আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হাম হাম ঝর্ণার সন্ধানে - শেষ পর্ব

জাগরী একটি নির্দলীয় মঞ্চ যেখানে বাংলাদেশের যুবসমাজ দেশের রাজনৈতিক ও নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে সচেতন,সোচ্চার ও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করতে পারে। www.jagoree.org   ফিরতি পথ – হামহাম থেকে কলাবন - যাবার পথে পাহাড় বেয়ে এই পথ ধরে ঝরণা পর্যন্ত যাওয়ার পর আর এই পথে উল্টো পাহাড় ডিংগানোর কথা মনে হতেই মনের ভেতরটা কেমন যানি বিষিয়ে উঠল। শরীরে আর শক্তি নাই যে আবার এতগুলো পাহাড় ডিংগিয়ে ফিরে যাব। আমাদের গাইডকে জিজ্ঞাসা করছিলাম আর কোন অলটারনেটিভ পথ আছে কি না? গাইড আমাদের জানালো যে যদি পাহাড় বাইতে না চাই তাইলে আমরা একটু ঘুরা পথ হলেও এই ঝিরি বেয়ে কলাবন পৌছুতে পারব, কোন রকম চিন্তা ভাবনা ছাড়াই আমরা এই অলটারনেটিভ ঝিরি পথ কে বেছে নিলাম। তবে এক্ষেত্রে আমাদের একটি মাত্র বড় পাহাড় বাইতে হবে, ৮-১০টি পাহাড় বাওয়া থেকে একটি পাহাড় বাওয়া আমাদের জন্য তখন কিছু না।

ঝিরি পথ ধরে আমরা ফিরতি পথে রওয়ানা দেওয়ার ১৫ মিনিট পরে দেখি ফ্যামিলি গ্রুপটি ঝর্ণার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের যাত্রার শুরু থেকে সময় হিসেব করলে তাদের পৌছুতে সময় লেগেছে (১১.৩০-৩.১৫) – ৩ঘন্টা ৪৫মিনিট, এখনো তাদের ১৫মিনিটের পথ বাকি। ছোট বাচ্চাগুলোর দিকে তাকানো যাচ্ছে না, মনে হচ্ছে এক একজন যেন ক্লান্তিতে এখানেই শুয়ে পড়বে। আমরা ওনাদের তারাতারি ফেরার তাগিদ দিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম। এবার ঝিরির যেখান থেকে শুরু করেছিলাম তার ১৫মিনিট আগে আমরা পাহাড় বেয়ে ওপরে ওঠা শুরু করমাম, খাড়া পাহাড় এটা, বাঁশে ভর দিয়ে দিয়ে উঠতে শুরু করলাম।

একহাতে বাঁশ দিয়ে ধরে ব্যালেন্স করছি আরেক হাতে বাঁশের ঝাড় ধরে বেয়ে বেয়ে ওপরে উঠছি। একপাশে একবারে খাড়া পাড় নেমে গেছে প্রায় ২০০ফুট, আরেক পাশে বাঁশের ঝাড় - কোন ভাবে বাঁশ ধরা হাত একটু ফসকে গেলে সরাসরি নিচে খাড়া পাথরে বাড়ি খেয়ে ঝিরিতে গিয়ে পড়ব। এভাবে প্রায় ২০মিনিট ওঠার পর এই পাহাড়ের চুড়ায় ওঠা হল, এবার নামার পালা। নামার শুরুটা সহজই ছিল, কিছু দূর নামার পর আমার মাথা ঘুরে উঠল, বাকি নামার পথটা এতটাই খাড়া যে আমার নিজেরই নামতে ভয় লাগছে। এখানে বাঁশের ঝাড়ও নাই যে ব্যালেন্স করব ধরে ধরে।

গাইডকে বলে আরেকটি বাঁশ কেটে নিলাম। দুই হাতে দুটি বাঁশ ধরে তিল তিল করে একপা দুপা করে নামতে লাগলাম। প্রায় দু বার পড়তে পড়তে বেচে গেলাম। অনেক কস্টে একপা একপা করে নিচে নামলাম। আমার আগে নেমেছে আরিফ, আমরা নামলাম এই পাহাড়ের আরেক প্রান্তে, ঝিরি বেয়ে আসলে এখানে পৌছতে আরো প্রায় ঘন্টাখানেক বেশি লাগত, গাইড জানালো যে এখানে ঝিরি ধরে হেটে আসা প্রায় অসম্ভব, যে দু পাহাড়ের ভেতর দিয়ে ঝিরিটি এসেছে সেখানে পাথরে পথ এমনভাবে ঢেকে রেখেছে যে পায়ে চলা প্রায় অসম্ভব।

পাহাড়ের উৎরাই ভেঙ্গে ঝিরিতে নামার পর আমি একদম শুয়ে পড়লাম পানির মধ্যে, কি জানি মনে হওয়ায় প্যান্ট গুটিয়ে দেখি আরেকজন জোঁক বাবাজি রানের উপর কামড়ে ধরে আছেন, পানিতে যেহেতু মাথা ভিজিয়েছি আরিফ কেন জানি আমার ঘাড় গলা চেক করা শুরু করল, কানের ভেতরের দিকের লতির ভেতর রক্তের ধারা দেখতে পেল, কখন জানি আরেকজন এসে রক্ত খেয়ে সেখান থেকে নিজে নিজে ঝরে পড়েছে আমি নিজেও জানি না। ভাগ্য ভালো যে কানের ফুঁটো দিয়ে ভেতরে গিয়ে বাসা বাধে নি। এবার ঝিরি বেয়ে নেমে যাওয়ার পালা, ভেবেছিলাম এটা তো সহজ পথ, কিছু দূর নামতে গিয়ে বুঝলাম এটা পাহাড় বাওয়ার থেকে কোন অংশে কম বিপদজনক নয়। এই অংশের ঝিরিপথ শক্ত পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে এসেছে, আর পানির ধারা পুরো ঝিরিপথ এর নিচের পাথরের গায়ে শ্যাওলা ফেলে পিচ্ছল করে রেখেছে, বাশে ভর দিয়ে আবার ব্যালেন্স রেখে হাটি হাটি চলা শুরু। কিছু অংশে ঝিরি নেমে গিয়ে তৈরি করছে ছোট ছোট ঝর্ণা প্রবাহ, কোন ভাবেই পথ চলা যাচ্ছে না এখানে, কি করা যায় ভাবতে ভাবতে ব্যালেন্স না রাখতে পেরে বসে পড়তেই যেন আমি ওয়াটার কিংডমের ওয়াটার স্কিতে চড়ে বসলাম, পানির ধারা আমাকে স্কি করে নিয়ে যেতে শুরু করল নিচের দিকে, সামনে আস্তে আস্তে ব্যালেন্স রেখে চলা আরিফের দিকে ছুটে চলেছি কমপক্ষে ২০কিমি বেগে, হাত পা, হাটু ছিলে কিছু আর নেই, দেখতে না দেখতে আরিফের উপর গিয়ে পড়লাম, ধাক্কা খেয়ে ও আমার ওপরে পড়ার আগেই আমি নিজেকে আবিস্কার করলাম পানির নিচে – যেখানে ঝিরি ধারা ছোট ঝর্ণা হয়ে নেমে গিয়ে পুকুর তৈরি করেছে।

পায়ে জুতা ভিজে মনে হয় ১মন ভারী হয়ে রয়েছে, অনেক কস্টে ভারি পা নিয়ে কোন মতে সাঁতরে ওপরে উঠলাম। আবার পথ চলা ঝিরি বেয়ে, কিছু দূর পর পর যেখানে ঝিরি ঘেসে পাথরের ফাকে ফাকে কিছু পায়ে চলার মত জায়গা পাচ্ছি সেখানে ঝিরি থেকে উঠে কোন মতে পাহাড় ধরে ধরে হেটে চলছি। এভাবে যেন অনন্তকাল ধরে হেটে চলেছি, মাথা কাজ করছে না কোন, কল দেয়া পুতুলের মত কোথাও ঝিরি বেয়ে কোথাও পাথর ধরে ধরে এগিয়ে চলেছি। সামনে দেখছি আরেকটি ঝিরিধারা খাড়া নেমে গেছে, এবার আরিফ কে বললাম পেছনে থাকতে, আমি পানির মধ্যে স্কি করার মানসিক প্রস্তুতি বসে পড়লাম ওয়াটার স্কি তে, ঝপ করে ডুবে গেলাম আবার ঝিরি পুকুরে, সাতার দিয়ে মাথা উঠিয়ে একটু গিয়ে পায়ে মাটি পেলাম, আরিফ নেমে আসলো আমার পেছনে পেছনে, এখানে পাহাড়ের গা অনেক পেছল মনে হল, তাই ঝিরি ধরেই হাটা শুরু করলাম, এবার আরিফ আগে আমি পেছনে, একটু একটু অন্ধকার হয়ে আসছে চারিদিক, কিছুদুর হাটার পর দেখি ঝিরির দু পাশে পাথরের গর্ত গর্ত হয়ে আছে, এর মধ্যে দিয়ে হেটে যাচ্ছি দুজনে, আমাদের পেছনে গাইড তার পেছনে বাকি দল। হঠাত করেই সামনে দেখি আরিফ হাটতে হাটতে থমকে গেছে, ওর চেহারা একটু ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে, পাহাড়ের গর্তের ফাকে ওর চোখ, আমারও চোখ গেল গর্তের ফাঁকে, দেখলাম বিশাল এক কালো সাপের শরিরের অংশ দেখা যাচ্ছে, আরিফ আস্তে আস্তে পিছিয়ে আসছে, আমিও।

দুজনে মিলে পাথর বেয়ে ঝিরি থেকে উঠলাম। মাথা যেন কেমন ঝিম ঝিম করছে – আল্লাহর কাছে লাখো শোকর, কি বাচা বেচে গেছি আমরাই জানি। পেছনে বাকি সবাইকে ঝিরি থেকে উঠে পাহারের কার্নিশ ধরে এগোতে বললাম। ধিরে ধিরে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, পাহাড়ে যেন ঝপ করে অন্ধকার নেমে যায়। এর পর আধো অন্ধকারের ভেতর কখনো ঝিরি বেয়ে কখনো বনের ধার ঘেসে পা ফেলে চলা, জানি না কোথায় পা ফেলছি, সাপের মাথায় না ব্যাঙ্গের গায়ে।

শুধু সামনের দিকে পথ চলা, হঠাৎ করেই বানরের তারস্বরে চিৎকারে সম্বিত ফিরে পেলাম, বনের ছায়াঘেরা অন্ধকারে দেখলাম শত শত বানরের ঝাঁক। আবার পথ চলা পা টেনে টেনে, কোনমতে শরীরের ভার ধরে রাখা। বনের ভেতরে মনে হয় অন্ধকার হয়ে এসেছে। হঠাৎ করেই থেমে যেতে হল মাথায় কাঁটার আঘাতে, হাত দিয়ে দেখি বেতের কাঁটা বিধে আছে চুলের ফাঁকে, অন্ধকারে বুঝা যাচ্ছিল না যে আমরা বেত বনের ভেতর দিয়ে পথ চলছি। আরো কিছু পথ চলার পর হঠাৎ করেই জঙ্গল থেকে বের হয়ে আসলাম পাহাড়ের নিচে, বের হয়ে দেখি সামনে কলাবন গ্রাম।

যেখান থেকে শুরু করেছিলাম ঠিক তার পাশ ঘেসে আরেক পথ দিয়ে বের হলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সময় তখন ৬.৩৫, আমরা হাম হাম থেকে ফিরতি পথের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলাম ৪.০০টার সময়, ফিরতে সময় লাগলো দু ঘন্টা ৩৫মিনিট, যদিও মনে হচ্ছিল অনন্তকালের এক যাত্রা শেষ করলাম। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পায়ে হাটা পথে আমাদের সময় লাগলো পুরো ৬ ঘন্টা (১২.৩০ – ৬.৩৫) সমাপ্ত হল আমাদের এডভ্যঞ্চার হাম হাম ঝর্ণা। পরবর্তিতে যারা হাম হাম ঝর্ণা দেখতে যাবেন তাদের জন্য কিছু সুপারিশমালা – ১। ঢাকা থেকে রওয়ানা হয়ে হয় শ্রীমঙ্গল অথবা কমলগঞ্জে রাত কাটাবেন।

২। খুব ভোরবেলায় কলাবনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবেন, শ্রীমঙ্গল থেকে কলাবন যেতে আপনার ২ঘন্টা মত লাগবে। ৩। সাথে গাড়ি নিয়ে যেতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়, ঢাকা থেকে যদি গাড়ি না নিয়ে যান তা হলে আগের দিনই একটি মাইক্রোবাস ঠিক করে রাখুন যে আপনাকে কলাবন নিয়ে যাবে। ৪।

সাথে করে বেশি করে পানির বোতল নিয়ে যাবেন, শুকনো খাবার নিবেন, সারাদিন কিন্তু এটাই আপনার সম্বল। ৫। জোঁকের তেল সাথে নিতে ভুলবেন না। ৬। অডোমস অবশ্যই সাথে নিবেন যদি ম্যালেরিয়া না বাধাতে চান।

৭। সানস্ক্রিন মেখে নিলে রোদের হাত থেকে কিছুটা বাঁচতে পারবেন। ৮। সকাল ৮টার মধ্যে কলাবন থেকে রওয়ানা দিতে পারলে আপনি অনেকটা সেফ সাইডে থাকবেন। ৯।

কলাবন থেকে একটু শক্ত সমর্থ দেখে গাইড চয়েস করুন। ১০। যদি গ্রুপ সাইজ বড় হয় বা মহিলা সাথে থাকে তবে দুজন গাইড সাথে নিন। ১১। গ্রীস্ম কাল বা বর্ষাকালে এই পথে যাওয়া খুব সুখকর কিছু হবে না, সবচেয়ে ভালো সময় হলো শীতকাল।

১২। সাথে একটি ছোট্ট টর্চ রাখলে ভালো হয়। যে সকল ব্যক্তিবর্গের পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া এই ট্যুর সম্ভব হত না তারা হলেন - ভাষা রেহনুমা - ফেস বুকের ছোট্ট বন্ধু মুনির হাসান - সাংবাদিক ও বিভাগীয় প্রধান, প্রথম আলো নওরোজ ইমতিয়াজ - সাংবাদিক সাব্বির এলাহি - লোকাল সাংবাদিক, শ্রীমংগল প্রতিনিধি মুজিবর রহমান রঞ্জু - থানা প্রতিনিধি, প্রথম আলো মোস্তফা ভাই - ব্যবসায়ি, ভানুগাছা - যার প্রত্যক্ষ সাহায্য ছাড়া আমাদের এই ট্যুর এ যাওয়া সম্ভব হত না। এনাদের সবার কাছেই আমার কৃতজ্ঞতা। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।