আমি আমার মতো ১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার আজিমপুরে জন্মগ্রহণ করেন আজম খান। তার পুরো নাম মাহবুবুল হক খান। ২১ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া এই সঙ্গীত শিল্পী স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে 'উচ্চারণ' নামে একটি ব্যান্ড দল গঠন করেন। ১৯৭৪-৭৫ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে 'রেললাইনের ওই বস্তিতে' গেয়ে স্থান করে নেন বাংলার মানুষের হৃদয়ে।
বাংলাদেশ টেভিভিশনে তার প্রথম কনসার্ট প্রচারিত হয় ১৯৭২ সালে।
আজম খানের কণ্ঠে 'ওরে সালেকা, ওরো মালেকা', 'আলাল ও দুলাল', 'অনামিকা', 'অভিমানী, 'আসি আসি বলে' গানগুলো বাংলাদেশে পপ সঙ্গীতকে জনপ্রিয় করে তুলতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। বাংলা সঙ্গীতের ব্যান্ডধারার অন্যতম পথিকৃৎ আজম খান। কিংবদন্তীতুল্য এই পুরুষকে তরুণ সমাজ চেনে ‘পপগুরু’ হিসেবেই।
পপসম্রাট আজম খান আর নেই। আজ রোববার সকাল ১০ টা ২০ মিনিটে ঢাকা সেনানিবাসের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন কিংবদন্তি এ শিল্পি (ইন্নালিল্লাহে ওয়াইন্না...রাজেউন)।
হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. কর্নেল পাশা সকাল সাড়ে ১০টায় আজম খানের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬১ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে রেখে গেছেন।
পপগুরুর মৃত্যুতে সঙ্গীত ও সংস্কৃতি পরিমণ্ডলে শোকের ছায়া নেমে আসে। সঙ্গীত ও সংস্কৃতি অঙ্গনের বিশিষ্টজনেরা আজম খানের মৃত্যুকে এ জগতের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি বলে অভিহিত করেছেন।
প্রয়াত আজম খানের বন্ধু ফকির আলমগীর বলেন, 'আমরা একজন বড় মাপের শিল্পীকে হারালাম। তিনি পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সঙ্গে দেশি সঙ্গীতের মেলবন্ধন ঘটিয়ে গানের ভুবনে নতুন ধারা সৃষ্টি করেছিলেন। এদেশে পপগানের ধারা সৃষ্টি তার হাত ধরেই। গান দিয়ে তিনি মানুষকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছেন। আমি, আজম খান, ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফিরোজ সাঁই ও পিলু মমতাজ মিলে এদেশে পপগানের যে যাত্রা শুরু করেছিলাম আজ তা একটি পরিণত রূপ পেয়েছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও আজম খানের অবদান অপরিসীম। দেশ একজন মুক্তিযোদ্ধা ও গুণী শিল্পীকে হারাল। আমি আমার বন্ধূর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।
ফেরদৌস ওয়াহিদ বলেন, আমাদের সঙ্গীত জীবনের শুরুটা হয়েছিল একসঙ্গে। আজ আমাদের রেখে সে বিদায় নিল।
আমরা হারালাম এদেশের সঙ্গীতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রকে। তার দেখানো পপসঙ্গীতের পথ ধরেই আজকের অনেক জনপ্রিয় শিল্পী প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন।
নকীব খান বলেন, এদেশের মানুষকে তিনি দুটি জিনিস উপহার দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেশকে এনে দিয়েছেন স্বাধীনতা। আরেক দিকে ব্যান্ড মিউজিককে ড্রইংরুম থেকে বের করে পৌঁছে দিয়েছেন সাধারণ মানুষের কাছে।
আইয়ূব বাচ্চু বলেন, 'গানের ভুবনের এক দিকনিদের্শক ও অভিভাবককে হারালাম আমরা। আজম খানের হাত ধরেই শুরু হয় বাংলাদেশের পপ সঙ্গীতের পথচলা। বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতে সত্যিকার অর্থেই তিনি আমাদের গুরু ছিলেন। তাঁর দেখানো পথ ধরেই আমাদের ব্যান্ড মিউজিক সমৃদ্ধ হয়েছে। তার গানের সঙ্গে স্টেজ পারফরমেন্স ছিল অসাধারণ।
বিশেষ ভঙ্গিমার নাচের সঙ্গে দরাজ কণ্ঠের গানে মাতিয়ে তুলতেন শ্রোতাদের। আজম খানের কনসার্ট মানেই ছিল তারুণ্যের উন্মাদনা আর উল্লাস। '
আজম খান ছিলেন ২ নম্বর সেক্টরের অসীম সাহসী এক মুক্তিযোদ্ধা। একই সেক্টরের বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত একজন মুক্তিযোদ্ধা সেলিম আকবর। তিনি ছিলেন পপসম্রাটের রণাঙ্গনের বন্ধু।
মুক্তিযোদ্ধা আজম খান সম্পর্কে তিনি বলেন, দেশ একজন অনেক বড় মুক্তিযোদ্ধাকে হারাল। সে ছিল দুরন্ত সাহসী এক যোদ্ধা। রণাঙ্গনে সব সময় সে সামনের সারিতে থেকে লড়াই করতো। প্রকৃতপক্ষে আমার নয় বীরপ্রতীক খেতাব পাওয়া উচিত ছিল তাঁর। শুধু লড়াই করাই নয়, রণাঙ্গনে অবসরে গান শুনিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করে রাখতেন আজম খান।
পপগায়ক আজম খান: গায়ক হিসেবে বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন আজম খান। দেশকে স্বাধীন করার জন্য একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে রাইফেল হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। স্বাধীন দেশে রাইফেল ছেড়ে ফিরে যান গানের জগতে। সত্তরের দশকে তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সুরের মেলবন্ধন ঘটিয়ে এদেশে পপসঙ্গীতের সূচনা করেন। ভিন্ন মাত্রার গায়কী ও পরিবেশনা দিয়ে অল্পদিনেই শ্রোতাপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি।
সেসময় তার সঙ্গে দেশের সঙ্গীতের এ নতুন ধারায় যুক্ত হন শিল্পী ফিরোজ সাঁই, ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ, নাজমা জামানসহ সদ্যপ্রয়াত পিলু মমতাজের মতো সময়ের একঝাঁক তরুণ প্রতিভা। পপগানে তুমুল জনপ্রিয়তা আজম খানকে এনে দেয় পপসম্রাটের খেতাব। পপগানের এই রাজাকে কেউ কেউ পপগুরু বলে সম্বোধন করতেও পছন্দ করতেন। এদেশে পপ তথা ব্যান্ড সঙ্গীতের অগ্রপথিক ও কিংবদন্তি শিল্পী আজম খান।
১৯৭২ সালে নটরডেম কলেজের একটি অনুষ্ঠানে প্রথম মঞ্চে গান শোনান পপগুরু আজম খান।
তখনো এদেশে প্রচলিত হয়নি কনসার্ট নামের সঙ্গীতানুষ্ঠান। ১৯৭৩ সালের ১ এপ্রিল প্রথম কনসার্ট হয় ওয়াপদা মিলনায়তনে। সেখানে এক মঞ্চে গান গেয়েছিলেন আজম খান, ফিরোজ সাঁই, ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফকির আলমগির ও পিলু মমতাজ। ১৯৮২ সালে বের হয় তাঁর প্রথম ক্যাসেট 'এক যুগ'। সব মিলিয়ে তাঁর অডিও ক্যাসেট ও সিডির সংখ্যা ১৭টি।
সত্তর, আশি ও নব্বইয়ের দশকে বৈচিত্র্যময় কথার নানা পপগান গেয়ে তারুণ্যের হৃদয়ে উন্মাতাল আনন্দের ঝড় তুলেছেন। তার অগণিত জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, আলাল ও দুলাল, ওরে সালেকা ওরে মালেকা, অভিমানী, আমি যারে চাইরে, হাইকোর্টের মাজারে, এত সুন্দর দুনিয়ায়, জীবনে কিছু পাব নারে, পাঁপড়ি কেন বুঝে না, চার কলেমা সাক্ষী দিবে এবং ও চাঁদ সুন্দর রূপ তোমার ইত্যাদি।
অভিনয় জীবন : খেয়ালি মানুষ ছিলেন আজম খান। গানের বাইরে বিভিন্ন জনের অনুরোধে অভিনয়ও করেছিলেন। ১৯৮৬ সালে হীরামনে কালা বাউলের চরিত্রে অভিনয় করেন।
২০০৩ সালে 'গডফাদার' সিনেমায় ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। এছাড়া বাংলালিংক, ক্রাউন এনার্জি ডিংঙ্সসহ বেশকিছু বিজ্ঞাপনেও কাজ করেন।
মুক্তিযোদ্ধা আজম খান : মুক্তিযুদ্ধেও বীরোচিত ভূমিকা রেখেছেন পপসম্রাট আজম খান। জীবনকে বাজি রেখে অংশ নিয়েছেন অসংখ্য গেরিলা যুদ্ধে। প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার মেলাঘরে।
প্রশিক্ষণ শেষে দেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেন দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে। অস্ত্র হাতে প্রথম লড়াই করেন কুমিল্লার সালদাহে। এরপর ঢাকার ডেমরা, যাত্রাবাড়ী হয়ে লক্ষানদী, বালুনদী, গুলশান, ইসাপুর ও ক্যন্টনমেন্টের পাশ পর্যন্ত নানা স্থানে অংশ নিয়েছেন গেরিলা অপারেশনে। যুদ্ধকালীন সময় ডেমরার তিতাস মিশন শেষ করে ফেরার পথে নৌকাডুবিতে বিপর্যয়ে পড়েন তিনি। নদীর তলদেশের লতায় পা আটকে যাবার ফলে সাঁতার কাটা দুরূহ হয়ে পরে।
অস্ত্র টানার নৌকা জড়িয়ে ধরে আত্মরক্ষা করেন তিনি।
অসুস্থতার দিনলিপি: ২০১০ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি স্কোয়ামাস সেল কার্সিনোমা নামক মুখগহ্বরের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন আজম খান। প্রথমে তাকে বঙ্গুবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ১৪ জুলাই তিনি সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে ইএনটি হেড-নেক সার্জন বিভাগের প্রধান অ্যান্ড্রু লয় হেং চেংয়ের তত্ত্বাবধানে আজম খানের মুখে সফল অস্ত্রোপচার করা হয়।
৭ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায় তাকে পুনরায় সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে মোট ৩০টি রেডিওথেরাপি ও ৫টি কেমোথেরাপি দেয়ার কথা থাকলেও আজম খান ২১টি রেডিওথেরাপি ও ১টি কেমোথেরাপি নিয়ে ২৭ ডিসেম্বর দেশে ফিরে আসেন। সম্পূর্ণ কোর্সটি সম্পন্ন করা সমর্থন করেনি তাঁর শরীর। এরপর গত ২২ মে হঠাৎ বাম হাতে প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভব করলে তাকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৭ মে গুরুতর অসুস্থ হলে তাকে লাইফ সাপোর্ট দেয়া হয়।
এরপর স্কয়ার থেকে ১ জুন সিএমএইচে স্থানান্তর করা হয় তাঁকে।
আজম খানের বেড়ে ওঠা : ১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার আজিমপুরের ১০ নম্বর সরকারি কোয়ার্টারে জন্মগ্রহণ করেন আজম খান। পুরো নাম মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান। বাবা মোহাম্মদ আফতাব উদ্দিন খান ও মা জোবেদা বেগম। বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী ও মা ছিলেন সংগীতশিল্পী।
মায়ের মুখেই গান শুনতে শুনতেই গড়ে ওঠে গানের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক । ১৯৫৬ সালে আজিমপুরের সরকারি বাসা ছেড়ে কমলাপুরের জসীমউদ্দীন রোডে নিজেদের বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৬৮ সালে টিঅ্যান্ডটি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। উঠতি বয়সে বড় ভাইদের গানের চর্চা দেখে তীব্রভাবে ঝুঁকে পড়েন সঙ্গীতের মায়াজালে। বিভিন্ন এলাকার বন্ধুদের বাড়ির ছাদে বসে জমে উঠতো গানের আসর।
হেমন্ত, শ্যামল মিত্র, মুখেশ, মুহাম্মদ রফি, কিশোর কুমারসহ দেশ-বিদেশের নানান শিল্পীর গানে মাতিয়ে রাখতেন আসর। ১৯৮১ সালের ১৪ই জানুয়ারি তিনি সাহেদা বেগমকে বিয়ে করেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।