আগেও একটা পোস্ট লিখেছিলাম তেলাপোকা নিয়ে। এই জঘন্য প্রাণীটা নিয়ে আরেকটা ব্লগ লিখছি নিজের কাছেই বিশ্বাস হচ্ছে না। ত্রিনিত্রির বিড়াল-ভীতি নিয়ে লেখা পোস্ট পড়েই মনে হয় এমন কুবুদ্ধি মাথায় ঢুকেছে।
তেলাপোকা নিয়ে নাচানাচির ইতিহাস আমাদের অনেক পুরনো। তেলাপোকাগুলোও ভারী পাজী।
আমাকেই কেন যেন বেশি জ্বালাতন করে।
একবার মশারীর ভেতর তেলাপোকা ঢুকে গিয়েছিল। আমরা তিন বোন তখন একসাথে ঘুমাতাম। তেলাপোকা দেখেই আমি আর আমার ছোট বোন এক লাফে মেজপার উপর চড়ে বসে শুরু করে দিলাম চিল্লাচিল্লি, "মেজপা মেজপা, তেলাপোকা, মারো মারো। " মেজপা বুঝতে পারছিল না আমাদের দুইটার নীচে ভর্তা হয়ে কিভাবে তেলাপোকা মারা সম্ভব?
একদিন সবাই মিলে টিভি দেখছি।
আমাদের যা স্বভাব, টিভির সামনে ভাতের প্লেট নিয়ে বসি। তখন বড়পা ভাত খাচ্ছিল। হঠাৎ ওর ওড়নায় একটা ছোট্ট তেলাপোকা দেখে আমি "তেলাপোকাআআআআআআআআ" বলে চিৎকার করে উঠলাম। বড়পা এক সেকেন্ডও দেরী না করে একটা লাফ দিয়ে দৌড় দিল। আমি কিন্তু বলতে পারিনি তেলাপোকাটা কোথায়।
পরে বললাম, বড়পা তেলাপোকা তোমার ওড়নায়, তুমি ওটা নিয়েই দৌড় দিয়েছ। তখন কি ঘটল আর না-ই বললাম। তবে একটু পর সবাই স্থির হলে দেখলাম মেঝে ভরে ভাত আর আলু ছড়িয়ে আছে। বড়পা হাতে ভাতের প্লেট নিয়েই লাফটা দিয়েছিল কি না।
আমাদের বাসায় এক বুড়ি ভিক্ষুক আসত।
আম্মা তাকে ভিক্ষা না দিয়ে কিছু কাজ করিয়ে নিতেন। এরপর বেশ কিছু টাকা দিয়ে দিতেন, আর এক বেলা খাইয়েও দিতেন। একবার তাকে কাজ করতে দিয়ে আম্মা তার জন্য ভাত-তরকারী প্লেটে নিয়ে ঘরের এক কোণায় রেখেছেন। একটু পর দেখা গেল সেখানে ৫-৬ টা তেলাপোকা আরামে উদর পূর্তি করছে। আম্মা আমাকে বললেন, প্লেটটা সরিয়ে আনত ওখান থেকে।
আমি একটু প্রতিবাদ করতে গেলাম, কিন্তু আম্মার ঝাড়ি খেয়ে সাহস করে গেলাম। আস্তে করে প্লেট মাত্র উঠিয়েছি আর তখুনি একটা তেলাপোকা আমার হাত বেয়ে উঠে আসা শুরু করল। আর কি, দিলাম চিৎকার, আর লাফ দিয়ে প্লেট ছুড়ে ফেললাম। সারা ঘরে ভাত-তরকারী ছড়িয়ে পড়ল। এরপর খেলাম আম্মার হাতের পিটুনি।
একবার টিভি দেখছিলাম সবাই মিলে। হঠাৎ এক বিশিষ্ট অভদ্র তেলাপোকা শুরু করল ফড়ফড় করে উড়াউড়ি । মোটামুটি একটা কুরুক্ষেত্র বেঁধে গেল। বড়পা আর ছোট বোন দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিয়েছে ততক্ষণে। আমি দৌড় না দিয়ে ভাবলাম চুপচাপ মাথা গুঁজে বসে থাকি।
দুই হাতে মাথা লুকিয়ে নিচু হয়ে বসে আছি, হতচ্ছাড়া তেলাপোকাটা আমাকেই বেছে নিল তার শিকার হিসাবে। উড়ে এসে বসল আমার মাথায়। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে করতে দুই হাতে মাথা ঝাড়ছি তো ঝাড়ছি। তেলাপোকা কখন সরে গিয়েছে, আমার ঝাড়া আর শেষ হয় না, আর চিৎকার থামার তো প্রশ্নই নেই। পরে আম্মা তেলাপোকাটা মেরে আমাকে শান্ত করলেন।
মেজপাও সেদিন গলা ফাটিয়েছিল, তবে সে ভয়ের চিৎকার না, আমার নাচন দেখে হাসতে হাসতেই তার গলা ফাটে ফাটে অবস্থা।
হোস্টেলে সব সময় চক দিয়ে ঘরের চারদিকে, বিছানার চারপাশে দাগ দিয়ে রাখতাম। তেলাপোকা মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে থাকত। তবে মাঝে-মধ্যে যন্ত্রণা যে দিত না তা না। আমার রুমমেট আবার তেলাপোকার প্রতি খুবই দয়াবতী মায়াবতী ছিল।
আমি তেলাপোকা দেখে নাচানাচি শুরু করলে সে আলতো করে সেটাকে রুম থেকে বের করে দিত। কোনদিন তাকে দিয়ে তেলাপোকা মারতে পারলাম না।
একবার হোস্টেলের রুমে এক বান্ধবী এসেছে পড়তে। সে টেবিল-চেয়ারে বসেছে, আর আমি যথারীতি বিছানায় বই-খাতা ছড়িয়ে বসে আছি। একটা তেলাপোকাকে দেখছিলাম মেঝেতে চারদিকের দেয়াল ঘেঁষে ভ্রমণ করছে।
পাত্তা না দেয়ারই চেষ্টা করলাম, পড়ায় মন দিই তার চেয়ে। কিন্তু তেলাপোকা তো আমাকে ছাড়বে না এত সহজে। হঠাৎ করে আমার বিছানা বেয়ে উঠে আমার হাতে উঠে আসল। আবার সেই চিৎকার, লম্ফ আর হাত ঝাড়াঝাড়ি। তেলাপোকাটা পালাল।
আমার চিৎকার শুনে বান্ধবীও চমকে উঠল, কী হয়েছে? বললাম, তেলাপোকা হাতে উঠে এসেছিল। একটু লজ্জা পেলাম। কী মনে করল সে, একটা সামান্য তেলাপোকার ভয়ে আমি এমন জড়োসড়ো।
একটু পর দেখি তেলাপোকাটা বান্ধবীর পায়ের কাছ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। সেটা ওকে বলতেই দেখলাম সে আমার চেয়েও জোরে চিৎকার করে আমার চেয়েও বড় একটা লাফ দিল।
দিলে একটু শান্তি পেলাম। তেলাপোকাটা মারার একটা উদ্যোগ নিয়ে সফলও হলাম। বান্ধবী তখনও হাঁপাচ্ছে। বলল, ও মাগো, আমি তেলাপোকা ভীষণ ভয় পাই।
অনেকদিন পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল, মনে হয় মেয়েরাই এমন ভয় পায় তেলাপোকা দেখে।
কিন্তু এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হল। তখন মেডিসিন ওয়ার্ডে ইন্টার্নশিপ করি। হাসপাতালে মাঝে মাঝে পোকা নিধন-যজ্ঞ চালানো হয়। সব বেডের ম্যাট্রেস উঠিয়ে পোকার ওষুধ স্প্রে করা হয়। তো একদিন সকালে এমন যজ্ঞ চলছে, আমরা যথাসম্ভব দূরে দূরে আছি।
কিন্তু কতক্ষণ আর থাকা যায়। রোগীদের কাছে তো যেতে হবে। আমি আর এক সিনিয়র ভাইয়া গেলাম এক রোগীর বেডের কাছে।
ভাইয়া আমাকে বলে দিচ্ছিলেন কী কী করতে হবে এই রোগীর। হঠাৎ দেখি ঝাঁকে ঝাঁকে তেলাপোকার বাচ্চা ম্যাট্রেস থেকে বের হয়ে আসছে আর ভাইয়ার দুই পা বেয়ে উঠে যাচ্ছে।
চিৎকার করে ভাইয়াকে জানাতেই শুরু হল ভাইয়ার নাচন। দুই পা জোরে জোরে মেঝেতে ঠুকতে ঠুকতে লাফাচ্ছেন আর চিৎকার করে বলছেন, এই এই তেলাপোকা সরাও আমার পিঠ থেকে, জলদি সরাও। আমি নিজে তেলাপোকার ভয়ে পালাই, আমি কী সরাব? তবু সাহস করে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে রোগীর ফাইল দিয়ে তেলাপোকা ঝেড়ে দিলাম। ভাইয়া হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আমি তেলাপোকা কি যে ভয় পাই জানো না তো, আমার বোনটা আমাকে এই তেলাপোকা নিয়ে কত যে যন্ত্রণা দেয়, তেলাপোকা ধরে ধরে আমার গায়ে ছেড়ে দেয়।
কিছুদিন আগে দুই মাসের জন্য ঘর-ছাড়া হয়েছিলাম।
দুই মাস পর ঘরে ঢুকে দেখি তেলাপোকারা মহাসুখে রাজত্ব করছে আমার ঘরে। ফিনিস পাউডার দিয়ে তাদের সবগুলোকে পরপারে পাঠাতে বাধ্য হলাম। কিন্তু তারা তাদের চিহ্ন আমার কাপড়ে, বিছানায়, সারা ঘরের কোণায় কোণায় রেখে গেছে। বড়ই যন্ত্রণা! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।