কলকাতা থেকে মিজানুর রহমান খান | তারিখ: ১৬-০৫-২০১-----:
এই মমতা সেই মমতা নন। অন্য এক মমতা। ভীষণ অচেনা। জনসভামঞ্চে প্রজাপতির মতো ছন্দে নেচে নেচে, ছড়া কেটে তীব্র কটাক্ষে প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করা তাঁর চিরচেনা স্টাইল। গতকাল রোববার তিনি ছিলেন অচেনা।
সেই বাক্যবাণ ও উত্তাপের ছিটেফোঁটাও নেই। বিরোধী দলের প্রতি মন্তব্যে ছিলেন সতর্ক, মার্জিত। ইটের বদলে পাটকেল নয়, সংযমী থাকাই যেন মন্ত্র। শান্তি রক্ষা ও সংযত থাকতে নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দেন তিনি। সাফ জানিয়ে দেন, মন্ত্রিসভা ছোট আকারে হবে।
প্রত্যেকের সরকারি নথিপত্র দেখেই তবে মন্ত্রিসভার পরিসর বাড়াবেন। বক্তৃতার শুরুতেই তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করেন। নবনির্বাচিত বিধায়কদের বৈঠক শুরুর কথা ছিল চারটায়। তিনি দিল্লি যাবেন বলে এক ঘণ্টা আগে আসেন। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী যাতে শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন, সে জন্য তিনি তাঁদের আমন্ত্রণ জানাবেন।
এর আগে নবনির্বাচিত বিধায়কেরা মমতাকে তাঁদের নেতা নির্বাচন করেছেন। অর্থাৎ মমতাই হচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী। নেতা নির্বাচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অহিংসার বাণীও শোনালেন এবং মানতে বললেন দলের নেতা-কর্মীদের।
ইতিমধ্যেই তৃণমূলের দলীয় কর্মীদের বেয়াড়া হয়ে ওঠার অশুভ লক্ষণ স্পষ্ট। সিপিআইএমের দুজন নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন।
প্রতিবাদে একবেলা বন্ধ্ও পালিত হলো গতকাল। নির্বাচন-পরবর্তী ব্যাপক সহিংসতার প্রতিকার চেয়ে বামফ্রন্ট আজ রাজ্যপালের কাছে স্মারকলিপি দেবে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এসব ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘কোথাও আপনাদের (দলের সম্পদ) কিছু কেউ (প্রতিপক্ষ) ভেঙে দিলে পাল্টা তাদেরটা ভাঙবেন না। দলের অর্থে নতুন করে গড়ে দেওয়া হবে। ’ দলীয় কর্মীদের প্রতিপক্ষের মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার মতো অহিংস নীতিরও তালিম দেন তিনি।
মমতার কথায়, ‘ধরুন, একটা শহীদ বেদি ভাঙা হলো। আপনারা ওটার পাশে আরেকটি গড়বেন। দেয়ালে একটি পোস্টার দেবেন। সেখানে লেখা থাকবে, “আমরা মর্মাহত। আমরা অবিচারের শিকার।
” কেউ মারলে আপনারা পাল্টা মার দেবেন না। ’
মমতা এসব মন্তব্য করেন বিধায়কদের প্রথম সভায় পরিষদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে। এদিন কর্মীদের বকুনি দেননি। বিনম্র থেকে বলেছেন, ‘টুকটাক যে যেখানে যা করছেন, তা থেকে নিজেদের সামলে নিন। আমরা সিপিআইএম হব না।
’ দলের অফিস করার বিষয়ে হুঁশিয়ার করেন তিনি। বামদের মতো তিন-চারতলা পার্টি অফিস তৃণমূলের থাকবে না। পাঁচতলায় নয়, একতলায় মুক্তি। পার্টি অফিসের খড়ের চালা থাকবে। অফিসের রং হবে মাটির।
বড় করে লেখা থাকবে মা, আম্মা, আমরা মানুষের জন্য কাজ করি। দু-এক দিনের মধ্যে শপথ অনুষ্ঠান হবে। মমতা এ জন্য একটি অভিনব পরিকল্পনা তুলে ধরেন। মন্ত্রিসভা শপথের দিন রাজ্যজুড়ে একই সময় শপথ নেবেন দলের নেতা-কর্মীরাও। লক্ষ রাখতে হবে, রাস্তা আটকিয়ে যানজট সৃষ্টি করা যেন না হয়।
প্রতিটি ব্লকে শহীদ বেদি তৈরি হবে। মুসলমান ও খ্রিষ্টানরা জ্বালাবেন মোমবাতি। হিন্দুরা প্রদীপ। টিভির পর্দায় মন্ত্রিসভার শপথের লাইভ দেখানো হবে। এ সময় রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গান বাজবে।
গতকালও মমতা শতাব্দী রায়সহ বিধায়কদের কণ্ঠে গান শোনেন।
মঞ্চে শহীদ বেদি: শহীদেরা ছিলেন অনুষ্ঠানের মধ্যমণি। একটি বড়সড় সুশোভিত মঞ্চ। দেখলেই মনে হবে, প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথিদের জন্যই এত যত্ন করে তৈরি। কিন্তু সেই মঞ্চে গতকাল কেউ বসেননি।
মঞ্চটি ছিল শহীদদের জন্য উৎসর্গিত। মঞ্চের মাঝখানে ছিল একটি শহীদ বেদি। পেছনে বড় একটি ব্যানার। মা, মাটি ও মানুষের জয়লাভে প্রণাম ও সালাম।
কলকাতার ইস্টার্ন বাইপাসে তৃণমূলের প্রধান কার্যালয়ে যে শহীদদের নামের তালিকা দেখেছিলাম, বিধায়কদের প্রথম বৈঠকে তাঁদেরই গতকাল স্মরণ করা হলো সর্বাগ্রে।
সিঁড়ি বেয়ে মঞ্চে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ফুল দেন মমতা। তার পরও বর্ষীয়ান এক নেতা বিশাল মালা নিয়ে তাঁকে পরাতে এলে তিনি দেখিয়ে দেন শহীদ বেদি। ঈষৎ কুণ্ঠিত ওই নেতা মালাটা অর্পণ করেন শহীদ বেদিতেই।
বড় একটি হলরুম। ওই মঞ্চের নিচে গোটা পঞ্চাশেক তোশকের ওপর সাদা কাপড় বিছিয়ে ঢালা বিছানা।
গন্ডা দুই কোলবালিশও ছিল। এ-ই ছিল সদ্য নির্বাচিত ও ইতিহাস রচনাকারী ১৮৪ বিধায়কের বসার স্থান। তাঁদের কারও গায়ে সাফারি বা স্যুট দেখা যায়নি। সবারই বেশভূষা সাধারণ। প্যান্ট-শার্ট।
পাজামা-পাঞ্জাবি। এত বিধায়কের আগমন বলে রাস্তায় দামি গাড়ির দীর্ঘ লাইন পড়েনি। দু-তিনটি পাজেরো চোখে পড়ে। বিধায়কদের অনেকেই এসেছেন বাসে কিংবা ট্রামে। সংখ্যালঘু ও তফসিলি বিধায়কদের তিনি আলাদাভাবে পরিচয় করিয়ে দেন।
একজন মুসলমান ছিলেন সভার সভাপতি। আরেক তফসিলি সম্প্রদায়ের বিধায়ক তাঁর বিধানসভার দলনেতা হওয়ার প্রস্তাবের সমর্থক।
মমতা অবশ্য গতকালের অনুষ্ঠানেও ছিলেন চিরচেনা। বেশ বদলাননি। হুগলির ধনেখালী এলাকার তাঁতিদের তৈরি কম দামি সফেদ শাড়িই ছিল পরনে।
পায়ে রাবারের স্যান্ডেল। মুখ্যমন্ত্রিত্বে এটা বদলাবে না বলেই তাঁর ঘনিষ্ঠরা বলেন। এ রকম স্যান্ডেল আরও দু-একজন মলিন পোশাকের বিধায়কের পায়েও দেখা গেল। জঙ্গলমহলের আলোচিত এক বিধায়ক তার অন্যতম। পাঠকের মন্তব্য
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।