কোন প্রেম কোন স্বপ্ন কোনদিন মৃত হয় না আজ খুব সকালেই ঘুম ভেঙে গেলো,
বলতে গেলে সকাল হওয়ার আগেই চোখ
মেললাম।
বহুদিন পরআজ ভোর দেখলাম। বাড়ির সামনের
লনে হাঁটছি , একা।
সঙ্গী বলতে হাতের কফি মগ আর তার নিঃসঙ্গ
ধোঁয়া।
আমি যখন একা থাকি তখন কেন জানি অনেক
কথা বলতে ইচ্ছে করে।
নিজের সাথেই চলেকথোপকথন।
আজ তা শুরু হওয়ার আগেই ঘরের ভেতর
থেকে কান্নার শব্দ পেয়ে চিন্তায় ছেদ
পড়লো
।
ঘরে গিয়ে দেখতে পেলাম, আমার
মেয়েটি কাঁদছে।
আমি কাছে যেতেই
আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,"আব্বু
ভয় পেয়েছি..."।
আমি উপমাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
“শুয়ে পরো মা, কিছু হবে না।
আমিতো আছি।
” কিছুক্ষনের মধ্যেই শুয়ে পড়লো লক্ষ্মী মেয়ের
মতোই।
উপমা, ওর মায়ের মতোই লক্ষ্মী হয়েছে।
মায়ের
নামে নাম তার।
জন্মের সময়ই আমার
লক্ষ্মী মামনিকে মা হারা হতে হয়েছে।
এর জন্য ওর যতোটা না কষ্ট, তার চেয়ে হাজার
গুণ বেশি কষ্ট হয় আমার।
এসব ভাবতে ভাবতেই ভিজে উঠলো চোখের
কোণটা।
চমৎকার সুখের
দিনগলো কিভাবে যেনো কেটে যায়
এক পলকেই।
সব কিছু ছিল ছবির মতো সাজানো,
মাঝে মাঝে নিজেরও বিশ্বাস হতো না।
চিৎকার
করে বলতে ইচ্ছেকরতো,
“আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ”।
কিভাবে যেনো কি হয়ে গেলো, এক মুহূর্তেই
সব
শেষহয়ে গেলো আমার।
উপমার মায়ের সাথে আমার পরিচয়পর্ব খুব
অদ্ভুতভাবে হয়েছিল।
আমি হাসপাতালের ডিউটি শেষ
করেবাসায়
ফেরার জন্য তৈরি হচ্ছি, এমন সময়
দেখি একটি মেয়ে আমার রুমে ধুকে হু হু
করে কাঁদছে
।
আমি মোটামুটি অপ্রুস্তুত হয়ে পড়ি, যদিও
পেসেন্ট
এবং তাদের আত্মীয় স্বজনদের কান্না আমার
কাছে খুবসাধারন একটি ব্যাপার
হয়ে দাঁড়িয়েছিল
। তবু বারবার আমার মনে হচ্ছিল ,এতো চমৎকার
একটি মেয়েকেন কাঁদবে?
আমি তাকে বসিয়ে মোটামুটি শান্ত করার
পর
জানতে পারলাম, তার বাবার ম্যাসিভ হার্ট
এটাক হয়েছে
।
ওর সাথে আর কেউ নেই,
কি করবে বুঝতে পারছে না।
ডিউটি ডাক্তাররা কি বলছে ও
বুঝতে পারছেনা।
আমি গিয়ে দাঁড়ালাম তার বাবার বেডের
পাশে।
ডাক্তাররা চেষ্টার কম করলেন না, কিন্ত সময়
ও ভাগ্যের কাছে হার মানতে হল আমাদের
সবাইকে
। চলে গেলেন মেয়েটিকে একা ফেলে,
চলে গেলেন
তার প্রিয় পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে
।
সেই
রাতটি যে কিভাবে কেটেছে তা আজও
বুঝতে পারিনা।
উনার ডেথ সর্টিফিকেট জোগাড় করা,
লাশবাসায় পৌঁছে দেয়া, পরিবারের
সবাইকে খবর
দেয়া থেকে শুরু করে দাফন পর্যন্ত
পুরোটা সময়পরিবারটির সাথে ছিলাম
।
তারপর ব্যস্ততায় আর নাগরিক কোলাহলে বেশ
কিছুদিন কেটে যায়। একসময় প্রায় ভুলেই
গিয়েছিলাম
মেয়েটিকে। হটাৎ করে একদিন দুপুরে আমার
মোবাইলটি বেজে ওঠে তার স্বরে।
রিসিভ করতেই উপমারগলা শুনতে পেলাম।
ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করার পর বলল,
আমি কি একটু
তার সাথে দেখা করতে পারবোকিনা?
সেদিন
ভীষণ ব্যস্ত থাকায় দু’দিন পর সময় নিলাম
।
নির্ধারিত দিনে নির্ধারিত সময়ের আগেই
উপস্থিত
সে। আমি যথারীতি লেটলতিফ।
বেশ কিছুক্ষণ কথাহল।
ফেরার সময় বলল,
আপনি কি আমকে বিয়ে করে নিয়ে যেতে প
জীবনে প্রথম বারের মতো ভীষণ শক খেলাম
। এমন মুহূর্তে কি বলা যায় আর কি বলা উচিৎ
বুঝতে পারছিলাম না।
নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বললাম,
“ ঘটনা কি?” জবাবে জানালো, ওর ভীষণ
সমস্যা হচ্ছে একা থাকতে।
আমাদের নিকৃষ্ট সমাজের কদর্য
থাবা বাবা মা হারা একটি মেয়ের
দিকে বারবার তেড়ে আসছে
। কি করবে বুঝতেপারছে না।
নিজের বাসা ছেড়ে আত্মীয় স্বজনের
বাসায়ও
উঠতে চাচ্ছে না।
ইচ্ছে আছে পড়াশুনা শেষ করে নিজে কিছু
একটা করার।
চুপচাপ কথাগুলো শুনলাম, তারপর জিজ্ঞেস
করলাম,
“আমাকে তো আপনি ভালোভাবে জানেন
না
। অল্প কিছু মুহূর্ত ছিলাম আপনাদের সাথে।
এটা কি এক ধরনের রিস্ক হয়ে যাচ্ছে না?”
জবাবে সে জানালো,
“একজন মানুষকে চিনতে এক মুহূর্তই যথেষ্ট আর
আপনি তো আমার বিপদের সময়
পুরোটা জুড়ে ছিলেন
।
আর এর জন্য যদি আমার ভীষণ মাশুলও
দিতে হয়আমার কোন আফসোস থাকবে না”।
ভীষণ বিস্মিত হলাম তার কথাগুলো শুনে আর
অবাক হলাম ভাবনাশক্তির স্বচ্ছতা দেখে।
তারপর থেকে চলতে থাকল কথোপকথন।
কাছাকাছি চলে আসলাম দুজন মনের দিক
দিয়ে,
ভাবনার দিক দিয়ে।
একদিন সাহস করে আম্মাকে ওর কথা বললাম।
এরপর খুব সহজভাবেইযেনো সব সম্পন্ন
হয়ে গেলো।
বেশ ভালোই কাটছিল আমাদের সংসার।
কিন্তু কনসিভ করার পর হটাৎ সে খুব চুপচাপ হয়
গেলো।
ওর স্বভাবসুলভ চপলতা কোথায়
যেনো হারিয়ে গেলো।
আমার আপ্রান চেষ্টা থাকতোসবসময়
ওকে আনন্দে আর হাসিখুশি রাখার।
আমাদের বাবুটার জন্য ওর চিন্তার শেষ ছিল
না। এটা করবে, ওটা করবে আরও কত কি।
খুব ভালো লাগতো ওর
তৃপ্তিমাখা হাসি দেখে।
আমাদের বাবু যেদিন আমাদের
কাছে আসবে তার
আগের দিন আমাকে কাছে ডেকে বলল, ওর
ভীষণ
ভয় করছে
। আমি বললাম, “ভয়ের কিছু নেই ।
এই সময় সব
মায়েরই এমন ভয়ভয় লাগে।
আর আমিতো আছিই”।
সেপ্টেম্বরের ২১ তারিখে আমি কোন কাজ
রাখিনি।
আগে থেকেই সব প্রস্তুত ছিল।
আমারই এক সহপাঠীর তত্ত্বাবধায়নে ও আছে।
খুব মনে পড়ছে, ট্রলিতে করে ওকে যখন
নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ডেলিভারি রুমে তখন ও
কি মনে করে যেনো খুব মিষ্টি করে আমার
দিকে তাকিয়ে হাসলো
। আমার ভিতরতা ভীষণভাবে চমকে উঠলো।
কিছুক্ষণ পরই আমার
সহপাঠী জেসি বেরিয়ে আসলো,
ওটি থেকে ,
বলছে অবস্থা খুব একটা সুবিধার
না সিজারিয়ানে ট্রাই করতে হচ্ছে
। আমি যেনো কিছুই শুনতে পাচ্ছিলাম না।
আমার
চোখে বারবার ওর মুখটা ভেসেউঠছিল।
পুরো পৃথিবীটা আমার ওটি রুমের
সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়েছিল।
নার্সদের দৌড়াদৌড়ি, রক্তের
প্রয়োজনে হাঁকডাক
সবই ভীষণ নিষ্প্রাণ মনে হচ্ছিল আমার কাছে
। এক কোনায় আম্মু বসে আছে, সাথে আরও
আত্মীয় স্বজন।
সবার দৃষ্টি আমার দিকে, আর আমার চোখ
ওটির
দরজায়।
এক সময় দরজা ঠেলে জেসি বেরিয়ে আসলো।
এসেই
আমাকে ধরে কাঁদতে থাকলো।
ওর কোলে আমার মামনি।
সারা পৃথিবীটা যেনো সমস্ত ভর সমেত আমার
মাথায়।
কোথায় যেনো বুকের ভেতর খুব সুক্ষ
একটা যন্ত্রণা হতে থাকলো।
আম্মা এগিয়ে আসলো, বাবুকে কোলে নিল।
জেসি আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে আর
বলছে, দোস্ত
পারলাম নারে, আমরা পারলাম না।
আমাকে মাফ করে দে।
আমি কিছুই বললাম না, নাকি বলতে পারলাম
না, আসলে কিছুই খেয়াল নেই।
আম্মা আমার কোলে আমার
মামনিকে তুলে দিলেন।
আমি অবাক হয়ে তাকে দেখছি।
মা আর
মেয়ের
মাঝে এতো বেশি মিল আসল অবিশ্বাস্য।
আল্লাহ্
যেনো একজনকে নিয়ে গিয়ে আমাকে আরেক
দিয়ে গেলেন। আমার মুখ দিয়ে অজান্তেই
বেরিয়ে আসলো অতি প্রিয় সেই নাম,
“উপমা”।
এসব ভাবতে ভাবতে আমি আবার
এসে দাঁড়ালাম লনে। এই জায়গাটি আমার
ভীষণ প্রিয়।
কত রাত যে আমরা এখানে গল্প
করে কাটিয়েছি তার কোন ইয়ত্তা নেই।
“আব্বু”, ডাক শুনেপেছন
ফিরে তাকিয়ে দেখি আমার
মামনি স্কুলের ড্রেস পড়ে রেডি।
মায়ের মতোই ভীষণ লক্ষ্মী আমার মেয়েটা।
ওকে নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ কোনদিনই
দিতে দিলো না। কিভাবে যেনোসব
বুঝে ফেলে।
কাছে এগিয়ে এসে আমার হাতটি ধরে বলল,
“ আমি রেডি হয়ে গিয়েছি সেই কখন,
তুমি কি করছিলে এখানে? আব্বু, আম্মুর
কথা ভাবছিলে বুঝি?
আচ্ছা আব্বু ,আম্মুকি আমার চেয়েও সুন্দর ছিল?”
আমার মেয়ের কথা শুনে হেসে দিলাম
। “না আম্মু, তুমি সবচেয়ে সুন্দর।
তোমার আম্মুও সুন্দর ছিল কিন্তু আমার মামনির
মতো এত সুন্দর না”।
শুনে মিষ্টি করে একটি হাসি দিলো উপমা।
আমি বললাম,
“আম্মু তুমি যাও, আমি রেডি হয়ে আসছি”।
আজকের আকাশটা কেন জানি অন্য দিনের
তুলনায় অনেক সুন্দর লাগছে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে আমার
উপমাকে খুঁজলাম।
“আমি জানি তুমি আমাদের দেখছ...
ঘাসে ভেজা এশিশিরে আছো কি তুমি জড়ি
আবারও এসে দাও না ভরিয়ে...”
লেখকঃ রাশেদ আবদুল্লাহ অনু
ফেসবুক আইডিঃ http://facebook.com/rashed.anu ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।