শুচি সৈয়দ
শুচি সৈয়দ
আমাদের সম্পর্কগুলি নানা সূত্রে বাধা। আমরা চাই কিংবা না চাই। সম্পর্কের এ উর্ণাজাল থেকে নিজেদের ছাড়িয়ে নেয়া একেবারেই অসম্ভব। সৃষ্টির বৈচিত্র্যও বোধকরি এ সম্পর্কের ভেতরই। অনেক দিন আগে এদেশেরই একজন কবি আমাকে আমার একটি টুটাফাটা অটোগ্রাফ বুকে লিখেছিলেন-- ‘কবিরা একই মায়ের সন্তান, সেই হিসেবে তুমিও আমার ভাই’Ñ আমি সে সময় রাজনীতির আদর্শে নিমজ্জিত তুখোড় এক তরুণ।
আদর্শিক সম্পর্কের উষ্ণতা, হƒদ্যতায় প্লাবিত। কথা ক’টিকে তখন অতি আবেগী মনে হলেও আজ মনে হয় এটি একটি অসাধরণ সত্য উচ্চারণ, সত্য অনুভব-- কবি গাজী লতিফের সম্পর্কে লিখতে গিয়ে আমি সেই সত্য উপলব্ধিটির শরণ নিচ্ছি। কবি গাজী লতিফের সঙ্গে আমার উর্ণাজালিক সম্পর্কটি কি? কবি হিসেবে তিনি আমার ভাই তো বটেইÑ তাছাড়াও তার একটি স্বতন্ত্র অবস্থান আছে এ সম্পর্কের ভেতর। একেকজন মানুষ একেকভাবে প্রিয় হয়ে ওঠে একেকজনের কাছে। গাজী লতিফ আমার কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছেন তাঁর কাজ দিয়ে, কাজের কারণে এবং কবিতাসূত্রে তো বটেই।
আমরা যারা ঢাকায় অবস্থান করি তাদের অনেকেই খুব অনায়াসে দেশের যে কোনও জেলাকে ‘মফস্বল’ বলতে অভ্যস্ত হয়ে উঠি। যেন সে শহরগুলো ঢাকার তুলনায় উন। আকারে আকৃতি এবং বাস্তবতায় ঢাকা নিশ্চয়ই অজগর শহর। তার তুলনায় আমাদের নাড়িপোঁতা ছেড়ে আসা শহর ‘অজপাড়া গাঁও’ বটে। তা সত্ত্বেও আমি আমার ফেলে আসা শহরকে উন মানতে নারাজ।
ঢাকার যে কোনও কিছুর চাইতে আমি ঢাকার বাইরের কাজকে বড় মনে করি কেননা আমি জানি ঢাকার কোনও বড় কাজের সঙ্গে ঢাকার বাইরের একটি ছোট্ট কাজের মধ্যেও কি আকাশচুম্বী ব্যবধান। ঢাকায় যা সাধিত হয় তা সবই অর্থের সাধনে-- ঢাকার বাইরে যা সাধিত হয় তা ভালবাসা, পরিশ্রম আর সীমাহীন আÍত্যাগে।
কবি গাজী লতিফ একটি ছোট কাগজ প্রকাশ করেন জেলা শহর গোপালগঞ্জ থেকে ‘দূর্বা’ এ নামে। এরকম নিখাঁদ ভালবাসাপূর্ণ কাজ যে মানুষটি করেন তাকে ভালবাসবো না তো কাকে ভালোবাসবো? আজ তাঁকে নিয়ে লেখায় সেই শ্রদ্ধাপূর্ণ ভালবাসাটির কথা তাকে জানিয়ে রাখি। ‘দূর্বা’-র একটি সংখ্যায় দেখলাম কবি আসাদ মান্নানের পঞ্চাশ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে তাকে নিয়ে ক্রোড়পত্র প্রকাশ হয়েছে।
কবি আসাদ মান্নান আমার আরেক প্রিয় ও ভালোবাসার মানুষ। তাঁর ওপর ‘দূর্বা’-র ক্রোড়পত্র প্রকাশের ঘটনাটি কবি গাজী লতিফকে আমার আরো প্রিয় করে তোলে। আমার আরেক প্রিয় সহকর্মী সারফুদ্দিন আহমেদ। কবি, অনুবাদক ও গদ্যকার। সারফুদ্দিনের কাছ থেকে শুনি গাজী লতিফ তাদের শহরের সেই হ্যামিলনের বংশীবাদক যে কিনা শহরের ইঁদুরগুলোকে তো দূরে নিয়ে যায়ইনি বরং সেগুলোকে বাঁশি বাজানো শিখিয়ে দিয়েছে।
সব জেলা শহরেই গাজী লতিফের মত এ রকম নিবেদিতপ্রাণ সাংস্কৃতিক সংগঠক থাকেন। তাঁরা নিজেদের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান। সমস্ত অসুন্দরের বিরুদ্ধে লড়েন। অসুন্দরকে সুন্দরে পরিণত করেন। অসুরকে সুরস্পন্দনে স্পন্দিত-প্রাণিত করেন।
যেমন আমাদের পাবনাতে আছেন অধ্যক্ষ শিবজিত নাগ, কবি শ. ই শিবলী। øেহভাজন কবি এহসানুল ইয়াসিন বলে ওদের ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়াতে আছে জয়দুল হোসেন- তার কথা। জনপদের এই সব আলোকবর্তিকাদের কাজের মূল্য আমরা খুব কমই দিতে পারি। এত গেল ব্যক্তি গাজী লতিফের কথা। কবি হিসেবে যে গাজী লতিফ আমার সহোদর তার কি অবস্থা!
কবিতা মূলত জীবনের হলাহল পান করে অমৃত আস্বাদনের নাম-- পাঠক যদি কবিতা থেকে সেটা না পান তবে তা না হবে কবিতা না হবে লেখা।
ক্ষণকালের মুহূর্তকে চিরকালের করে তোলাই কবির কাজ। বলা হয় কবিরা অমৃতের সন্তান। কবি গাজী লতিফ তাদেরই একজন। তার পালক কবিতাটি পড়লে যে কোনও পাঠক চিরকালের আয়নাতে চমকে উঠতে দেখবেন নিজেরই মুখচ্ছবিকে। আমি পুরো কবিতাটির উদ্ধৃতি দিচ্ছি--
‘চশমার কাঁচ ভারী হয়েছিলো
যারে চেয়ে চেয়ে সে যখন এলো
তোমার চাতালে যখন দাঁড়ালো
তখনই তাড়ালে কেন!
যেন বাজে নাই বিরহ সানাই
দুখে কাঁদো নাই সুর সাধো নাই
স্মৃতি রাখো নাই ছবি আঁকো নাই
তারে ডাকো নাই যেন।
সে-ই রেখে গেছে পালকের ঋণ
যারে তাড়িয়েছো ভালোবাসাহীন
পাখিদের দিন মুক্ত-স্বাধীন
তুমি কি নিজেরে চেন।
(পালক। বিমূর্ত বোধের দ্রাঘিমা। পৃ. ৩১)
নিজেকে চেনা না-চেনার এই চিরকালীন জিজ্ঞাসাকে সমকালীন ভাষ্যে নিজস্ব মুন্সীয়ানায় নির্মাণ করেন কবি গাজী লতিফ। খুচরো কবিতা নামে শিরনামবদ্ধ যে পঙক্তিমালা তা মোটেও খুচরো নয় পাঠকের কাছে।
তা বরং চকমকি পাথরের মত মহার্ঘ। পাঠকের সামনে তুলে ধরছি সেই মহার্ঘ বোধ--
‘উদরে আগুন
নষ্টরাতের উনুনের উত্তাপ
পুড়েই ভস্ম প্রগাঢ় মনস্তাপ
পোড়ে সন্তাপ মেধার মাধবী নুন।
এবং আরও পঙক্তি--
জীবন্ত নারী চিদাগুনে পরিণীতা
উড়ছে এসিড পুড়ছে নারীর ঘর
ভাসছে বাতাসে আর্ত কণ্ঠস্বর
জ্বলছে সেফালী শিউলী ও পারমিতা
অদূরে কোথাও জ্বলছে কুলের চিতা...
(খুচরো কবিতা। বিমূর্ত বোধের দ্রাঘিমা। পৃ. ২৯)
পাঠকের কাছে কবি গাজী লতিফের কবিতার মূল্যায়ন কল্পে আমি আমি আমার আমার দুই সহকর্মীকে কবির বই থেকে তাদের পছন্দের কবিতা নির্বাচন করতে বলায় আশীফ এন্তাজ রবি যে কবিতাটি নির্বাচন করে সেটি উদ্ধৃত করি--
‘................................................
পাখির প্রস্থান পথে প্রজšে§র গান থাকে
আশা থাকে ভালোবাসা থাকে
পাখি নেই-!
খসে পড়া পালকেরা স্মৃতির দ্রাঘিমা জুড়ে পাখিছায়া আঁকে।
’
(পাখিছায়া। বিমূর্ত বোধের দ্রাঘিমা। পৃ. ১৫)
আমার আরেক সহকর্মী যে নিজেও কবিতা লেখে, ওর লেখার ছদ্মনাম প্রভাত ঋষি। ও নির্বাচন করে নিচে উদ্ধৃত পঙক্তিমালা--
.........................................................
‘ছুঁয়েছি বলেই বার বার ফিরে আসি
ছুঁয়েছি বলেই জীবনেরে ভালোবাসি
ছুঁয়েছি বলেই আলোকিত এই হাত
আমি ছুঁয়ে যাবো শুভ্রশিশির -- গোলাপগন্ধী রাত। ’
(তাই, ছুঁয়ে যাই।
বিমূর্ত বোধের দ্রাঘিমা। পৃ. ১৭)
কবি গাজী লতিফের কবিতার বইয়ের নাম ‘বিমূর্ত বোধের দ্রাঘিমা’ হলেও বোধগুলি বরং মূর্ত। কবির কাজও তাই-- ভাষাহীন মুখে ভাষা দেওয়া, বোধকে বোধিতে রূপান্তরিত করা। শব্দহীন সুরে পৃথিবীকে ভালোবাসায় ভরিয়ে তোলা। কবি গাজী লতিফের ভাষায় বলি--
‘সভ্যতার মচ্ছবে কাটা গেছে আমাদের সবগুলো বট
শেকড়ের মাটি খুঁড়ে খুলে আনি তার প্রতœ-সম্পর্কের জট।
’
(প্রতœ-সম্পর্কের জট। বিমূর্ত বোধের দ্রাঘিমা। পৃ. ৪৫)
অটুট এই সম্পর্কের জটাবদ্ধতার কারণেই গোপালগঞ্জের কবি গাজী লতিফ কিংবা ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার জয়দুল হোসেন আর পাবনার কবি শ. ই শিবলী সবাই আমরা একই মায়ের সন্তান-- আর সেই মা হচ্ছেন অমৃতস্যপুত্রী-- কবিতা। গাজী লতিফ-এর ৫০ বছরপূর্তিতে আমি তাঁদেরকেও স্মরণ করছি গভীর ভালোবাসায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।