ফৌজদারি কার্যবিধির আগের ক্ষমতা ফেরত চাওয়ার পটভূমিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডেপুটি কমিশনারদের ‘অসাংবিধানিক শাসক যেন ক্ষমতায় আসতে না পারে সে জন্য মনোযোগী’ হতে পরামর্শ দিয়েছেন। ডিসিরা এবার বেশ চড়া গলায় সংক্ষিপ্ত বিচারসহ বহু রকম ক্ষমতা চাইছেন। এসব গণতন্ত্রসম্মত নয়।
যেকোনো স্বৈরশাসনে আমলাচালিত মোবাইল কোর্ট হলো তাসের ইশকাপন। তাই মহীউদ্দীন খান আলমগীর, যিনি জনতার মঞ্চের পথিকৃৎ, তাঁর নেতৃত্বাধীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কত অবলীলায় মোবাইল কোর্টের ক্ষমতার পরিধি বাড়াতে সম্মতি দিচ্ছেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল আওয়ামী লীগ করেনি। তারা করতে চায়নি। দলীয়ভাবে কখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রবাহিনীর করার কী আছে? তারা যে নিতান্ত অসহায়। আইনের শাসনের চেতনা ছাড়া তাদের মস্তিষ্কে আর কিছু ঢোকে না।
বিএনপি সেনাছাউনির দল বলে যা পারে, আওয়ামী লীগ তা পারে না। সে কারণেই সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেছে। কিন্তু আদালতের দোহাই দেওয়া কপটতা ছাড়া কিছু নয়। এর বহু প্রমাণ আছে যে তারা রায় মানে না। সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তে শ্রদ্ধাশীল থাকে না।
এই সত্য বিচার বিভাগ পৃথক্করণে অনেক বেশি সত্য। একই সঙ্গে তারা বিএনপির বিচারে প্রশংসার দাবিদার। তারা পৃথক্করণ অধ্যাদেশ আইন না করলে বিএনপি হরতাল দিত না, বরং বাহবা দিত। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা পৃথক করেছে। ডিসিদের মেদ কমিয়েছে।
ডিজেরা (ডিস্ট্রিক্ট জাজ) ডিসিদের কাছে কোণঠাসা ছিলেন। বর্তমান সরকার ডিজেদের বেতন স্কেল সচিবদের সমান করেছে। কিন্তু সরকার আমলাদের কুমন্ত্রণায় ধীরে ধীরে ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলার রায় উল্টে দিচ্ছে।
সরকারগুলো ডিসিদের কত গুরুত্ব দেয়, তা আমরা সব সময় দেখি। মন্ত্রিপরিষদ সচিব সাংবাদিকদের বলছেন, গণতান্ত্রিক দেশ।
তাই ডিসিরা মত দিচ্ছেন। কিন্তু তাঁরা এবার যা করছেন, তা রীতিমতো গুরুতর আদালত অবমাননা। তাঁরা সম্ভবত মনে রেখেছেন যে এই মামলায় আদালত অবমাননার অভিযোগ বহুবার বহুভাবে আনা হলেও কারও চাকরির ক্ষতি হয়নি। তাই মাসদার হোসেন মামলা-সংক্রান্ত বিষয়ে অন্তত আদালত অবমাননার অভিযোগ তাঁদের বিচলিত করবে না। ওটা তাঁদের সয়ে গেছে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছেন, প্রতিবছরই ডিসিদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বৈঠক করেন। এটা দাবি আদায়ের ফোরাম নয় যে সব বিষয় আলোচনার উপযোগী, সেগুলোরই কেবল এখানে আলোচনা হবে। কিন্তু তিনি আমাদের বলেননি, ডিসিদের ওই দাবি ২০০ বছরের পুরোনো। এর প্রেতাত্মা অনাদিকাল ধরে ভেসে বেড়ায়। দেশে কী অমাবস্যা আসছে যে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টের রায় পাল্টানোর আবদার ওঠে? পৃথক্করণের পর এবারেই এই লম্ফঝম্পটা বেশি দেখছি।
ডিসিদের এই দাবি গণকর্মচারী শৃঙ্খলাবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। দেশে কার্যকর পার্লামেন্ট ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকলে ডিসিদের এই দুঃসাহস হতো না। তবু বলব, পার্লামেন্টের উচিত মন্ত্রিপরিষদ ও জনপ্রশাসনসচিবকে তলব করে সবক দেওয়া। এটা বলে দেওয়া যে সুপ্রিম কোর্টের রায় বদলাতে উন্মুক্ত আলোচনার অধিকার ডিসিদের নেই। তাঁদের দায়মুক্তি দেওয়া নেই।
আমার আশঙ্কা, বিচারকদের বেতন স্কেল বাড়ানোটা পুষিয়ে দিতে ডিসিদের আরও বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া হতে পারে। এবারের আলোচনা এবং সংবাদপত্রে তার বড় বড় হরফে শিরোনাম অশুভ অগ্রগতির ইঙ্গিত দিচ্ছে।
পৃথক্করণের পর থেকে প্রশাসন ক্যাডার ছলে-বলে-কৌশলে বিচারিক ক্ষমতা হরণ করছে। তারা একটি ইঁদুরে গর্ত করেছে, এর নাম মোবাইল কোর্টের তফসিল। সেনাবাহিনীকেও তাদের সঙ্গে আপস করতে হয়েছিল।
বিচার বিভাগ পৃথক্করণের বিরুদ্ধে তারা জিহাদ ঘোষণা করলে একটা আপসরফা হয়। একটি উদ্ভট মোবাইল কোর্ট-ব্যবস্থা তারা চালু করিয়ে নেয়। এটা আগেকার আমলাদের লালসালু ঘেরা আদালত বিলোপের ক্ষতিপূরণ। তবে মোবাইল কোর্টের তুলনা কেবল সামরিক আদালত কিংবা ক্যাঙারু কোর্টের সঙ্গে তুলনীয়। মোবাইল কোর্ট শব্দটি একটা সাধারণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
এঁরা ফরমালিনযুক্ত খাবার ও পণ্য চিহ্নিত করেন। কিন্তু আমরা লক্ষ করি না তাঁরা ফরমালিনযুক্ত বিচার দিচ্ছেন। টিভি ক্যামেরা থাকে। বেশ একটা টাটকা বিচার এখানে পাওয়া যায়। সামরিক শাসকেরা ক্ষমতায় এসে যেভাবে চুল খাটো করে, শরীরে আলকাতরা মেখে সমাজে তথাকথিত শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন, সে রকমের একটা ব্যবস্থার নাম আমলা পরিচালিত মোবাইল কোর্ট।
গত দু-তিন দিন সংবাদপত্রে সংক্ষিপ্ত বিচারের ব্যানার হেডিংগুলোও ইঙ্গিত দেয়, সংবাদকর্মীরা এর গুরুত্ব সম্পর্কে কতটা সচেতন।
আইন মন্ত্রণালয়টা দখলে নিতে প্রশাসন ক্যাডারের জিহ্বা প্রসারিত। পৃথক্করণের বদলা নিচ্ছে তারা। আইনসচিব পদে তারা কাউকে বসতে দেয়নি। কিন্তু এ নিয়ে কোনো টুঁ শব্দটি নেই।
ছাত্রলীগনামীয় সাবেক ক্যাডাররা নিম্ন আদালতের বিচারকদের পেশাগত একমাত্র সংগঠনটিকে সরকারের ‘বি’ টিমে পরিণত করেছে। কোনো সম্মেলন ডাকতে হচ্ছে না। কারণ, সম্মেলন ডাকলে ডিসিদের দাবি খণ্ডাতে হবে। এর পুরস্কার হিসেবে অবৈধভাবে কৃত্রিম পদধারীরা তাঁদের বেতন-ভাতা হালাল করার মওকা পাচ্ছেন।
সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় গঠনের মুলা সামনে ঝোলানো আছে।
এই সরকার তার পুরো মেয়াদ করে দিল আইনসচিব, অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিবের পদ শূন্য রেখেই। সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শে আইনসচিব নিয়োগে আলোচিত রায় আছে। সেটা নীরবে কাঁদছে। সম্প্রতি আরও করুণ রস আস্বাদন করলাম। আমলাদের মতো ওএসডি বিচারকদের একটি তালিকা হয়েছে।
এটা নজিরবিহীন। গত ৩ জুন এক ওএসডি একটি রিট করলেন। সুপ্রিম কোর্টকে না জানিয়ে সচিব পদে এক আগন্তুকের তিন বছর পার করানোর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেছেন। আবেদনকারীর ওপরে সাঁড়াশি বিভাগীয় তদন্ত চলেছে। রিপোর্টগুলো তাঁকে মুক্তি দিলেও তাঁর ফাইল ডানে-বাঁয়ে নড়ে না।
শুধু ধূর্ততা ও আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বছরের পর বছর আইনসচিবের পদ শূন্য করে রাখা একটি অকার্যকর রাষ্ট্রের সূচক বটে।
এটা দেখার একক সাংবিধানিক দায় সুপ্রিম কোর্টের। সেই প্রশ্ন রিট আকারে হাইকোর্টে যাওয়ার পরে অ্যাটর্নি জেনারেলের সময় প্রার্থনায় আমরা হতভম্ব। অন্তত চার দফায় তিনি সময় নিয়েছেন এই বলে যে এর শুনানি শুরু করার ব্যপারেই তাঁর আপত্তি আছে। ইতিমধ্যে দেড় মাস কেটে গেছে।
এখন পর্যন্ত জানা যায়নি, তাঁর আপত্তিটা কী। আবেদনকারীর আইনজীবী এম কামরুল হক সিদ্দিকী নিশ্চিত করেন যে, তাঁর বিরোধিতা সত্ত্বেও অ্যাটর্নি জেনারেলের অনুরোধক্রমে আদালত সময় মঞ্জুর করছেন।
বিচার প্রশাসনের মলিন জৌলুশ একেবারে লুপ্ত হতে বসেছে। সারা দেশের বিপুলসংখ্যক বিচারকের নৈতিক মনোবল, বিচার ক্যাডার নিয়ে গর্বে চিড় ধরেছে বলে প্রতীয়মান হয়। একাত্তরের চেতনার ধ্বজাধারী গুটিকয়েক তোষামোদকারী ব্যক্তি আত্মতুষ্টিতে ভুগছেন।
তাঁরা শয়ে শয়ে বিচারকের মনঃকষ্টের কারণ হয়ে এবং জুডিশিয়াল সার্ভিস সমিতির লালবাতি জ্বালিয়ে খালি চাপার জোরে পার পাচ্ছেন। একদিকে প্রশাসন ক্যাডার বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে, অন্যদিকে বিচার প্রশাসনে নৈরাজ্য অব্যাহত রয়েছে। তাই মাসদার হোসেনের রায় কেবল আমলারাই নষ্ট করছেন, তা বলা একচোখা হবে। বরং বিচার প্রশাসন বিচারিক মনন দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই আমলা ও বিচারকেরা পৃথকযাত্রায় অভিন্ন চর দখল নীতিই আঁকড়ে আছেন।
আমরা নগর সরকারের নির্বাচিতদের নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় পুলিশ চেয়েছি। সরকার ডিসিদের কাছে পুলিশ রাখতে ভয় পায় না, নির্বাচিতদের ভয় পায়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও সাইবার আইনে তফসিলে ঢোকানোর পরিণাম ভয়ংকর হতে বাধ্য। কিন্তু আমি জানি, এটা অরণ্যে রোদন হতে পারে। নির্বাচনী আইনে দেখছি, ট্রাইব্যুনালে শুধু বিচারকে আর ভরসা নেই।
তাই আমলা ঢোকাচ্ছে। প্রথম আলোতে ২০ জুলাই এলেন তিন মার্কিন, মিনেসোটার একজন জেলা জজ ছিলেন, কথা হলো নির্বাচনী আইন নিয়ে। আমলা আদালত শুনে তাঁরা বেশ মজা পেলেন মনে হলো। আচ্ছা, একটা প্রস্তাব দিই। ক্ষমতার পৃথক্করণ যখন আমাদের মাথায় ঢুকবেই না, তখন একটা কাজ হোক।
হাইকোর্টের বেঞ্চে একজন করে সেক্রেটারিকে প্রেষণে দেওয়া হোক! সেখানে সামারি ট্রায়াল হোক! এমনকি তাঁদের দিয়ে মোবাইল কোর্টও হতে পারে!
এই পরিহাস এ জন্য যে, তফসিলের পেট আর কত মোটা করা হবে। সেনাবাহিনী বড়জোর ২০টি আইন ও কেবল জরিমানা করার বিধান পর্যন্ত ভেবেছিল। এখন তারা মানুষ জেলে পুরতে পারে। তফসিলে আইনের সংখ্যা ১০০ ছুঁইছে। তাই এদের ক্ষুধা মাদকে, সাইবারে বা শিশুশ্রমে মিটবে না।
লালসালু ঘেরা এজলাস পুনরুদ্ধার তাদের গন্তব্য। তাই মাসদার হোসেন না ওল্টানো পর্যন্ত তারা থামবে না। বিএনপি এ বিষয়ে মুখে কুলুপ দেবে। কারণ, আওয়ামী লীগ না দিলে তারা দেবে। ডিসিরা নরম মাটির আভাস পেয়েছেন!
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।