আমার হয়ে কি-বোর্ড আঙুল নাড়িয়ে কথা বলছিলো একটি দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকের লগে। কি-বোর্ড তারে জিগাইলো, মহোদয়, আমার বালিশের তলের গদ্য ভাষণের পদ্যখানি কি আপনার দপ্তরে পৌঁছাইয়াছে? সম্পাদক দায়িত্বপূর্ণ উত্তর দিলেন, ‘হ্যা পেয়েছি, তবে লেখাটা বেশ বড়! আমরা তো বড় লেখা ছাপতে পারবো না!’ কি-বোর্ড বললো, ‘লেখাটি কি আপনার ভালো লেগেছে?’ উত্তরÑ ‘হ্যা, লেগেছে। ’ কি-বোর্ডÑ ‘ভালো লেখা বড় হলেও কি ছাপা যায় না?’ অসহায় উত্তরÑ ‘আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। ’ কি-বোর্ডÑ ‘আমার লেখা ছোট হলেও কি ছাপতে পারবেন?’ অসহায় উত্তর, ‘হা পারবো, পাঠান!’ কি-বোর্ডÑ ‘আমি এখনই পাঠাচ্ছি। আপনি পড়ে এখনই জানান এটা ছাপতে পারবেন কি-না।
’ কি-বোর্ড একটা আরসোলা সাইজের পদ্য পাঠাইলো। সম্পাদক পড়িলেন। কি-বোর্ডÑ ‘এটা কি ছাপতে পারবেন?’ অসহায় উত্তরÑ ‘পরে জানাবো। ’ কি-বোর্ডÑ “এ কবিতাও ছাপতে পারবেন না। কারণ, লেখা ছোট হলেও বিষয়টা ছোট নয়, শব্দ বয়ন ছোট নয়।
আমি কবিতাটি ছাপার জন্য পাঠাই নি। আপনার পড়ার জন্য পাঠিয়েছি। কখনও আপনার চাকুরি বাঁচাবার তরে আপনার পাতা ভরাবার জন্য লেখা দরকার পড়ে, তখন ‘ইহা একটি টয়লেট টিস্যু বিষয়ক রচনা’ লিখে পাঠাবো। জানাবেন। ভালো থাকবেন।
”
আমার ঘরের বাইরে দুই পাও ফেলিয়া দূরত্বের একটা ছোট ভাই-প্রকৃতির ছেলে একটা পত্রিকা করছে। আমার দু’টা কবিতা দেবার আব্দার করলো। আমি সময় মতো পাঠালাম। দু’ দিন পর ফের আব্দার, ‘আরো পাঁচটা কবিতা পাঠান ভাই! আমি আপনার একগুচ্ছ কবিতা ছাপবো!’ আমি এবার পাঁচটা কবিতা পাঠালাম। লেখা ছাপার আগে ছেলেটি আমার সাথে দেখা করতে আসলে জিগাইলাম, ‘তুমি কি আমার সব কবিতা ছাপবে?’ তার বত্রিশ পাটি দন্ত বিকশিতÑ ‘ভাই আপনার দু’টার মধ্যে একটা কবিতা ছাপতে পারব না বলে পরে একগুচ্ছ কবিতা চেয়েছি।
’ পত্রিকাটা প্রকাশিত হলো। সাতটা কবিতার মধ্যে দুটি কবিতা ছাপা হলো। দু’টির মধ্যে একটা কবিতা যে ছাপলো, সে যে কবিতাটা ভয় পেয়ে ছাপতে চাইনি, তার থেকেও ভয়ের কবিতা। বুঝলাম সে না-বুঝে ছেপেছে। সে ভয় পেয়ে যে কবিতাটা ছাপতে চাইলো না, সে-ই কবিতাটি আমার বন্ধু খুব সাধারণভাবে ২ফর্মার একটা কবিতার কাগজ বের করেÑ বন্ধু সেটাতে ছেপে দিলো।
আমি তাকে কবিতাটা দিয়ে দন্ত বিকশিত ছেলেটি যে কবিতাটা ছাপতে চাইনি, এটা তাকে বলেছিলাম। বন্ধুটি অতি উৎসাহে কবিতাটি গ্রহন করে ছেপেছিলো। আমার এক বান্ধবী যে আমার কবিতার অতিশয় সমালোচক, এই কবিতাটাকে সমাদর করে আমার কাছ থেকে এক কপি প্রত্রিকা সংগ্রহ করেছিলো।
দৈনিকগুলো রাষ্ট্রের চোখ রাঙানীর কাছে অবনত, ব্যাবসার প্যাচে বাঁধা। সম্পাদকের ধমকের সামনে চাকুরীর হাত কচলানিতে জেরবার দশা।
চারপাশের আবর্জনা ঠেলতে ঠেলতে ক্লান্ত। আমরা কি লিখতে পারছি, কি লিখবো তাহলে? তুড়ি মেরে বুকে হাওয়া লাগিয়ে শিস দিয়ে লিখব আমাদের ছোট কাগজগুলোতে। আমরা বলছি ছোট কাগজ চোখ রাঙানীতে ভয় পাবে না। ব্যাবসার প্যাচে পড়তে হবে না। সম্পাদকের টেবিলের সামনে চাকুরী রক্ষার হাত কচলানি নেই।
ক্লান্তি ধারে-কাছে এসে চোখে-মুখে ধোঁয়া দেবে না। আমাদের ছোট কাগজ খুব বেশি সাহসী ভাবনার কাগজ হতে পেরেছে, হচ্ছে কি তাহলে? হয়তো হতে পারতো!
আমরা এখন কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে আঁধারটাকেই হাতড়ে বেড়াচ্ছি। আমাদের অনেকগুলো ছোট কাগজের বয়স ২৫ বছর পার হয়ে গেছে। সময়কে ধারণ-লালন করে নতুন শস্য ফলাবার মতো লেখকগোষ্ঠী তৈরী হয়নি। যারা তাদের নিজেদের লেখা দিয়ে একটা নিজস্ব ভাবনা-ভাষাকে মেলে ধরতে পারে।
তাদের লেখা থেকে একটা নতুন ভাপ পাবো। তারা কি তাদের খুব নিজস্ব পাঠক তৈরী করতে পেরেছে? যে পাঠক তাদের নতুন ভাবনায় আলোড়িত-আলোকিত হতে পারছে। যারা জোট হয়ে নতুন করে সব অনগ্রসরতাকে ঝেড়ে ফেলে নতুনের ডাক দেবে? যারা আমাদের রাষ্ট্রে-সমাজে ব্যথা-বেদনা-অন্যায্যতার বিরুদ্ধে একজোট গণতান্ত্রিক প্রভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারবে? অনেক পর্যায়ের আপোষকামীতার মধ্যে, সুবিধাবাদীতার মধ্যে কনুই ডুবিয়ে আম-দুধ খাচ্ছে আমাদের ছোট কাগজের কর্মীরা। প্রতিদিনের বাজার সওদা তালিকা লেখা কাগজগুলো জড়ো করে রাজনৈতিক-সামাজিক অনৈতিক সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞাপন বা নগদ অর্থ প্রাপ্তির সুবিধা নিয়ে একটা হতবাক করার মতো অবয়ব নিয়ে হাজির হচ্ছে ছোট কাগজ। যে বিপুল সংখ্যক লেখিয়েরা লিখছে কাগজটাতে তাদের লেখক কপি, যারা বিজ্ঞাপন দিচ্ছে ও নগদ টাকা দিচ্ছে তাদের কপি দেবার পর বিভিন্ন দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদক বন্ধুকে দিতে হয় কাগজটি আলোচনার জন্য, আর সাধারণ পাঠকের হাতে দেবার মতো বিশেষ তেমন কপি অবশিষ্ট থাকবে না এমন সংখ্যাই ছাপা হয়।
সাধারণ পাঠকের হাতে পৌঁছে দেবার মতো সময় বা সুযোগ কোথায়? সম্পাদক ও ম্যাগকর্মীরা চাকুরী বা ব্যবসার সাথে অহদিবারাত্রি ব্যস্ত। ম্যাগগুলো সারাদেশে ছড়িয়ে দেবার মতো বিতরণ ব্যাবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজন মনে করছে না কেউ। কিছু সংখ্যক বই-পত্রিকার স্টলে বিক্রির ব্যাবস্থা থাকলেও বিক্রির পর টাকা পাওয়ার নিশ্চয়তা নাই। এই কথাগুলো বলা গেলো ঢাকার ছোট কাগজের বিষয়ে। ঢাকার বাইরের ম্যাগকর্মীদের মধ্যে ঢাকার অনুসরণ-অনুকরণ করার একটা প্রবণতা আছে।
তারা বিজ্ঞাপন জোগাড় করার চেষ্টা করে, রাজনৈতিক-সামাজিক সম্পর্ক দিয়ে নগদ অর্থ যোগাড়ের চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের সুযোগ খুবই কম। তাদের যেটা সব থেকে বেশি সংকট দেখা দেয়, সেটা লেখা। ঢাকার খেপ খেলা লেখকদের লেখার উপর ভর করেই কাগজ করতে হয়। তবে তাদের বিক্রির চেষ্টাটা ভালো।
ম্যাগকর্মীরা বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়ে তাদের কাগজগুলো বিক্রি করে। তাদের চেষ্টা থাকে, এই সংখ্যার বিক্রির টাকাটা দিয়ে পরের সংখ্যাটা বের করতে পারার। তাদের তো মদের টেবিল বা জোয়ার আসর নেই।
এই যখন টানা দীর্ঘশ্বাস ফেলার অবস্থা ছোট কাগজগুলোর, তখন গণপ্রন্থাগার অধিদপ্তর লাখ টাকার (সন্দেহ করা হচ্ছে আরো লাখ টাকা ভাগ বাটোয়ারা হয়ে বিভিন্ন পকেটে ঢুকে গেছে) ছোট কাগজ কিনলো লোক সম্পাদক অনিকেত শামীমের ব্যাবসায়ী প্রতিষ্ঠান লিটলম্যাগ প্রাঙ্গণের মাধ্যমে। ছোট কাগজের সম্পাদকেরা ক্ষুব্ধ হলো তাদের না জানিয়ে তাদের লিটলম্যাগ প্রাঙ্গণের বিক্রয় কেন্দ্রে রাখা কাগজগুলো গণগ্রন্থগারে সরবরাহ করার জন্য।
অনেক পুরাতন সংখ্যা, এ সময়ের জন্য অপ্রয়োজনীয় অর্থে আবর্জনাম্যাগগুলো সরবরাহ করা হয়েছে। আর যে-সব ম্যাগ সম্পাদকের সাথে লিটলম্যাগ প্রাঙ্গণের ব্যবসায়ীক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে আগে থেকেই তাদের অনেক মানসম্মত ম্যাগ বিক্রয় সুবিধা বঞ্চিত হলো। তাদেরকে জানানোই হলো না। গণগ্রন্থাগারের মতো প্রতিষ্ঠানে ছোট কাগজ বিক্রি করবে কিনা, কোন কোন ছোটকাগজের আদর্শিক লড়াইয়ের জায়গাটাও আক্রান্ত ও আহতও হয় বলে অনেকে জানিয়েছেন। সে অর্থে লুকোচুরি ও কারচুপির বিশাল একটা খাদ তৈরী হয়েছে কাগজ ক্রয়-বিক্রয় কেন্দ্রিক।
আমরা গণগ্রন্থাগারকে আমাদের ৫০টি লিটলম্যাগের তালিকা জমা দিয়ে বললাম, ‘শামীম যে ম্যাগগুলো সরবরাহ করেছে, এর বাইরেও ম্যাগ আছে। আর আমাদের যেগুলো সরবরাহ করা হয়েছে, সেগুলোও আমাদের না-জানিয়েই দেওয়া হয়েছে। আমরা মনে করি, এই সরবরাহ স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয় নি। এ কার্যাদেশ বাতিল করতে হবে। সমবণ্টনের ভিত্তিতে সারা দেশের প্রকৃত লিটলম্যাগ সরবরাহের সুযোগ দিয়ে সমঅধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
’ সারা দেশের লিটলম্যাগ সম্পাদকদের সমন্বয়ে একটা প্রতিবাদের ভাষা ঠিক করে জোট হয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করলাম আমরা। জোট হবার চেষ্টা করছি আমরা। একটা সাংগঠনিক কাঠামো দাঁড় করার চিন্তা আমরা করেছি। প্রতিনিধিত্বের জন্য একবিংশ সম্পাদক খোন্দকার আশরাফ হোসেনকে আমরা মৌখিক দায়িত্ব দিতে চেয়েছি। আমাদের প্রতিনিধি হিসেবে একবার গণগ্রন্থাগারের সাথে আলাপে গেছেন তিনি।
আমাদেরকে একটা আলাদা টাকা নতুনভাবে বরাদ্ধের মাধ্যমে আপোষ রফার প্রস্তাব করা হলো। আমরা প্রত্যাখ্যান করলাম। আমরা প্রতিবাদের অবস্থানে অনড় থেকে বললাম: ‘যদি অন্যায্য কার্যাদেশটি বাতিল না করা যায়, তবে কোন ম্যাগ কত কপি সরবরাহ করা হয়েছে সেই তালিকাটা প্রকাশ করা হোক। আর ‘লিটলম্যাগ প্রাঙ্গণ’ অস্বচ্ছতার অপরাধ স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করুক। আমরা এতেই খুশি হয়ে যাবো।
লোক সম্পাদক ভিন্ন পথ ধরলো। লোক ম্যাগকে যে সব তরুণরা ব্যবহার করতে পেরেছে, লোক সম্পাদকের বিশেষ বন্ধুর লেখক-মুরিদদের দিয়ে বিভ্রান্তিমূলক লেখা লেখাতে শুরু করলো। লিটলম্যাগকে তারা এমন এক অতিবিপ্লবী স্থানে নিয়ে যাবার চেষ্টা করলো, যেখানে লিটলম্যাগ কোনভাবেই বেচা-বিক্রির জিনিস নয়। তৃতীয় পক্ষ এই লিটলম্যাগ ব্যবহার করে চাকুরী, ব্যাবসা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা ভোগ করে যাবে, আর লিটলম্যাগ সম্পাদক-কর্মীরা বিপ্লবের কোলে বসে চোখ ঢেকে রাখবে, আঙুল চুষবে অথবা মুখের মধ্যে পঁচা ইঁদুর ঢুকিয়ে মুখ এঁটে বসে থাকবে। সাবধান থাকতে হবে যেন কোনভাবেই মুখের গন্ধ বের না হয়ে যায়! ম্যাগ দিয়ে ব্যাবসা করবে অন্য কেউ, সাহিত্য দিয়ে করে-কম্মে খাবে অন্য কেউ।
লিটলম্যাগঅলারা শুধু ফতুর হবে। আর গান গাইবে: উই স্যাল ওভার কাম সাম সাম ডে! যারা নিজেরা লিটলম্যাগ কর্মী হলো না কখনো, যারা দৈনিক কাগজে তাদের স্বর্ণ কলম ও স্বর্ণ মস্তক মাসিক ১৫/২০ হাজার টাকায় বিক্রি করে। পত্রিকার পাতায় স্বর্ণডিম্ব প্রসব করে জড়ো করে বোঝা বেঁধে এক সময় প্রকাশকের ঘাড়ে চালান দিয়ে দেন। প্রকাশকও সেই স্বর্ণডিম্বের ছা ফোটানোর দায়িত্ব নিয়ে ধন্য হন। বন্ধুরা, এইসব মহান যাযকদের কাছ থেকে আমাদের বিপ্লবের আচরণ শিখতে হয়! চলছে নতুন নতুন খেলা।
মদের পার্টিতে দাওয়াত দিয়ে ভাগিয়ে নেবার চেষ্টা চলছে অনেক লিটলম্যাগ সম্পাদককে। আমাদের মহান একবিংশ সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠানটির বড় চেয়ারে বসেন। চেয়ার বড়ই বালাই! স্বগোত্রীয়দের হুক্কা-হুয়া ডাকে সাড়া না দিয়ে পারলেন না। তিনি প্রতিবাদের জায়গা থেকে সরে গেলেন। আরো অনেকে দ্বিধায় পড়েছেন।
তাদের কাছে আমাদের আব্দারÑ- আসুন, কোন ভাগ-বাটোয়ারা নয়, কোন ব্যবসা নয়, লিটলম্যাগ নিয়ে দূর্ণীতির বিরুদ্ধে আমরা সম্পাদক, ম্যাগকর্মীরা সোচ্চার হই। তারপর দেশের নাগরিক হিসেবে দেশের যে স্তরেই দূর্ণীতির হোক রুখে দাঁড়ানো, প্রতিবাদের সারিতে দাঁড়ানো নাগরিক দায় সবার।
আমরা কি আমাদের প্রতিবাদের জায়গায় দাঁড়িয়ে বিজয়ী হতে পারবো? না-কি পুচ্ছের কাপড় খুলে মদের পার্টিতে গিয়ে হুক্কা-হুয়া গীত গাইবো?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।