ্টি হেনে বলল, “কি!” ছেলেটা বলল, “হ্যাঁ। পেপারটা খুলে দেখুন”। হৃদি তার হাতে ধরা পত্রিকাটা খুলে দেখল। আরে, পত্রিকাটা এরকম হয়ে গেল কখন? এই খবরগুলো তো পত্রিকায় ছিল না! পত্রিকার প্রথম পাতায়ই ট্রেন এক্সিডেন্টের ছবি। লাইনচ্যুত হয়ে ট্রেনের একাধিক বগি উল্টে গেছে।

নিহতদের ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে পনের নম্বরে একটা ছবি, খুব চেনা একটা ছবির মিরর ইমেজ, নিচে লেখা ফারিয়া রহমান হৃদি, বয়স একুশ, হাসপাতালে নেবার পর মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করতে করতে মৃত... হৃদির হাত থেকে পত্রিকা পড়ে গেল। হৃদি বলল, “আপনি কে? কে আপনি?” ছেলেটা হাসল। হাতের বইটা বন্ধ করল সে। তারপর বলল, “আমি ইউহান।

আপনি প্রফেসর মিরাজকে চেনেন?” হৃদি বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ বালেহ তিয়াস নামক এক সস্তা ফেসবুক লেখক মাঝে মাঝে উনাকে নিয়ে লেখেন...” ছেলেটা বলল, “আমি প্রফেসর মিরাজের সহকারী। পুত্রবত বলতে পারেন। আমাদের কয়েকজনের গত তিন বছরের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মাত্র এক মাস আগে আমরা টাইম মেশিন আবিষ্কার করতে সক্ষম হই। এই টাইম মেশিনে করে অতীত বা ভবিষ্যতে সশরীরে যাওয়া না গেলেও, অতীত বা ভবিষ্যতের দৃশ্য চোখের সামনে দেখা যায়। কিন্তু টাইম মেশিন বানানো হয়ে যাবার পর একটা ব্যাপার আমাদের চিন্তিত করে তোলে।

অতীতে যা হবার হয়ে গেছে, সেটা দেখলেই কি আর না দেখলেই কি, সেটা তো আর আমরা চেঞ্জ করতে পারব না। কিন্তু ভবিষ্যৎ দেখলে? ভবিষ্যৎ দেখলে যে কেউই চাইবে তার ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করতে। কেউ টাইম মেশিনে চড়ে তার মৃত্যু দেখলে নিঃসন্দেহে চাইবে সেই মৃত্যু প্রতিহত করার জন্য। কেউ টাইম মেশিনে চড়ে কোন দুর্ঘটনা দেখলে নিঃসন্দেহে চাইবে সেই দুর্ঘটনাস্থলে না যাবার জন্যে। কিন্তু সেই ব্যাপারটা কি প্রকৃতির স্বাভাবিক কর্মপদ্ধতিকে ব্যহত করবে না? ন্যাচারাল অর্ডারকে ওভাররাইড করার ক্ষমতা কি মানুষের আছে? টাইম মেশিনে দেখে দেখে বারবার নিজের মৃত্যুকে প্রতিহত করতে করতে প্রকৃতিকে কয়বার ধোঁকা দেয়া যাবে? প্রকৃতি কি এর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিবে না? টাইম মেশিন ব্যবহার করে কি শেষ পর্যন্ত মানুষ তার জীবনে দুর্যোগই বয়ে আনবে? আমরা ঠিক করি, টাইম মেশিনের আনুষ্ঠানিক ব্যবহার শুরু করার আগে এই ব্যাপারটা নিয়ে একটু ট্রায়াল দিয়ে দেখা প্রয়োজন।

সুতরাং সেই ট্রায়ালের ক্যান্ডিডেট খোঁজার উদ্দেশ্যেই আমরা তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশকে সিলেক্ট করি। আমরা তারপর বাংলাদেশে চলে এসে গোপন ল্যাবরেটরি গড়ে তুলি। কয়েকদিন আগে আমরা টাইম মেশিনে দেখতে পাই, আমাদের গবেষণাস্থল থেকে অনেক দূরে বাংলাদেশে নির্দিষ্ট এই তারিখে একটা ট্রেন এক্সিডেন্ট হবে। সেই এক্সিডেন্টে যারা মারা যাবে তাদের মধ্যে আপনি একজন। ব্যস, সবকিছু বিবেচনা করে আমরা ঠিক করে ফেলি, আপনিই হতে পারেন আমাদের উপযুক্ত ক্যান্ডিডেট।

আপনাকে কিভাবে পেলাম সেটা আর বিস্তারিত বলার প্রয়োজন বোধ করছি না। আর এই মুহূর্তে আপনি একটা থ্রি ডাইমেনশনাল সিমুলেশনের মধ্যে অবস্থান করছেন, সেটাও আপনাকে বিস্তারিত বুঝিয়ে বলবার প্রয়োজন বোধ করছি না আমি। শুধু জেনে রাখুন আজ একটু পরে নিজের বিছানা থেকে জেগে আপনি জানতে পারবেন যে একটু পরে আপনি যে ট্রেনটায় উঠতে যাচ্ছেন সেটা এক্সিডেন্টের শিকার হবে এবং আপনি মারা যাবেন, সুতরাং ট্রেনে উঠবেন কি উঠবেন না সেটা একান্তই আপনার নিজস্ব ব্যাপার। তবে ট্রেনে না উঠলে আপনি বাঁচবেন কিনা সেই গ্যারান্টিও আমি দিতে পারছি না, হয়তো অন্য কোন উপায়ে আরো তাড়াতাড়ি মারা যাবেন আপনি। প্রকৃতি খুব অদ্ভুতভাবে কাজ করে, সে কিভাবে আপনার উপর প্রতিশোধ নেবে আপনি বুঝতেই পারবেন না”।

হৃদি খুব মনোযোগ দিয়ে ছেলেটার কথাগুলো শুনল। তারপর সে বলল, “এই ট্রেন, এই ছুটে চলা, সব মিথ্যা?” ছেলেটা বলল, “সব মিথ্যা”। হৃদি ভাঙ্গা স্বরে বলল, “সবই থ্রি ডি সিমুলেশন? সবই? এমনকি আপনার দিকে আমার বারেবারে চোখ তুলে তাকানোটাও? আপনাকে দেখে আমার হৃদয়ের কাঁপুনিটাও?” ছেলেটা হেসে বলল, “হ্যাঁ। এই থ্রি ডি ওয়ার্ল্ড প্রফেসর মিরাজ নিজে ডিজাইন করেছেন। উনি এই বুড়ো বয়সেও অনেক রসিক”।

হৃদি অবাক হয়ে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইল। সে বিশ্বাস করতে পারছে না এই হাত তার হাত নয়, এই হাতের লোম তার আসল লোম নয়, এই ট্রেন আসল ট্রেন নয়, তার সামনে বসে থাকা এই অদ্ভুত সুন্দর ছেলেটা আসল ছেলে নয়, এই ছেলেকে দেখে তার বুকের মধ্যে তুমুল ধুকপুকানিটা সত্যি নয়, সে আসলে এই মুহূর্তে প্রফেসর মিরাজের দলের হাতে বন্দি, তার মাথায় হয়তো এই মুহূর্তে ঢুকে আছে অসংখ্য ইন্টারফেস, হয়তো তাকে এই মুহূর্তে গভীরভাবে লক্ষ্য করছেন কয়েকজন বিজ্ঞানী, তাদের মধ্যে হয়তো আছেন প্রফেসর মিরাজ... হৃদি কেঁদে ফেলল। তার চোখ থেকে পরাবাস্তব পানি বেরিয়ে এসে ভিজিয়ে দিল তার থ্রি ডাইমেনশনাল পরাবাস্তব ওড়না। ছেলেটি এগিয়ে হৃদির খুব কাছে এসে তাকে বলল, “আপনি চাইলে আমি আপনাকে কিস করতে পারি। আমার কিসে মন ভালো করার ফাংশন ডিজাইন করা আছে”।

হৃদি ধরা গলায় বলল, “দরকার নেই। থাক”। ৩ হৃদি জেগে উঠল মায়ের ফোনের শব্দে। দ্রিম দ্রিম শব্দের অদ্ভুত রিংটোন বেজে চলেছে মোবাইলটা। হৃদি বিছানা হাতড়ে মোবাইলটা কানে লাগিয়ে বলল, “হ্যালো মা”।

মা ওপাশ থেকে বললেন, “তুই রেডি হইছিস?” “ক্যান মা, রেডি হওয়া লাগবে ক্যান?” “ও মা, বলে কি মেয়ে! আজকে না তোর ঢাকায় আসার কথা!” সাথে সাথে সব মনে পড়ে গেল হৃদির। সে হৃদি। বিবিএ থার্ড ইয়ার, সিলেটে পড়ালেখা করে। তার ফ্যামিলি থাকে ঢাকায়। মাত্র তিন দিন পরেই তার বড় বোনের গায়ে হলুদ।

বড় বোনের গায়ে হলুদে একমাত্র ছোট বোনের অনেক কাজ। ট্রেনের টিকিট আগেই কাটা ছিল। ব্যাগটাও আগেই গুছানো ছিল। হৃদি সব গুছিয়ে গাছিয়ে তালা মেরে বেরুতে গিয়েই তার মনে হল, কোথায় কিছু একটা ঘাপলা আছে। আজ ট্রেন জার্নিটা কেমন অশুভ মনে হচ্ছে।

মনে হচ্ছে আজ ট্রেন জার্নিতে একটা ভয়াবহ এক্সিডেন্ট হবে। সে মারা যাবে এক্সিডেন্টে। এইসব। আশ্চর্য ব্যাপার, হৃদি অনেক চেষ্টা করেও বাজে চিন্তাটা তার মাথা থেকে সরিয়ে ফেলতে পারল না। বরং যতই সরিয়ে ফেলতে চাইল ততই চিন্তাটা তার মাথায় জেঁকে বসতে থাকল যেন।

তার মাথার মধ্যে কে যেন বারবার বলতে লাগল, “এই জার্নিতে তুমি মারা যাবে। এই জার্নিতে তুমি মারা যাবে। তুমি এই ট্রেনে উঠলেই তুমি মারা যাবে”। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হৃদি তার ব্যাগ নিয়ে আবার হলের দিকে যাত্রা শুরু করল। সে জানে এই ট্রেন এক্সিডেন্ট করবে।

সে জানে সে মারা যাবে। এই ট্রেনে ওঠার কোন মানেই হয় না। ৪ প্রফেসর মিরাজ হেডফোনে “ঝাকানাকা ঝাকানাকা ঝাকানাকা দেহ দোলা না” শীর্ষক গান শুনছেন। বাংলাদেশে আসার পর এই দেশের গান শুনে ভালো লেগে গেছে তার। এইজন্যে নেট ঘেঁটে ঘেঁটে ভালো ভালো গান খুঁজে বের করে শুনছেন তিনি।

তবে সমস্যা করছে নেট। গ্রামীনফোনের আনলিমিটেড সার্ভিস নিয়ে তিনি একটা গান ডাউনলোড হবার জন্য আনলিমিটেড টাইম ধরে অপেক্ষা করছেন। গ্রামীনফোনকে তার কুত্তার বাচ্চা বলে গালি দিতে ইচ্ছা করছে। হঠাৎ তার প্রিয় সহকারী ইউহান এসে বলল, “স্যার, একটা কথা ছিল”। মিরাজ মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে তন্ময় হয়ে গান শুনছিলেন।

জেমসের গানের সাথে তাল মিলিয়ে দুলছিল তার হাতের আঙ্গুল এবং ভুঁড়ি। ইউহান আবার বলল, “স্যার, খুব ইম্পরট্যান্ট কথা”। মিরাজ হেডফোন নামিয়ে বললেন, “কি কথা?” “প্রজেক্ট ওয়ানের মেয়েটা আজ মারা গেছে”। “সে কি? কিভাবে?” “রুমের স্টোভ বার্স্ট করেছিল। মেয়েটা ট্রেনে না উঠে হলে ফিরে এসে রান্না করতে চেয়েছিল।

তখনই ঘটেছে ঘটনা। মেয়ের শরীরে আশি পার্সেন্ট বার্ন ছিল। ওকে রুমে ঢুকে মৃত আবিষ্কার করা হয়েছে”। “কি যেন নাম ছিল মেয়েটার?” “হৃদি। ফারিয়া রহমান হৃদি”।

মিরাজ হতাশায় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তারপর বললেন, “প্রকৃতি মনে হয় আসলেই ভয়াবহ প্রতিশোধ নিল”। “জি স্যার। তার প্রথমবার মরার কথা ছিল হার্ট অ্যাটাকে। আমরা টাইম মেশিনে দেখে তাকে জানানোর পর সে ঐ দুর্ঘটনা যেখানে হবার কথা ছিল সেখানে গেল না।

দ্বিতীয়বার তার মরার কথা ছিল ভার্সিটিতে যাবার পথে একটা রোড এক্সিডেন্টে। সাথে সাথে। প্রথমবার মৃত্যু হবার সময়টার মাত্র বারো ঘণ্টা পরেই ছিল এই রোড এক্সিডেন্ট হবার কথা। এবারও আমরা তাকে জানিয়ে দিলাম। সে ভার্সিটিতে গেল না।

তৃতীয়বার তার মরার কথা ছিল ট্রেন এক্সিডেন্টে। ধুঁকে ধুঁকে এক্সিডেন্টের এক ঘণ্টা পরে মরার কথা ছিল তার। দ্বিতীয়বার মৃত্যুর মাত্র পাঁচ ঘণ্টা পর হবার কথা ছিল এই এক্সিডেন্ট। এবারও আমরা তাকে জানিয়ে দিলাম। সে ট্রেনে উঠল না।

চতুর্থবার যখন আসলেই সে মৃত্যুবরণ করল সেই সময়টা ছিল তৃতীয়বার মৃত্যুর চেয়ে মাত্র এক ঘণ্টা পর। এবার আর আমরা তাকে বাঁচাতে পারলাম না”। প্রফেসর মিরাজ যেন খুব অবাক হয়েছেন এমন ভঙ্গি করে ইউহানের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “দেখ, প্রত্যেকবারের দুইটা সম্ভাব্য মৃত্যুর ইন্টারভাল কিন্তু একটু একটু করে কমে আসছিল। আবার, প্রত্যেকবার সম্ভাবনার সাথে মৃত্যুর উপায় কিন্তু আরও ভয়াবহ হয়ে যাচ্ছিল।

হার্ট অ্যাটাক>রোড এক্সিডেন্ট (সাথে সাথে)>ট্রেন এক্সিডেন্ট (ধুঁকে ধুঁকে)>বার্ন। এটা কিন্তু খুব চিন্তার কথা। প্রকৃতি কিন্তু আসলেই ওর মৃত্যু কার্যকর করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল”। ইউহান বলল, “এখন কি করব, স্যার? টাইম মেশিন ফেলে দেব? উপরমহলে জানাজানি হয়ে গেছে। আজকালকের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট আমাদের কাছ থেকে এটার ব্যাপারে রিপোর্ট চাইবেন”।

মিরাজ বললেন, “জানি না। তবে টাইম মেশিন রেখে দিলে প্রকৃতি হয়তো আমাদের উপরই ভয়াবহ প্রতিশোধ নেবে। ভয়াবহ প্রতিশোধ”। ইউহান বলল, “এখন কি করব স্যার?” মিরাজ বললেন, “একটাই উপায় আছে। টাইম মেশিন চালু কর।

দেখি আমাদের ভাগ্যে কি আছে”। পরিশিষ্টঃ -বালেহ তিয়াস, প্রফেসর মিরাজ কি আসলেই মারা গেছেন? -হ্যাঁ। -উনি কি নিজের পরিণতি টাইম মেশিনে দেখেও কোন ব্যবস্থা নেন নি? -না। -আপনি কি উনাকে নিয়ে আর লিখবেন না? -কেন লিখব না? উনার জীবনে ঘটনার কি শেষ আছে? সময় পেলেই লিখব। -আচ্ছা আপনার কি মনে হয়? আপনার এই বিশাল সায়েন্স ফিকশন আদৌ কেউ পড়বে? নাকি না পড়েই লাইক দেবে? -কি! এত্ত বড় সাহস! না পড়ে লাইক দেবে? না পড়ে লাইক দিলে প্রফেসর মিরাজের আবিষ্কৃত ইচ-গান দিয়ে এমন ফায়ার করব না, সারাদিন চুলকাইয়াও শান্তি পাইব না হালা লাইকার! -ইচ-গান? ইচ-গান কি? এইটা দিয়ে কি হয়? প্লিজ প্লিজ বলেন না ভাইয়া! -থাক, সেই গল্প আরেকদিন বলব।

যেদিন আবার রাফি আদনান শুভ রুমে এসে প্রফেসর মিরাজের গল্প শুনতে চাইবে, সেদিন বলব। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।