সময় সকাল ৭টা, ডিসেম্বর ৭, ১৯৭১
শহরের অবস্থা ভয়াবহ খারাপ, কাল সারাটা রাত গোলাগুলির শব্দ হয়েছে, কোথাও কোথাও থেমে থেমে গ্রেনেড ফাটানোর শব্দ। সকালটা ভয়াবহ নিঃশব্দ…………বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাটা একেবারেই ফাঁকা। সবাই রাতের জমাট বাঁধা আতঙ্ক কাঁটিয়ে ধাতস্হ হওয়ার চেষ্টা করছে। এখন মনে হচ্ছে এরকম একগুয়েমী না করলেও হতো। জামিলাদের নিয়ে গ্রামে চলে গেলেই হতো, অথবা ট্রেনিঙের জন্য ইন্ডিয়া চলে গেলে।
এই অসহায়ত্ব আর আতঙ্ক আর নেয়া যাচ্ছেনা। আশপাশের সবগুলো বাসা খালি, আসিফ সাহেব, মুনতাসির সাহেব, সবাই ঢাকা ছেড়েছে অনেক আগেই। বিশ্ববিদ্যালয় টিচার্স কোয়ার্টারটা খাঁ-খাঁ করছে। সর্বশেষ পাশের বাড়ির রহমান ভাইকে ও গত পরশু রাতে মিলিটারিরা তুলে নিয়ে গেছে। ভাবি গতকাল সারাটা দিন নানান জায়গায় ছোটাছুটি করেছে, আমিও ছুটলাম ভাবিকে নিয়ে; থানা তে গেলাম, শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের বাড়িতে ও গেলাম।
কেউ সহযোগিতা করলোনা, এমনকি কেউ কোন খবর ই দিতে পারলোনা রহমান ভাইয়ের!! যেন এরকম কোন লোককে কেউ কখনো দেখেইনি, তুলে নিয়ে যাওয়া তো দুরের বিষয়। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান শেষের দিকে অনেক অশালীন প্রস্তাব দিচ্ছিলেন, তাই কথা না বাড়িয়ে ভাবীকে নিয়ে চলে আসি। আসার পথে এক সাংবাদিক বন্ধুর সাথে দেখা করে জানতে পারলাম এরা নাকি লিস্ট ধরে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই নাকি প্রথম সারির টার্গেট।
রহমান ভাই আমার ডিপার্টমেন্টেরই সহকারি অধ্যাপক, বয়সে আমার চেয়ে বছর চারেক বড় হবে।
বেশ চমৎকার মানুষ, চট-পটে, হাসি-খুশী, মুক্তমনা আর মেধাবী। আমি অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক, ছোট ভাইয়ের মতন স্নেহ করেন আমাকে। ক্রমাগত দেশকে নিয়ে ভাবেন আর নানান স্ব্প্ন দেখেন। প্রায়ই আমাকে গল্প শোনান একটি স্বাধীন দেশের। দেশ স্বাধীন হলে কি কি করবেন, আমাদের কত দায়িত্ব নিতে হবে, আমাদের স্বনির্ভর হতে হলে কি কি করতে হবে এইসব নিয়েই সারাদিন বুদ হয়ে থাকেন।
এসব গল্প করতে করতে আমরা মোহাবিষ্ট হয়ে যাই। দেশ গড়ার প্রথম শর্তই তাই স্বাধীনতা।
দিন পাঁচেক আগে এক সন্ধ্যায় রহমান ভাই ৫/৬ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে এলেন তাঁর বাসায়। তাদের রাতের খাবার খাইয়ে রাতটা রাখলেন। ভোরের দিকে চলে গেল তাঁরা আর রেখে গেল কিছু অস্ত্র।
নিরাপত্তার জন্য অস্ত্রগুলো পরে আমার বাসার উঠানে পলিথিন পেচিয়ে মাটিতে পুঁতে রাখা হলো, কারন প্রথম সার্চ করলে রহমান ভাইয়ের বাসাতেই করবে। অস্ত্রগুলোর দিকে থাকতে থাকতে কেমন নেশা ধরে যায়, ভেবে অবাক হচ্ছিলাম হয়তো এই ছোট্ট জিনিশগুলোর উপরই নির্ভ্র করছে আমার দেশের স্বাধীনতা, আমার ছোট্ট মেয়েটার স্বাধীনতা……… কি অবিশ্বাস্য তার শক্তি।
পরশু রাতে কেন যে রহমান ভাইয়ের সাথে আমাকেও নিয়ে গেলো না সেটাই এক রহস্য। জামিলা ঘর অন্ধকার করে দিয়েছিলো তখন……সব বাতি নেভানো, শুধু রাস্তার ল্যাম্পপোষ্টের আলো এসে মেঝেতে পরছিলো, পরিষ্কার কিছুই দেখা যাচ্ছিল না, শুধু শব্দ শুনতে পারছিলাম আর ধারণা করছিলাম কি ঘটছে। মিলিটারিদের বুট জুতার শব্দ, চিৎকার-চেঁচামাচি আর সঙ্গে ভাবি ও রহমান ভাইয়ের বাচ্চাটার কান্নার শব্দ।
আমি একবার বের হতে চেয়েছিলাম কিন্তু জামিলা বের হতে দেয়নি, টুশিকে কোলে জড়িয়ে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখছিলো আর ক্রমাগত দোয়া পড়ছিলো। আমি যে ভয় পাইনি তা নয়, কিন্তু মনে হচ্ছিলো সে মুহুর্তে রহমান ভাইয়ের পাশে দাঁড়ানো উচিত। কিন্তু টুশির দিকে তাকিয়ে আর রহমান ভাইয়ের নির্দেশের কথা মনে পরে শেষ পর্যন্ত বের হইনি। এরকম কিছু একটা ঘটতে পারে ভেবেই রহমান ভাই দিন দুয়েক আগে আমাকে একটা কালো ব্যাগ আর একটা ঠিকানা দিয়ে নির্দেশ দিয়েছিলো যেন রহমান ভাইয়ের কিছু ঘটলেও আমি উঠানে লুকানো অস্ত্রগুলো ঐ ব্যাগে করে এ্যালিফেন্ট রোডের ঠিকানাটাতে পৌছে দেই। শেষ পর্যন্ত তার আশঙ্কাই ঠিক হল।
রহমান ভাইকে তুলে নিয়ে গেলো মিলিটারিরা। নিজেকে ভয়াবহ অসহায় আর একা মনে হচ্ছে এই মুহু্র্তে। জামিলা আর টুশির জন্য ভয় ও হচ্ছে। মনে হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহণ না করে ভুলই করলাম কিনা !!! জামিলাদের ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার বাড়িতে না পাঠিয়ে ও হয়তো ভুলই করলাম। জামিলা আমাকে একা ফেলে কিছুতেই যেতে রাজি হচ্ছিল না।
আর আমি যখন রহমান ভাইকে জানালাম আমি ইন্ডিয়াতে ট্রেনিঙে যেতে চাই, মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহন করতে চাই, তখন রহমান ভাই ও আমাকে যেতে দিলেন না। বললেন ঢাকাতেও কয়েকদিনপর লোক দরকার হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের shelter দরকার হবে, information দরকার হবে… সবাই চলে গেলে হবে না। এসব বুঝিয়েই রেখে দিলেন। কিন্তু এখন নিজেকে এখন কেমন যেন অসহায় মনে হচ্ছে, হাত পা বাধা একজন দূর্বল মানুষ মনে হচ্ছে নিজেকে, শরীরে শক্তি থেকেও কেমন যেন নির্জীব মনে হচ্ছে।
রাত থেকে টুশির জ্বর ও এসেছে। আজ ওর এক বছর পূর্ণ হল। জামিলার অনেক শখ ছিল টুশির জন্মদিনে ওর দাদা-দাদী, নানা-নানী, মামা-চাচা সবাইকে বলবে বাসায় আসতে। টুশির জন্মের পর থেকেই plan করছিলো কিভাবে ওর জন্মদিন পালন করবে, ইয়াতিম বাচ্চাদেরও দাওয়াত করার ইচ্ছে ছিলো ওর। কিছুই করা হলো না আজ, একটা লাল রঙের বলও কেনা হলো না।
লাল বল পেলে মেয়েটা অনেক খুশি হয়, ভাবছিলাম আজ নানান সাইজের লাল বল কিনে ঘর ভরিয়ে ফেলব ………আর কিনবো একটা দোলনা। দোলনা ও ওর খুব পছন্দ। সেদিন এক দূর-সম্পর্কের ভাইয়ের বাসায় গিয়েছিলাম। তার বাসায় একটা দোলনা ছিল, আরে তার ছোট বাচ্চা দুটো সেটাতে খেলছিলো। তাই দেখে টুশিও হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো।
মা আমার দোলনাতে বসে সেকি খুশী ! তখনই ঠিক করছিলাম ওর জন্মদিনে একটা দোলনা কিনবো। আহারে মেয়েটাকে কি ভীষন ক্লান্ত লাগছে আজ, জ্ব্ররের ঘোরে ঘুমোচ্ছে এখনো। তার মা সারা রাতই গা মুছিয়ে দিয়েছে আর কাঁদছিলো কেবল। ওকে স্বান্তনা দেবারও ভাষাও আমার নেই। জামিলা কোন অভিযোগ করেনি আমাকে, কিন্তু একটা প্রশ্ন করেছিল; আমাকেও যদি রহমান ভাইয়ের মত তুলে নিয়ে যায়, তাহলে ওদের কি হবে? ওর প্রশ্নের কোন জবাব আমার কাছে ছিল না, ওর আসহায় দৃষ্টিটূকূও আমি নিতে পারছিলাম না।
আবার দেশের জন্য কিছু করার আকুতিকেও আমি ছোট করে দেখতে পারছিলাম না।
কাল রাতে রেডিওতে বলছিল পাকিস্তানীদের অবস্থা কোণঠাসা হয়ে পরছে। সেদিন যে ৫-৬টা ছেলেকে আমি রহমান ভাইয়ের বাসায় দেখেছিলাম তাদের চোখের দৃষ্টিতে আমি স্বাধীনতাটা স্পষ্ট দেখতে পারছিলাম। মনে হচ্ছিল দেশ নামের মা’কে ওরা আর ধর্ষিত হতে দিবে না। ওদের কথা বলার উত্তেজনার মধ্যে এমন কিছু একটা ছিল যে আমি বারবার শিহরিত হচ্ছিলাম।
একটা জিনিষ নিয়ে আজ আমি নিশ্চিত যে স্বাধীনতা না নিয়ে ওরা আর ঘরে ফিরবে না । ওদের সাহস দেখে আমার নিজেরই রক্ত টগবগ করে ফুটছিল। ওদের সাথে তখনি বের হতে ইচ্ছে হচ্ছিল আর প্রাণপনে চিৎকার করতে ইচ্ছে হচ্ছিল “জয় বাংলা´” “জয় বাংলা” “জয় বাংলা”
বিকেল ৫টা:[/sb
এলিফেন্ট রোডে অস্ত্রগুলো দিয়ে এলাম আজ। । পুরনো একটা ভাঙ্গাবাড়ীর ঠিকানা ছিল ওটা।
অস্ত্রগুলো কাকে দিব, কি বলবো কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না। শেষে ছাদের উপর দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছেলেই আমাকে দেখতে পেয়ে আমাকে ভেতরে নিয়ে যায়। বয়স কত হবে ছেলেটার- ২১/২২….শুনে খুব অবাক হলাম বুয়েটে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছিল। আজ সে দেশের জন্য যুদ্ধ করছে। ওর বয়সী একটা ছেলে বুকের মধ্যে কতটুকু আবেগ ধরে দেশের জন্য ভেবে খুব অবাক হচ্ছিলাম।
দুপুরের দিকে শহরটা একটু শান্ত থাকে, চেকিং একটু কম হয়। তাই দুপুরেই রওনা হয়েছিলাম, জামিলা রুই মাছের একটা তরকারি রান্না করে দিয়েছিল নিয়ে যাওয়ার জন্য। এত কষ্ট হল ওদের খাওয়া দেখে!! সবাই প্রচন্ড ক্ষুধার্ত ছিল, কিন্তু ভাতের কোন ব্যবস্থাই ছিল না। শুধু তরকারিটাই ওরা ভাগাভাগি করে খেল। ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলেগুলো এত কষ্ট স্বীকার করছে দেখে চোখে পানি চলে আসছিল।
ছেলেগুলোর চেহারাগুলো এত কষ্টের পরও কেমন যেন জল-জল করছিল, কেমন অদ্ভূত একটা মায়া যেন কেউ লেপে দিয়ে গেছে ওদের চোখে-মুখে। ওরা যখন চোয়াল শক্ত করে জানাল আজ তারা ধানমন্ডি থানাতে আক্রমন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মুক্ত করে আনবে, ওদের কন্ঠস্বর শুনে আমি নিশ্চিত জানতাম ওরা তা করেই ছাড়বে। থানায় রাখা অস্ত্র আর শিক্ষক দুটোই তাদের প্রয়োজন। যে শিক্ষকরা ওদের সবরকমভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন তাদের উপর নির্যাতন মেনে নেওয়া যায় না। ওখানে রহমান ভাই ও থাকতে পেরে আমার মনে একটু ক্ষীণ আশা দেখা যাচ্ছিল।
ফেরার পথে রাহাতের সাথে দেখা হল। রাহাত আমার ছোটবেলার বন্ধু। দেখেই আমাকে জড়িয়ে ধরল। চোখ দিয়ে পানি চলে আসল ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঢাকায় ফেরত এসেছে দেখে। ।
আমাকে দেখে সেও কাঁদছিল, কারণ বাড়িতে খবর গিয়েছে আমাকে মেরে ফেলা হয়েছে। যদিও আমিই আব্বাকে বলেছিলাম এই মিথ্যা কথাটা স্থানীয় রাজাকারদের বঅলতে। কারণ পাকিস্তানীদের আমরা মোকাবিলা করতে পারব ঠিকই কিন্তু এই রাজাকেরদের মোকাবেলা করাটাই শক্ত। বাড়ি-বাড়ি গিয়ে খুন, ধর্ষন ছাড়াও লন্ঠন, আগুন লাগানো কোনটাই এরা বাদ দিচ্ছেনা। ইসলামী জেহাদের নামে কোন কাজ করতেই ওদের বিবেক বাঁধেনা।
বাড়ি বাড়ি পাকিস্তনীদের নিয়ে যাওয়াও এদেরই কাজ।
সাঈদের সাথেও দেখা হল বাসার সামনের মোড়ে। শুনেছি রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছে ও। আমি কি করছি আজকাল, কোথা থেকে আসছি, এসবই জিজ্ঞেস করছিল। কাল রহমান ভাইয়ের কি হল জিজ্ঞেস করতেই কিছু বল্ল না।
বল্ল জানি না। কিন্তু মিলিটারি বুটের শব্দের সাথে আমি সাঈদের গলার শব্দ ও পেয়েছিলাম মনে হচ্ছে। কি জানে ভুল শুনেছিলাম কিনা……………!
রাত ১০টায় রহমান ভাই ও কিছু শিক্ষক বাসায় আসলেন। ধানমন্ডির অপারেশন সাক্সেসফুল। ধানমন্ডি থানা থেকেই উনাদের উদ্ধার করা হয়েছে।
৬টা পাকিস্তানী মারা গেছে, ২টা রাজাকারও পাওয়া গেছে, আর পাওয়া গেছে অনেক অস্ত্র আর গোলা- বারুদ। এগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক কাজে আসবে। এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগলেন রহমান ভাই। আজ রাতেই নাকি এদের মেরে ফেলতো মিলিটরীরা। এখন পযর্ন্ত কোন information না পাওয়াতে এদের বাঁচিয়ে রাখাটা অনর্থক মনে করছিল পাকিস্তানীরা।
রহমান ভাইয়ের অর্ধেকটা শরীরই রক্তাক্ত। একটা দাঁত ভাঙ্গা, রক্ত ঝরছে সেখান থেকে এখনো, একটা চোখ কাল হয়ে ফুলে আছে। কাঁধের দিকে এক পাশে ছড়ে গিয়ে রক্ত ঝরছে। ভাবী আর রহমান ভাইয়ের বাচ্চা আমাদের বাসাতেই ছিল। সেই ঘটনার পর আর ওদেরকে একা থাকতে দেইনি।
ভাবী আর রহমান ভাইয়ের কান্না-কাটি দেখে সবার চোখেই পানি চলে আসছিল কারণ কেউই আর কাউকে জীবিত দেখবেন বলে ভাবেননি। একটু ধাতস্থ্ হয়েই ভাবী গেল শুকরিয়া নামায পড়তে আর রহমান ভাই বলেলন এখান থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে বের হতে হবে। কারণ এখানেই পাকিস্তানীরা সবার আগে খোঁজ করবে। সিদ্ধ্বান্ত হল রহমান ভাই, ভাবী আর বাচ্চাকে নিয়ে আশুগঞ্জ তার বাড়ীতে চলে যাবেন, সাথে নিয়ে যাবেন জামিলা আর টুশিকে। তারপর তাদের ব্রাহ্মণবাড়ীয়া পৌছে দিবেন।
দিন দুয়েক পর মুক্তিযোদ্ধাদের একটা টীম আসবে এখানে। তাদের অন্য কোন নিরাপদ জায়গায় পৌছে দিয়ে আমিও বাড়ী ফিরব তারপর । জামিলা রাজী হচ্ছিল না আমাকে একা রেখে যেতে, কান্না-কাটি শুরু করল। শেষে বহু কষ্টে বোঝানো হল যে সে চলে গেলেই আমি বেশী নিরাপদ থাকব। ২দিন পর সব শেষ করে আমিতো বাড়ী ফিরছিই।
তারা চলে গেলে আমিও একা বাড়ী ফিরতে রিস্ক কম। সব গুছিয়ে ওদের বের হতে হতে ১০.৪০ এর মতন বাজল। মেয়েটা আমার কোলেই ঘুমিয়ে ছিল, মার কোলে যাওয়ার সময় ঘুমের মধ্য থেকেই বাবা-বাবা বলে কাঁদতে শুরু করল। জানি না মেয়ের মুখে বাবা ডাক আর শুনতে পারব কি না……তাই শেষবারের মত জড়িয়ে থাকলাম আমার রাজকন্যাকে। যতক্ষন এগিয়ে দেওয়া সম্ভব ততক্ষনই জড়িয়ে থাকলাম ওকে।
তাকে দোয়া করলাম মুক্তিযোদ্ধের আদর্শকে লালন করে অনেক বড় হয়ে ওঠার, সকল অন্যায় অবিচারের প্রতি challenge ছুড়ে দেওয়ার।
রাত ১১টার দিকে সাঈদ কয়েকজন মিলিটারীকে নিয়ে আমার বাসায় হুড়মুড়িয়ে ঢুকল। রহমত ভাই আমার কাছে এসেছিলেন কিনা জানতে চাইল, তার পরিবার, আমার পরিবার কোথায় জানতে চাইল। তেমন সুদোত্তর না পেয়ে সাঈদ আমার মাথায় রাইফেলের বাট দিয়ে সজোড়ে আঘাত করল। আমার মনে হচ্ছিল পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে, আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছি।
কিন্তু কে একজন ধাক্কা দিয়ে আমাকে সোফার উপর ঠেলে দিল। কিছুক্ষন পর সাঈদ আবার আমাকে প্রশ্ন করতে লাগল। আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না যে সাঈদ আমারই সপাঠী। অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করছিল আমাকে ও আমার পরিবারকে। আমাদের বাঙ্গালীদের, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের গাদ্দার বলে আমাকে মেরে ফেলার permission চাচ্ছিল মিলিটারী অফিসারের কাছে।
আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম এই কি আমার ভাইতূল্য কোন বাঙ্গালী ! নাকি আমার দেশে জন্ম নেওয়া ইসলামের লেবাশধারী কোন জারজ, যে তার ভাইদের হত্যা করতে পারে ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য।
এ কি দেশপ্রেমিক কোন মানুষ নাকি স্বার্থান্বেষী একজন দেশদ্রোহী যে নিজের দেশকে বিক্রি করে দিচ্ছে নিজের নোংরা লোভের জন্য।
হঠাৎ খুব কষ্ট হতে থাকে আমার মেয়েটার জন্য যে কিনা এক বছর বয়সেই তার বাবাকে হারাবে। যাকে তার বাবা জন্মদিনে একটা লাল বল কিনে দিতে পারে নি, যার হাত ধরে তার বাবা তাকে হাটতে শেখাতে পারে নি। যাকে তার বাবা দোলনাতে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে যেতে পারে নি।
জামিলার জন্য ও কষ্ট হয়। নিশ্চই রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে আমার পথ চেয়ে, নিশ্চই আমার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখার প্রহর গুনবে। আব্বা-আম্মার জন্য ও কষ্ট হচ্ছে। আমার লাশটা কি অনেক ভারী হবে! আব্বা কি আমার লাশ নামাতে কবরে নেমে আর উঠতে পারবে নাকি আমার কবরের পাশেই বসে থাকবে দিনের পর দিন! আম্মা কি আমার গল্প শোনাবে আমার মামনীকে! আমার জন্য আম্মা কি কষ্ট পাবে, নাকি গর্ব করবে আমাকে নিয়ে? অবশ্যই গর্ব করবে! কষ্ট ছাপিয়ে হঠাৎ আমার আনন্দ হয়। আত্নতৃপ্তিতে ভরে উঠে আমার মন।
আমার গর্ব হয় আমি দেশকে ভালবাসতে পেরেছি বলে, দেশের জন্য প্রাণ দিতে পারছি বলে। মৃত্যুর পর আমার কথা কিছু মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরন করবে বলে, যা এই কুকুর শ্রেনীর বেঈমানদের জন্য কখনো হবে না। আমাদের কথা স্মরন করে ভবিষ্যতে কিছু তরূণ উজ্জীবিত হবে ভেবে আমার মৃত্যুকে মৃত্যু মনে হয় না, মনে হয় তা যেন অমরত্মেরই নাম। আমার ভেবে খুব আনন্দ হয় এরা পৈশাচিকতা করছে বলেই হয়তো এদের কখনো ক্ষমা করা হবে না, পার পেয়ে যাবে না এরা কখনো। যে কয়টা মুক্তিযোদ্ধা আমি দেখেছি তাদের দৃষ্টি যদি আমি ঠিক পড়ে থাকি তাহলে এই শেয়াল কুকুরদের তারা কখনোই ছেড়ে দেবে না।
বেঈমানদের কখনোই ছেড়ে দেবেনা আমার উত্তরসূরীরা। এই স্থির দৃষ্টি আর শক্ত চোয়ালে ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার চলবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
মৃত্যুমুখে দাঁড়িয়েও তাই আমি শেষবারের মতোন চিৎকার করি ‘জয়য়য়য়য়য়য়য়য় বাংলা’ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।