আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাদের বুড়িগঙ্গা নদী এবং জার্মানির মাইন রিভার

সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............

আমাদের বুড়িগঙ্গা নদী এবং জার্মানির মাইন রিভার গত একসপ্তাহে ব্যাবসায়ীক কাজে বেশ কয়েকবার বুড়িগংগা নদী নৌকায় পার হয়ে ওপাড়ে যেতে/আসতে হয়েছিল সদরঘাট এলাকা থেকে। নদীর পানি যে এতো কুতসিত, এতো নোংরা দূর্গন্ধময় হতে পারে-তা কল্পনাও করতে পারতামনা যদি বাস্তবে নাদেখতাম! গত নয় তারিখ একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বুড়িংগার দুষণ নিয়ে সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হতে দেখে এই লেখা লিখতে বসা। ঐ সচিত্র প্রতিবেদনে হাজারীবাগ এলাকার বুড়িগংগার পানি দেখানো হয়েছিল-সম্পুর্ণ লাল এবং কঠিন তরল। আমি সদরঘাট এলাকায় দেখেছি সম্পুর্ণ আলকাতরা রঙ এবং পানির ঘণত্ব প্রায় আলকাতরার মতই-সেই সংগে দুঃসহনীয় দূর্গন্ধযুক্ত। জার্মানির অন্যতম প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র হলো ফ্রাংকফুর্ট।

এ নগরীর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে মাইন রিভার, যার উৎপত্তি হয়েছে জার্মানির জাতীয় এবং পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত নদী রাইন থেকে। পেশাগত উচ্চ শিক্ষা এবং পরবর্তীতে ব্যবসায়ীক কাজে অনেকবার সুযোগ হয়েছিল জার্মানির অন্যতম সুন্দর এ নদী দেখার। গত চার বছর পর আবার ব্যবসায়ীক কাজে জার্মানীর ফ্রাংকফুর্ট গিয়েছিলাম। এবার আমার কোম্পানীর চীফ ইঞ্জিনিয়ার নুরুল ইসলাম এবং আমার ছেলেকেও সাথেনিয়ে যাই-এটা ওর প্রথম জার্মানী ভ্রমণ। বিজনেস ট্রিপ হলেও স্পন্সর কোং সাইট সিয়িং প্রগ্রাম করেছিল মুলত ছেলের সৌযন্যেই।

একদিন আমরা যাই মাইন রিভার দেখতে। আমাদের সংগী জার্মানীতে আমার বিজনেস প্রিন্সিপাল সুলজ হেরাসড,সুলজের স্ত্রী রিভ, কিশোরী কন্যা গ্রেসাট এবং তাঁর সেক্রাটারী উরসুলা। সুলজ আর উরসুলা রিভ দুজনেই খুব ভ্রমণপিয়াসী। ছর দুই আগে এরা দুজনেই আমার কোম্পানীর সৌজন্যে বাংলাদেশ ভ্রমন করে গিয়েছেন। তখন আমিও উনাদের নিয়ে ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম,কক্সবাজার,রাংগামাটি বেড়িয়ে ছিলাম।

মাইন নদীতীরে পৌঁছেই উভয় তীরের দৃশ্যাবলি দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো। কোথাও নেই কোনো ময়লা-আবর্জনা; একেবারে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। দু'তীরই ইট দিয়ে বাঁধানো। কিছুদূর পর পরই ব্রিজ দ্বারা উভয় তীর সংযুক্ত। সুদীর্ঘ এবং প্রশস্ত তীরবর্তী এলাকা।

নানা বর্ণের, নানা গোত্রের নয়নাভিরাম বৃক্ষরাজি দ্বারা শোভিত। ফাঁকে ফাঁকে সবুজ ঘাসের প্রশস্ত ও দীর্ঘ চত্বর। তীর ঘেঁষে পায়ে চলা ওয়াকওয়ে। উভয় তীরে প্রায় সমউচ্চতায় নির্মিত ঝকঝকে, তকতকে বাড়িঘরগুলো খুবই দৃষ্টিনন্দন। সারাদিন হরেক রকমের মানুষের পদধ্বনিতে মুখরিত মাইন রিভারের উভয় তীর।

তীরের সবুজ ঘাসের গালিচায় কোথাও চলছে গান, কোথাও চলছে ছেলেমেয়েদের খেলাধুলার নানা আয়োজন। ছোট ছোট ছেলেমেয়ের কৃত্রিম পাহাড়ে বা উচ্চস্থানে ওঠার প্রচেষ্টা চলছে। কখনো কখনো কৃত্রিম সে পাহাড়ের খাড়া ঢাল বেয়ে ওপরে উঠতে গিয়ে পা ফসকে পড়ে যাবার উপক্রম হচ্ছে। কিন্তু কোমরে রশি বেঁধে রাখা হয়েছে, যাতে পড়ে গিয়ে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে। একদিকে এটা যেমন খেলা, অন্যদিকে এটা একটা প্রশিক্ষণেরও কাজ করছে।

কোথাও দোকানপাট, অস্থায়ী রেস্টুরেন্ট বসানো হয়েছে। যথা দুরত্বে স্থাপিত হয়েছে উন্নতমানের স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট। বাইরে উন্মুক্ত স্থানে বেঞ্চ পাতা রয়েছে। লোকজন তাতে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে, গল্প করছে, খাচ্ছে, কত কী! চারদিকে ধুমধাম, কত হাসি, কত গান, কত আনন্দ, কত প্রাণ-কিন্তু নেই কোনো ছন্দ পতন। ছেলে হাঁটছে, যুবা হাঁটছে, বুড়ো হাঁটছে, কেউ একা, কেউবা দলে দলে।

শিশু চলছে মা/বাবার কোলে বা পিঠে কিংবা ট্রলিতে ঠেলে নিচ্ছে কেউ তার শিশুসন্তানকে। নদী এবং নদীতীরকে ব্যবহার করা হচ্ছে কেবল বিনোদন নয়, অর্থনৈতিক নানা কর্মকাণ্ডের স্থান হিসেবেও। নদীতে চলছে সরু, দীর্ঘ পানসি নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতায় নেমেছে কোথাও যুবকের দল, কোথাওবা যুবিতী কিম্বা কিশোর-কিশোরীদের দল। ঠিক আমাদের দেশে বর্ষাকালে নদীতে যেমন নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা হয় তেমনই।

তবে এখানে সব সময়ই এমন উতসব চলে। আবার অনেকে চলছে ওয়াটার ভেসেলে নৌবিহারে, আনন্দ ভ্রমণে। তীরবর্তী ওয়াকওয়ে দিয়ে সম্মুখে হেঁটে চলেছি আমরা ক’জন আর মাঝে মাঝে কখনো নদীতীর থেকে আবার কখনোবা তীরবর্তী সবুজ ঘাসে ঢাকা বিস্তৃত সবুজ চত্বরে ঢুকে ছবির পর ছবি তুলছি, ভিডিও করছি। হঠাত দেখি-তর তর বেগে উজান ঠেলে চলছে একঝাক রাজহাস। জানি না কোথা থেকে ওদের যাত্রা শুরু, কোথায় হবে শেষ।

তারও ভিডিও করল ছেলে। সুলজ/সুলজ পরিবার ভালো ইংলিশ বলতে পারেনা কিন্তু ইংলিশ বোঝেন। তাই উরসুলাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এ নদীর পানি সম্পর্কে এবং এতে মাছ থাকে কি না। তিনি বললেন যে, এ নদীর পানি পুরোপুরি না হলেও অনেকটাই পরিষ্কার এবং প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। আমাদের মধ্যাহ্নভোজে যে বৃহৎ আকৃতির বারবিকিউ মাছ পরিবেশন করা হয়েছে তা এ নদী থেকেই ধরা।

শিল্পোন্নত জার্মানির অসংখ্য শহর-বন্দর-নগরের বুক চিরে প্রবাহিত হয়ে চলেছে পাঁচশো চব্বিশ কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ এ নদী। শুনে অবাক হলাম-এ নদির পানি ব্যবহার উপযোগী এবং প্রচুর পরিমাণে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী বাস করছে এই নদীতে। তখন আমার মনে পড়ছিলো আমাদের ঐতিহ্যবাহী নদী বুড়িগঙ্গার করুণ দুরাবস্থার কথা। বিশ্বের অন্যতম প্রধান ও সুপ্রাচীন গঙ্গা নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে এ নদী মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। ইতিহাসের কত না-বলা কথা, কত বিস্মৃত অধ্যায় এর বুকে লেখা হয়ে আছে।

এত আপন, এত উপকারী, এত সম্ভাবনাময় একটি নদীকে আমরা কী করে রেখেছি! এ নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল সেই চার শতাধিক বছর পুর্বে আমাদের এ ঢাকা মহানগরী। যদি এর উভয় তীরকে আমরা মাইন রিভারের মতো পরিপাটি করে রাখতে পারতাম, তবে এটা হতে পারতো ঢাকার বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্য ও বিনোদনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। যদি সহজলভ্য একটি অতিপ্রয়োজনীয় নৌপথ হিসেবে একে বহুলভাবে ব্যবহার করা যেতো, তবে এটা যানজটের অবরুদ্ধ ঢাকা মহানগরীকে অনেকাংশে রেহাই দিতে পারতো। এমনি কতভাবেই না এর থেকে আমরা উপকার পেতে পারতাম! অথচ এর তীরে তীরে চলছে কেবল দখলের বাণিজ্য। বর্জ্য ফেলে ফেলে পানিকে বিষাক্ত করা হয়েছে।

ব্যবহারের উপায় নেই এর পানিকে যদিও তা ব্যবহার করা হচ্ছে। পানি থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত। নষ্ট হচ্ছে চারপাশের পরিবেশ। জলজ কোনো প্রাণীর উপায় নেই এখানে বেঁচে থাকার। জীর্ণ ভগ্ন নোংরা বুড়িগংগার তীর।

ভরাট করে দখল হয়ে যাচ্ছে নদী। বুড়িগংগা বাঁচলে ঢাকাবাসী বাঁচবে। কিন্তু বাঁচাবার নেই কোনো পরিকল্পনা। কেবল মাঝে মাঝে কিছু অবৈধ স্থাপনা ভাঙার ক্যামেরা/মিডিয়া শো হয়, অর্থ ব্যয় হয়। কিছুদিন পর দ্বিগুণ উতসাহে শুরু হয় আরো দখল প্রকৃয়া! (জার্মানীতে থাকা অবস্থায় আমার ল্যাপ্টপ নস্ট হয়ে যাওয়ায় লেখাটা আমি জার্মানীতে বসেই লিখেছিলাম-নুরুল ইসলাম'র ল্যাপ্টপে।

পরে লেখাটা তিনি ভুল করে ডিলিট/হারিয়ে ফেলেন। ঐ লেখাটা আরো তথ্যপুর্ণ এবং বিভিন্ন ছবি সংযুক্ত ছিল-যা এখন মনে করতে পারছিনা)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।