বিখ্যাত মানুষের জীবনী পড়ে অনেক কিছু জানা যায়, শেখা যায় কিন্তু যারা অখ্যাত তাদের জীবনীতে কি কিছু নেই? অবশ্যই আছে কিন্তু তাদের জীবনী কেউ ছাপার হরফে লিখে রাখে না। আমি অখ্যাত, আমার জীবনীও কেউ ছাপাবে না, হয়তো কেউ পড়বেওনা তারপরও লিখে রাখি বলা তো যায় না বিখ্যাত হয়েও তো যেতে পারি।
১. জন্ম
কাদের সাহেব ভীষণ চিন্তিত, মুখ থমথমে হয়ে আছে। কাদের সাহেব কেন চিন্তিত সেটার বর্ণনা দেয়ার আগে কাদের সাহেবের পরিচয়টা দিয়ে দেয়া যাক; কাদের সাহেব কসবা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজী শিক্ষক এবং প্রধান শিক্ষক। দীর্ঘ বারো বছর ধরে তিনি অত্যন্ত সুনামের সাথে বিদ্যালয়টি পরিচালনা করছেন, ভীষণ রাগী মানুষ, শোনা যায় তার হুঙ্কারে অনেক ছাত্রই অনেকবার প্যান্ট নষ্ট করে ফেলেছে।
সুতরাং তিনি চিন্তিত মানে ঘটনা সাংঘাতিক।
মূল ঘটনা, কাদের সাহেবের বড় মেয়ে দ্বিতীয় বারের মত সন্তান প্রসব করতে চলেছেন। মেয়েকে খুব ভালোবাসেন তিনি কিন্তু রমজান মাসে এই ভোর বেলায় ফজরের নামাযের ওয়াক্তে ভরসা করার মত কোন লোক তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। চার বছরের নাতনীটাকে কোলে নিয়ে এক নাগাড়ে দোয়া দরুদ পড়ে চলছেন তিনি। কাদের সাহেবের মেয়ের জামাই কাছেই দাঁড়িয়ে আছেন।
জামাইকে কিছুটা ভীত কিছুটা লজ্জিত মনে হচ্ছে। এমনিতেই শ্বশুরকে তিনি ভয় পান আর এখন এই চিন্তিত শ্বশুর সাহেবকে দেখে তিনি আরেকটু বেশিই ভীত। ভয়ের অবশ্য আরেকটা কারণ আছে। কাদের সাহেবের মেয়ের জামাই তার মাকে ভীষণ ভালোবাসেন আবার একটু ভয়ও পান। তার মায়ের আশা ছিল নাতির মুখে দাদী ডাক শোনার কিন্তু বড় ছেলের ঘরে পরপর তিন মেয়ে হবার পর যখন ছোট ছেলের ঘরেও মেয়েই হলো তখন থেকেই তিনি অনেক পীর-ফকিরের কাছ থেকে তাবিজ এনে, আল্লাহর কাছে মানত করে চলছেন যাতে তিনি নাতির মুখ দেখতে পারেন।
সুতরাং এবার মেয়ে হলে তার মা আবারো কষ্ট পাবেন।
বাতাসে আম পাকার গন্ধ, জৈষ্ঠ্য মাসের শুরু। রাত ছোট দিন বড়। ধান কাটার মৌসুম চলছে। তার উপর রমজান মাসের মাঝামাঝি।
এই সময়টায় সবাই ব্যস্ত থাকে। মানুষ জন পাওয়াই যায় না তার উপর ভোর বেলা; কাদের সাহেবের স্ত্রী মেয়ের পাশে বসে আছেন আর সাহস দিয়ে চলছেন। মুয়াজ্জিনের কন্ঠে ফজরের আযান শোনা যাচ্ছে। কাদের সাহেব ভীষণ চিন্তিত, ভীষণ।
১৫ মে ১৯৮৭ সাল, ২ জৈষ্ঠ্য ১৩৯৪ বঙ্গাব্দ, শুক্রবার; রমজান মাসের ভোরবেলা ফজরের আযানের পরপরই কাদের সাহেবের বড় মেয়ে দ্বিতীয় বারের মত সন্তান প্রসব করলেন।
বাচ্চার কান্নার শব্দ জানান দিল পৃথিবীতে তার আগমন বার্তা। হাসি মুখে বাচ্চার নানী আতুর ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন এবং চিৎকার করে বলতে লাগলেন “আযান দেন, আযান দেন; ছেলে হইছে, ফুটফুটে এক ছেলে”। কাদের সাহেবের বাড়ির আঙ্গিনায় আবার আযানের ধ্বনি শোনা গেল, পুত্রের পিতা উচ্চস্বরে আযান দিতে পেরে ভীষণ আনন্দিত।
নাতির মুখ দেখে কাদের সাহেব ভীষণ খুশি, নাতির চেহারায় মায়ের মত মিল আছে। ছেলের চেহারায় মায়ের মত মিল থাকলে সেই ছেলে ভাগ্যবান হয়, কাদের সাহেব মনেপ্রাণে সেটা বিশ্বাস করেন।
নাতির দাদীকে এখনো খবর দেয়া হয় নাই, কাদের সাহেব নিজেই চললেন বেয়াইনকে নাতির খবর জানাতে। কসবা বাজার থেকে পাঁচ কেজি মিষ্টান্ন কিনে তিনি রওনা হলেন নাতির দাদী বাড়ির উদ্দেশ্যে, দূরত্ব ১০ কিলোমিটার।
নাতির দাদীর সাথে বেয়াই কাদের সাহেবের কথপোকথন-
কাদের সাহেব- “আসসালামু আলাইকুম, বেয়াইন সাহেব। আপনি তো আবারো দাদী হলেন। নাতনী দেখতে মাশাল্লাহ আপনার মত দেখতে হয়েছে।
”
নাতির দাদী- “ওয়া আলাইকুমুস সালাম, আবারো নাতনীই হইলো। আল্লাহর দরবারে এত কিছু মানত করলাম, গরীব-মিসকিনরে খাওয়াইলাম, আল্লাহ পাক আমার ইচ্ছা পূরণ করলেন না। কি জানি আমি গুনাহগার বান্দা হয়তো দোয়া কবুল হয় নাই। “
কাদের সাহেব- “বেয়াইন সাহেব কি নাতনীর খবরে খুশি হন নাই? আল্লাহ পাক বান্দার কোন ইচ্ছাই অপূর্ণ রাখেন না যদি সেটা পবিত্র হয়। আল্লাহ পাক আপনার ইচ্ছা পূরণ করেছেন, আপনি নাতির দাদী হয়েছেন।
নাতি মাশাল্লাহ দেখতে সুন্দর হয়েছে। “
নাতির দাদী- “আলহামদুলিল্লাহ, আপনি একটু বসেন আমি শুকরিয়া নামায পড়ে নিই। আপনি কিন্তু ইফতারি করে যাবেন”
কাদের সাহেব- “আমি আপনারে নিজে নিতে আসছি, নাতিরে কোলে নিয়ে নাতিরে দোয়া করে দিবেন। এই নাতি তো আপনার। “
নাতির দাদী- “না বেয়াই সাব, আমার নাতনী যখন হইল তখন দিনে দিনে যাইতে পারি নাই আর আজকে নাতি হইছে বলে তাকে দিনে দিনে দেখতে যাব? আল্লাহ পাক খুব নারাজ হবেন।
আমার কাছে নাতনী-নাতির একই হক। ”
২. নাম পর্ব
বাচ্চার দাদী নাতির জন্য নাম ঠিক করেছেন বিল্লাল, ফজরের আযানের সময় হয়েছে বলেই ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন বিল্লালের নামে নাম আর কাজী বাড়ির ছেলে হিসেবে কাজী বিল্লাল। নামটা বাচ্চার মায়ের পছন্দ হয় নাই আসলে শুধু মায়ের না বাবারও পছন্দ হয় নাই। কিন্তু তিনি তার মাকে কষ্ট দিতে চান না। বলা হল বাচ্চাকে এই নামেই ডাকা হবে কিন্তু পরবর্তীতে পড়াশুনা, চাকরি-বাকরির জন্য ভালো নামের দরকার আছে সুতরাং বাচ্চার মা বাচ্চার বাবা কাজী শামসুল হক ও মেয়ে কাজী মাহজাবিন হকের সাথে মিল রেখে বাচ্চার নাম রাখলেন কাজী মোহাম্মদ ইমরানুল হক।
এতো গেল আসল নাম কিন্তু একটা ডাক নামেরও তো প্রয়োজন আছে। অনেক খুঁজেও কোন ডাক নাম পাওয়া গেল না। যেই নামই পছন্দ হয় দেখা যায় সেই নামে অনেক পরিচিত জনেরাই আছেন। এবার বাচ্চার নব্য ভার্সিটি পড়ুয়া ছোট মামার ডাক পড়ল। বাচ্চাদের ব্যতিক্রম নাম দেয়াতে তিনি পারদর্শী।
ভাগ্নীর ডাক নাম পাপড়ি কে তিনি বদলে আনকমন করার জন্য করেছিলেন পাপ্পি। উনার যুক্তি নাম এমন হবে যাতে এক ডাকেই জবাব আসবে এবং চেনা যাবে। হাজার মানুষের ভীড়েও যেন ওই নামটা আলাদা থাকে। তিনিই ঠিক করলেন বাচ্চার ডাক নাম হবে রিতুল। রাতুল নয় কারন রাতুল অনেক কমন নাম আবার রিতু মেয়েদের নাম সুতরাং নাম হবে রিতুল, পুরুষালী ভাব থাকবে আবার আনকমনও হবে।
বাচ্চার মা অবশ্য একটু আপত্তি জানিয়েছিলেন কারণ রিতুল নামটাও একটু মেয়েলি টাইপ কিন্তু ছোট ভাইয়ের ব্যাখ্যায় তিনি আর বাধা দেননি। অবশেষে বাচ্চার পুরো নাম ঠিক হলো কাজী মোহাম্মদ ইমরানুল হক রিতুল। বিশাল নামকে সংক্ষেপ করে আনা হলো কে এম ইমরানুল হক রিতুল নামে এবং জন্মের চব্বিশ বছর পর সেই বাচ্চা ইমরানুল হক রিতুল নামেই বেশি পরিচিত। (প্রথম পর্ব সমাপ্ত)
ইমরানুল হক রিতুল
১৩ মে, ২০১১
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।