আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চলে গেলেন পপ সম্রাট আজম খান

কিসের যেন ধান্দা খুজে ফিরি সারাক্ষণ পপসম্রাট আজম খান আর কখনও মঞ্চে গাইবেন না। কালজয়ী অসংখ্য গানের গায়ক, বীর মুক্তিযোদ্ধা এ শিল্পীর কণ্ঠে আর নতুন গান শুনবেন না শ্রোতারা। ভক্ত, অনুরাগী, শুভাকাঙ্ক্ষীদের শোকাতুর করে পৃথিবীকে তিনি গতকাল চিরবিদায় জানালেন। ৬১ বছর বয়সী পপসম্রাট রোববার সকাল ১০টা ২০ মিনিটে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি ... রাজিউন)। মুখগহ্বরে ক্যান্সার আক্রান্ত এ শিল্পী গত দশদিন ধরে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন।

সঙ্গীতশিল্পীর পাশাপাশি তিনি ছিলেন সফল অভিনেতা, মডেল, উপস্থাপক। তার মৃত্যুতে সাংস্কৃতিক অঙ্গনসহ সারাদেশে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়াসহ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের শীর্ষপর্যায়ের ব্যক্তিত্বরা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। বিএনপিসহ বিরোধী দলের ডাকা হরতালের কারণে তার দাফন গতকাল সম্ভব হয়নি। তার লাশ গতকাল ছিল সিএমএইচ মর্গে।

সেখানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তাকে শেষ দেখা দেখতে আসেন অসংখ্য সঙ্গীতশিল্পী, রাজনীতিবিদ, ভক্ত, শুভাকাঙ্ক্ষী। আজ সকাল দশটায় তার লাশ সিএমএইচ মর্গ থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেয়া হবে। এখানে সর্বস্তরের মানুষ তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাবেন। দুপুর বারোটায় লাশ নেয়া হবে ঢাকার কমলাপুরে নিজ বাড়িতে। পরে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে বাদ জোহর জানাজা শেষে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার লাশ দাফন হবে।

ঘাতক ক্যান্সারের সঙ্গে এক বছর : প্রায় এক বছর ধরে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়ছিলেন আজম খান। ২০১০ সালের ১০ জুলাই তার মুখগহ্বরে জিহ্বার নিচে ক্যান্সার ধরা পড়ে। ওই বছরের ১৪ জুলাই উন্নত চিকিত্সার জন্য তাকে পাঠানো হয় সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে। ২০ জুলাই সেখানে তার মুখে সফল অস্ত্রোপচার হয়। দ্বিতীয় দফায় চিকিত্সা দিতে গত বছরের ৭ নভেম্বর আবার সিঙ্গাপুরে নেয়া হয়।

একই হাসপাতালে তাকে কেমোথেরাপি দেয়া হয়। তখন চিকিত্সকরা তাকে ৩০টি ট্রমোথেরাপি ও ৫টি কেমোথেরাপি নেয়ার পরামর্শ দেন। আজম খান ২১টি ট্রমোথেরাপি ও ১টি কেমোথেরাপি নিয়ে ২৭ ডিসেম্বর দেশে ফেরেন। দেশে ফিরে বাকি ট্রমো, কেমোথেরাপি আর নেননি। এতে কয়েকমাস ভালো থাকলেও গত ২২ মে বাম হাতে হঠাত্ প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করলে তাকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

অবস্থার আরও অবনতি হলে ১ জুন তাকে সিএমএইচে নেয়া হয়। রোববার সকালে তাকে মৃত ঘোষণা করেন সিএমএইচের চিকিত্সকরা। এ হাসপাতালের কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মেহবুবুল হক আমার দেশকে জানান, ‘রোববার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে আজম খানের অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়াও অনিয়মিত হয়ে পড়ে। চিকিত্সকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে ১০টা ২০ মিনিটে মারা যান পপসম্রাট।

’ হাসপাতাল, বাসভবনে ভক্তদের ভিড় : সিএমএইচে তার মরদেহ দেখতে আসেন অসংখ্য ভক্ত, সঙ্গীতশিল্পী, রাজনীতিবিদ। তাদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফসহ দলের আরও অনেক নেতা, শিল্পী তপন চৌধুরী, আইয়ুব বাচ্চু, কুমার বিশ্বজিত্, হামিন আহমেদ, ফকির আলমগীর, নকীব খান, ফুয়াদ নাসের বাবু, উপস্থাপক হানিফ সংকেত, সুবর্ণা মুস্তাফা, শাহেদ, কবির বকুল প্রমুখ। তারা শোকপ্রকাশ করেন। কমলাপুরের ২ নম্বর জসীম উদ্দীন রোডে তার নিজ বাড়িতেও ভক্ত, আত্মীয়স্বজনরা ছুটে যান। গতকাল দুপুরের পর ওই বাড়িতে গেলে দেখা যায়, ভিড় থাকলেও পুরো বাড়ি যেন নীরব।

বাড়িটির সবকিছু যেন শোকে স্তব্ধ। তার দুই মেয়ে ইমা, অরনী খান, একমাত্র ছেলে হৃদয় খানকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন আত্মীয়স্বজনরা। ঢাকার আজিমপুরে জন্ম নিলেও এ বাড়িতেই কাটে আজম খানের জীবনের বেশিরভাগ সময়। জন্মের পাঁচ বছর পর থেকে তিনি এ বাড়িতে ছিলেন। চার ভাই, দু্ই বোনের সঙ্গে এ বাড়িতেই বেড়ে ওঠেন তিনি।

১৯৮১ সালে তিনি শাহেদা বেগমকে বিয়ে করে এ বাড়িতেই সংসার শুরু করেন। শ্রোতানন্দিত গান : সঙ্গীতজীবনে পপসম্রাটের ১৭টি অ্যালবামসহ বেশ কয়েকটি মিক্সড অ্যালবাম বের হয়। তার প্রায় সব গান সাড়া জাগায় নানা বয়সের শ্রোতার মনে। ‘ওরে সালেকা মালেকা’, ‘বাংলাদেশ’, ‘হাইকোর্টের মাজারে’, ‘এত সুন্দর দুনিয়ায়’, ‘জীবনে কিছু পাব না’, ‘চার কলেমা’, ‘আলাল ও দুলাল’, ‘অভিমানী’, ‘ঢাকা কত দূর’, ‘সাঁইজি’, ‘ইচ্ছে হলেই’, ‘বিদায় বেলায়’, ‘জীবনে মরণ কেন’, ‘অ্যাক্সিডেন্ট’, ‘সব মানুষই সাদা কালো’, ‘পুড়ে যাচ্ছে’, ‘মানুষ নামে খেলনা’, ‘এমনি চলে যাব’, ‘ইন্ডি বিন্ডি সিন্ডি’ ইত্যাদি তার শ্রোতানন্দিত গান। জন্ম, বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা : আজম খানের পুরো নাম মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান।

তিনি ১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আজিমপুর কলোনিতে জন্ম নেন। তার মায়ের নাম জোবেদা খানম, বাবার নাম মোহাম্মদ আফতাব উদ্দিন খান। বাবা সরকারি চাকরিজীবী, মা সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন। ’৫৫ সালে প্রথমে আজিমপুরের ঢাকেশ্বরী স্কুলে ভর্তি হন আজম খান। ’৫৬ সালে কমলাপুরের প্রভিনশিয়াল স্কুলে প্রাইমারিতে ভর্তি হন।

’৬৬ সালে সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুল থেকে এসএসসি, ’৬৮ সালে টিঅ্যান্ডটি মহাবিদ্যালয় থেকে এইচএসসি পাস করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা হয়নি। সঙ্গীতজীবন : সঙ্গীতপ্রেমিক হিসেবে তিনি একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। জীবনের নির্মম পরিহাসে অত্যন্ত দুঃখ ভারাকান্ত অবস্থায়ও আঁকড়ে ধরে ছিলেন গান। মুক্তিযুদ্ধের কারণে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষাগত দিক থেকে পিছিয়ে পড়েন।

ফলে উপার্জনের জন্য একমাত্র অবলম্বন হয়ে ওঠে তার অর্জিত প্রতিভা পপসঙ্গীত। ’৭২ সালে নটর ডেম কলেজের প্রাঙ্গণে নিজস্ব আয়োজনে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রথম দর্শকের সামনে গান করেন তিনি। ’৭৩ সালের এপ্রিলে প্রথম কনসার্টে গান করেন। ওই কনসার্টে ফিরোজ সাঁই, ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফকির আলমগীর ও পিলু মমতাজ গান করেন। কনসার্টে আজম খান ‘হে আল্লাহ হে আল্লারে’, ‘চার কলেমা’, ‘হাইকোর্টের মাজারে’, ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা’ গান গেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান।

‘ঢাকা রেকর্ড’ থেকে ’৭৩ সালের শেষের দিকে তার প্রথম রেকর্ড বের হয়। ’৮২ সালে ‘একযুগ’ নামে তার প্রথম ক্যাসেট বের হয়। প্রথম সিডি বের হয় ’৯৯ সালে ডিস্কো রেকর্ডিংয়ের প্রযোজনায়। বিটিভিতে প্রথম গান করেন ’৭৩ সালে। ২০০৩ সালে গডফাদার নামক বাংলা সিনেমায় ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করেন।

একই বছর ক্রাউন এনার্জি ড্রিংক্সের বিজ্ঞাপনের মডেল হন। বাংলালিংকের বিজ্ঞাপন করেন ২০০৫ সালে। ২০০৮ সালে আবার বাংলালিংক, ২০১০ সালে কোবরা ড্রিংক্সের বিজ্ঞাপন করেন। পুরস্কার, বিদেশ ভ্রমণ : বিদেশে গেছেন খুব কম। ’৯৩ সালে আমেরিকায় আয়োজিত কনসার্ট, ’৯৮ সালে ইংল্যান্ডে তিনটি কনসার্ট, ’৮৬ সালে বাহরাইনে দুটি কনসার্ট, দুবাইতে ২০০৮ সালে চ্যানেল আইর উদ্যোগে লাক্স সুপার স্টার পারফরম্যান্স অ্যাওয়ার্ডে অংশ নেন।

বিভিন্ন সময়ে প্রায় ১০০টি পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। এর মধ্যে হলিউড থেকে ডিস্কো রেকর্ডিংয়ের সৌজন্যে ’৯৩ সালে ‘বেস্ট পপসিঙ্গার অ্যাওয়ার্ড’, ‘টেলিভিশন দর্শক পুরস্কার ০২’, ‘কোকাকোলা গোল্ড বোটলসহ লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’, ’০৮ সালে রেডিও টুডের পক্ষ থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা অ্যাওয়ার্ড, ক্রিকেট টুর্নামেন্ট পুরস্কার, ফুটবল টুর্নামেন্ট পুরস্কার উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধ : একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন আজম খান। তিনি ২ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি প্রশিক্ষণ নেন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার মেলাঘরে।

প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে গেরিলাযুদ্ধে অংশ নেন। কুমিল্লার সালদাহ, ঢাকার ডেমরা, যাত্রাবাড়ী হয়ে লানদী, বালুনদী, গুলশান, ক্যান্টনমেন্টসহ নানা এলাকার মিশনে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সহযোদ্ধাদের মানসিক শক্তি জোগাতে ক্যাম্পে বসে গান ধরতেন তিনি। তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে ঘটিবাটিতে চামচ বাজিয়ে গান ধরতেন অন্য যোদ্ধারাও। সর্বত্র শোকের ছায়া : তার মৃত্যুতে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক বিভিন্ন দল ও সংগঠনের নেতারা শোকপ্রকাশ করেছেন। জাতীয় পার্টি, জাসদ, গণফোরাম, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, বিকল্পধারা, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, যুব গণফোরাম, সিলেট বিভাগ উন্নয়ন পরিষদ, জিয়া সেনা, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, জনদুর্ভোগ নির্মূল জাতীয় কমিটি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বিজিএমইএসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতারা শোক প্রকাশ করেন। ওদিকে আজম খানের মৃত্যুতে স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট, ডেপুটি স্পিকার কর্নেল শওকত আলী এবং চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ গভীর শোকপ্রকাশ করেছেন। তারা মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। পৃথক শোকবার্তায় তারা মুক্তিযুদ্ধ এবং সঙ্গীত অঙ্গনে মরহুমের অবদানের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন Click This Link  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।